নিজস্ব প্রতিবেদক :
ভারতের ঐতিহ্যময় ও পরম্পরাগত জাগ্রত দেবী মনসার মেলা খেদাইতলা সাপের মেলা। শিয়ালদহ-রানাঘাট লাইনের চাকদহ স্টেশন থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরত্বে খেদাইতলা মনসা মন্দির অবস্থিত।
মূলত শ্রাবণ মাসে মা মনসা দেবীর পুজোর দিন এখানে একদিনের মেলা বসে। মেলায় নদিয়া, দুই ২৪ পরগনা, হুগলি এমনকি কলকাতা, হাওড়া, বর্ধমান এবং মুর্শিদাবাদ থেকেও ভক্ত, দর্শনার্থীরা আসেন। এই মেলার মূল আকর্ষন সাপুরিয়া ও তাদের সাপের খেলা। ভারতের প্রথম সারির টিচার্স ট্রেনিং সেন্ট মেরিজ কলেজের বিশেষ একটি টিম অধ্যাপক প্রদীপ অধিকারীর নেতৃত্বে এই মেলা ভিজিট করেন। ড. অধিকারী সহ গবেষক টিমের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিট্টু বিশ্বাস, শুভজিৎ দাস, আম্রিকা বিশ্বাস, মৌমিতা পাল, বৈশাখী রায় ও সর্বানন্দ বিশ্বাস।
এই টিমের সদস্যরা প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে মেলার আগত ভক্ত দর্শনার্থী, পুরোহিত, সপুড়িয়া, ব্যবসায়ী, প্রশাসনিক আধিকারিক, বিভিন্ন সেচ্ছাসেবকদের সাথে কথা বলেন। আমাদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক অধিকারীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান “নদিয়ার সেন্ট মেরিজ কলেজের একটি প্রয়াস সব সময় থাকে সেটা হলো ভারতীয় বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জনগোষ্ঠীর আদি ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতির ও শিক্ষার হালহকিকত অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা। আমাদের কলেজ সেই কাজটি দীর্ঘ নয় বছর ধরে বেশ ভালো ভাবেই করে আসছে। আমরা ইতিপূর্বে ঠাকুর নগরের মতুয়া সম্প্রদায়, নবদ্বীপধাম, কল্যাণীর সতিমায়ের মেলা ও কর্তাভাজা সম্প্রদায়, রানাঘাট কুপার্স ক্যাম্পের উদ্বাস্তু নিয়ে গবেষণা করেছি। অন্য কলেজের তুলনায় সেন্ট মেরিজ কলেজের সুবিধা হলো কলেজের মাননীয় চেয়ারম্যান সাহেব এই ধরনের জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা ও সমাজ সচেতনতামুলোক কাজে সার্বিক সহযোগিতার সহিত উৎসাহ দিয়ে থাকেন।”
অধ্যাপক প্রদীপ অধিকারী আরও জানান খেদাইতলা মনসা মেলায় ঐতিহ্য ও পরম্পরাগত ভাবে এখনও মায়ের উদ্দেশ্যে পাঠা বলি, কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। সাধারণত যারা মায়ের কাছে মানদ করে উপকৃত হয়েছেন তারাই পরবর্তী সময় মায়ের উদ্দেশ্য ভোগ চরান, ভক্তি সহকারে পুজো দেন। এই মেলার মুল আকর্ষন বেদে সাপুরিয়া। মনসা পুজো উপলক্ষে সাপুড়েরা চার ফুট রাস্তার দুপাশে ভিড় করে সাপের খেলা দেখায় এবং মাদুলি তাবিজ বিক্রি করেন।
বর্তমানে সরকারি বাঁধা নিষেধ থাকায় মেলায় ২০১৬ সাল থেকে সপুরিয়ারা সংখ্যায় অনেক কম আছে। এমনি এক সাপুরিয়া মুর্শিদ ভাইয়ের সাথে গবেষক টিম কথা বলে জানতে পারে মেলা সৃষ্টি থেকে তাদের বাব-দাদারা এখানে খেলা দেখাতে আসতেন। এখন ওনারা আসেন। তবে রোজগার অনেক কমে গেছে। রাজা আসে রাজা যায় কিন্তু বাংলার বেদে জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ক্ষমতায়ন কিছুই হয় না। সবাই বলে সাপের খেলা দেখানো চলবে না। প্রকৃতি বান্ধব বিভিন্ন সংগঠন তাদের থেকে সাপ কেড়ে নিয়ে যায়, সাপের খেলা দেখাতে দেয় না। তাই মুখ লুকিয়েই কাজ করতে হয়। কেউ বিকল্প কাজের সুযোগও দেয় না। গ্রাম্য এই মেলায় সব কিছু থাকা সত্ত্বেও খেদাইতলার মেলার বিশেষত্ব সাপ আর সাপুড়েতে। তাই এর নাম খেদাইতলার সাপের মেলা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে বেদে-বেদিনীরা আসেন নানা রকমের সাপ নিয়ে। তবে একটা কথা বলা দরকার, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের জেরে হাত পড়েছে সাপুড়েদের পেশায়। তাই ক্রমেই কমে আসছে মেলায় আসা সাপুড়েদের সংখ্যাও।
তিনি আরও জানান এক সময় এই মেলায় বিদেশি পর্যটক, সাংবাদিকরাও ভিড় জমাতেন বেদে সাপুড়িয়া দের জীবন সংস্কৃতির অনুসন্ধানে।
মেলার পুরোহিত জানান অপূর্ব ব্যানার্জী আমাদের সংবাদ প্রতিনিধিদের জানান কথিত আছে ৩২০ বছর আগে খেদাই নামক এক জন মারা যান। পরিবারের মানুষজন মৃত খেদাইকে নিম গাছের তলায় রেখে বাড়ি ফিরে যান। পরের দিন দেবী মনসার কৃপায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। সেই থেকে ওই স্থান খেদাইতলা নামে প্রচারের আলোকে আসে। আজও সেই নিম গাছ বেচেঁ আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই গাছের তলায় এসে মানদ করেন, সাপ ও দেবী মনসার পুজো করেন। দীর্ঘ দুই বছর লকডাউনের পর এই বছরের মেলায় মানুষের ঢল অনেক বেশি। প্রায় দেড় লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে আজকের সাপের মেলায়।