Dhaka ০৯:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

“যুবসমাজ ধ্বংসের নেপথ্যে পাবজি” : অনুকূল বিশ্বাস

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৫:৪৮:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুন ২০২১
  • ২৫৪ Time View

অনুকূল বিশ্বাস,মালদহ জেলা প্রতিনিধি:

সময়ের করালগ্রাসে শিশু-কিশোরদের ধুলো, বালি,জলকাদা মাখা শৈশব অনেকদিন আগেই চুরি হয়ে গেছে।

দুই কামরার ঘরের মধ্যে কাটানো জীবন গঠনের মূল্যবান সময়ে বাবা-মা সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন মুঠোফোন। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা মা মুঠোফোন দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যায়। কিন্তু আজ সেই বাধ্যবাধকতায় তার ক্ষতির পরিমাণ তাঁদের ধারণার বাইরে চলে গেছে। অভিভাবক কখনও ভাবতেই পারেননি যে তাঁদের দেওয়া মুঠোফোন সন্তানের ভবিষ্যৎ এইভাবে ধ্বংস করবে।বাবা-মায়ের ক্যারিয়ার ও সফলতা নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে সন্তান একাকিত্ব জীবনের অভিশাপে লাইনচ্যূত হয়ে গেছে খেয়াল করেননি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মোবাইলে চলে এসেছে ভয়ানক সব গেম। পাবজি এমনই এক মোবাইল গেম। পাবজি মোবাইল গেম বর্তমান শিশু-কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশু, কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে পাবজি খেলার নেশা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।তাঁদের হাতে এখন ওঢেল সময় ।তাই ঐ গেম খেলার নেশায় বুদ হয়ে রাতদিন এক করে খেলে যাচ্ছে।অভিভাবক পরিস্কার বুঝতে পারছেন তাঁর সন্তান ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারছেন না।

বিশেষজ্ঞদের মতে ১২ থেকে ২৬ বছরের বয়সীদের মধ্যে এই গেম খেলায় নেশা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা সারারাত জেগে এই খেলার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রবল অবনতি হচ্ছে। প্রত্যেকে মানসিক অবসাদে ভুগছে। সেইসঙ্গে তাদের বাবা-মাকেও মানসিক অবসাদ গ্রাস করে দিচ্ছে। নিজের ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ভাবনার অবকাশ হারিয়ে ফেলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক রোগের সঙ্গে সঙ্গে নিউরো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। এতে করে অভিভাবক দিশাহীন হয়ে পড়ছেন।এই খেলায় খেলোয়াড় গেমের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে বাবা মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতেও বিরক্তি প্রকাশ করছে। বাবা মা সন্তানকে যখন এই খেলা থেকে বিরত থাকতে বলছে তখন সে তাঁদের উপর রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে।তার আচরণে অনুশাসন ও শিষ্টাচারের লেশমাত্র থাকছে না। ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে যাকে মানুষ করেছে তার এমন মূর্তি দেখে বাবা-মা ঘাবড়ে যাচ্ছেন। ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। নিজের সন্তানকে যেন নিজেই চিনতে পারছেনা। ফলে চুপচাপ মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ পড়ছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কি আছে এই পাবজি গেমে? যার জন্য লক্ষ লক্ষ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এই গেম খেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। এটা আসলে একটি দক্ষিণ কোরিয়ান ধ্বংসাত্মক ভিডিও গেম।2017 সালের মার্চ মাসে পিইউবিজি কর্পোরেশন নামক একটি কোম্পানি পাবজি গেম বাজারে আনে।ভারতে এই গেম লঞ্চ করে 2018 সালের এপ্রিল মাসে। এখানে রয়েছে প্রচুর অর্থ উপার্জনের কাল্পনিক প্রলোভন। অনলাইন ভিত্তিক এই গেমে একসঙ্গে একশ জন মানুষ একটি পরিত্যক্ত দ্বীপে থাকে। খেলোয়ারকে প্রথমে প্যারাসুটে করে সেই দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তাকে একে অপরকে হত্যা করে টিকে থাকতে হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে ছেলে মেয়েরা আনন্দ পায়। একজনকে হত্যা করলে অন্য জনকে হত্যা করার স্পৃহা বেড়ে যায়। এরকম যখন চলতে থাকে তখন খেলা ছেড়ে তারা উঠতে চায় না। ভয়ঙ্কর সব গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একে একে হত্যালীলা চালাতে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা। অনলাইনে বন্ধুরা পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তার মাধ্যমে হত্যালীলার ছক কষতে থাকে। হত্যা শেষে যে ব্যক্তি বা গ্রুপ বেঁচে থাকে তারাই বিজয়ী হয়। বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে এমন সব পাবশিক ও নোংরা ষড়যন্ত্রের কথা বলাবলি করে যে সেগুলি যাতে বাবা-মা শুনতে না পায় তার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে গেম খেলে।

সব মিলিয়ে মোবাইলে পাবজি খেলায় তারা এতটাই মগ্ন হয়ে থাকেন যে,সেই সময় তারা বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ক্রমেই মনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এক ধ্বংসাত্মক প্রবণতা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই গেম তাকে প্রকট করে দেয়। ফলে সে যত বেশি এই গেম খেলতে থাকে ততই তার মধ্যে এই নির্মম ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মানসিক চাপ ও হারাতে থাকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। নিজেদের কথাবার্তার মধ্যে আসতে থাকে অসংলগ্নতা। পরিবারের কেউ তার মনের বিরুদ্ধ কিংবা অপছন্দের কোন কথা বললে তারা সেগুলো সহ্য করতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়ে ফেলে।

অনেক সময় সহজ-সরলমনা অভিবাবকরা বুঝতেই পারেন না যে ,এই তুচ্ছ বিনোদন তার সন্তানের এত মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আসলে এই গেম হচ্ছে পুঁজিবাদী সভ্যতার বিনোদন।যা শুধু টাকার বিনিময়ে কথিত আনন্দ দিয়েই ক্ষান্ত হয় না ,উপরি পাওনা স্বরূপ কেড়ে নেয় সময়, সম্পদ ,মেধা,জীবনের সুন্দর ভবিষ্যৎ ,মানসিক সুস্থতা, পরিবারের শান্তি সহ জীবনের মহামূল্য আরো অনেক কিছু। যে সন্তানকে নিয়ে বাবা-মা স্বপ্ন দেখেছিলেন চোখের সামনে তা এই ভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া তাঁরা সহ্য করতে পারছেন না। ফলে সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরাও মনের স্বাভাবিকতা হারাতে বসেছেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চরম অন্ধকারের দিকে চলে যাওয়া তারা কিছুতেই মানতে পারছেন না।

পাবজির ধ্বংসাত্মক আসক্তি থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে প্রথম ও প্রধান ভূমিকা নিতে হবে বাবা-মাকে ই। অসম্ভব ধৈর্য ও ঠান্ডা মাথায় তাঁদের বিষয়টা আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এই খেলার ভয়ংকর দিক গুলো তাকে বারে বারে বোঝাতে হবে। প্রথমেই খেলা একবারে বন্ধ করলে হবে না। এতে তার মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, এমনকি হঠাৎ করে মারাত্মক কিছু করেও বসতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমে বাবা-মা সন্তানকে অনেকটা বেশি সময় দিন,যাতে সে গেম নিয়ে ভাবারই সময় না পায়। এই অবস্থায় বাবা-মায়ের সন্তানের উপর কড়া শাসনের চাবুক চালানো একদম অনুচিত । মনে রাখবেন সে কিন্তু ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত হয়ে আছে। তাই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ,আদর করে ,ভালোবেসে কাছে টেনে নিন। বাবা-মা চেষ্টা করুন তাকে দিয়ে বাড়ির ছোটখাটো কাজ করানো। এতে যদি সে আপত্তি জানায় জোর করবেন না। পরের দিন আপনাদের সঙ্গেই বাড়ির কোন কাজে নিয়োজিত করার চেষ্টা করুন। সেটা সফল হলে পাড়ার মুদিখানা দোকানে ছোটখাট জিনিস আনতে পাঠান। ইন্ডোর বা আউটডোরে যে খেলাই সে ভালোবাসে সেই খেলায় তাকে নিয়মিত করুন ; সম্ভব হলে আপনারা তার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকুন।তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলবেন, গল্প করবেন। ছোটবেলা থেকে সে যা যা ভালোবাসতো সেগুলি তার জীবনে নতুন করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন বিকেলে তাকে নিয়ে নিজের শহরের মধ্যে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে যান। এতে তার মনটা অন্য দিকে মোড় নেবে। সম্ভব হলে সন্তানকে নিয়ে সে যেখানে ঘুরতে পছন্দ করে সেরকম জায়গায় দীর্ঘ ছুটিতে চলে যান। এতে করে পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক পরিবর্তন আসবে। এর ফলে ওই গেমের আসক্তি একটু একটু করে কমে আসবে।বাবা-মা সব সময় মনে থাকবে এর কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এর চটজলদি কোন সমাধান নেই। একমাত্র আপনাদের অগাধ ধৈর্য ও সহনশীলতাই আপনার সন্তানকে একসময় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনবে।

যে পাবজি গেম শিশুর মস্তিষ্ক ধ্বংস করছে, মেধা শক্তি বিকল করে দিচ্ছে,তাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করছে, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে——— এমন সহিংস্র ও ধ্বংসাত্মক গেম অনতিবিলম্বে সরকারি আইন করে বন্ধ করা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে ও অঙ্কুরিত মেধা বিনষ্ট ঠেকাতে দেশের সরকারের সময় এসেছে এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার । ইতিমধ্যে ভারতের বম্বে হাইকোর্ট ও গুজরাট পুলিশ এই পাবজি গেম বন্ধের নোটিশ জারি করেছেন। দিল্লির শিশু অধিকার রক্ষা কমিটি শিশুদের পক্ষে পাবজি ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করেছেন। এই পাবজি নিয়ে দেশের অভিভাবক- অভিভাবিকারা কতটা উদ্বিগ্ন সমাজের আনাচে কানাচে কান পাতলেই টের পাওয়া যায়।তাই তো সারাদেশের ভুক্তভোগী অভিভাবকদের করুণ আবেদনে সাড়া দিয়ে দেশের সরকার পাবজি গেমকে বে-আইনি ঘোষণা করুন সেটাই তাঁরা চাইছেন এবং দেশের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার্থে কঠোর ভাবে সেই আইন বলবৎ করার চেষ্টা হোক।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Raj Kalam

Popular Post

“যুবসমাজ ধ্বংসের নেপথ্যে পাবজি” : অনুকূল বিশ্বাস

Update Time : ০৫:৪৮:৫৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুন ২০২১

অনুকূল বিশ্বাস,মালদহ জেলা প্রতিনিধি:

সময়ের করালগ্রাসে শিশু-কিশোরদের ধুলো, বালি,জলকাদা মাখা শৈশব অনেকদিন আগেই চুরি হয়ে গেছে।

দুই কামরার ঘরের মধ্যে কাটানো জীবন গঠনের মূল্যবান সময়ে বাবা-মা সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন মুঠোফোন। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা মা মুঠোফোন দিতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যায়। কিন্তু আজ সেই বাধ্যবাধকতায় তার ক্ষতির পরিমাণ তাঁদের ধারণার বাইরে চলে গেছে। অভিভাবক কখনও ভাবতেই পারেননি যে তাঁদের দেওয়া মুঠোফোন সন্তানের ভবিষ্যৎ এইভাবে ধ্বংস করবে।বাবা-মায়ের ক্যারিয়ার ও সফলতা নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে সন্তান একাকিত্ব জীবনের অভিশাপে লাইনচ্যূত হয়ে গেছে খেয়াল করেননি।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই মোবাইলে চলে এসেছে ভয়ানক সব গেম। পাবজি এমনই এক মোবাইল গেম। পাবজি মোবাইল গেম বর্তমান শিশু-কিশোর ও যুব সমাজের মধ্যে মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বর্তমান লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিশু, কিশোর-কিশোরী ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে পাবজি খেলার নেশা মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।তাঁদের হাতে এখন ওঢেল সময় ।তাই ঐ গেম খেলার নেশায় বুদ হয়ে রাতদিন এক করে খেলে যাচ্ছে।অভিভাবক পরিস্কার বুঝতে পারছেন তাঁর সন্তান ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তাকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারছেন না।

বিশেষজ্ঞদের মতে ১২ থেকে ২৬ বছরের বয়সীদের মধ্যে এই গেম খেলায় নেশা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা সারারাত জেগে এই খেলার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রবল অবনতি হচ্ছে। প্রত্যেকে মানসিক অবসাদে ভুগছে। সেইসঙ্গে তাদের বাবা-মাকেও মানসিক অবসাদ গ্রাস করে দিচ্ছে। নিজের ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ভাবনার অবকাশ হারিয়ে ফেলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক রোগের সঙ্গে সঙ্গে নিউরো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। এতে করে অভিভাবক দিশাহীন হয়ে পড়ছেন।এই খেলায় খেলোয়াড় গেমের প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়ছে যে বাবা মায়ের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতেও বিরক্তি প্রকাশ করছে। বাবা মা সন্তানকে যখন এই খেলা থেকে বিরত থাকতে বলছে তখন সে তাঁদের উপর রুদ্রমূর্তি ধারণ করছে।তার আচরণে অনুশাসন ও শিষ্টাচারের লেশমাত্র থাকছে না। ছোটবেলা থেকে কোলেপিঠে করে যাকে মানুষ করেছে তার এমন মূর্তি দেখে বাবা-মা ঘাবড়ে যাচ্ছেন। ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। নিজের সন্তানকে যেন নিজেই চিনতে পারছেনা। ফলে চুপচাপ মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ পড়ছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কি আছে এই পাবজি গেমে? যার জন্য লক্ষ লক্ষ অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা এই গেম খেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। এটা আসলে একটি দক্ষিণ কোরিয়ান ধ্বংসাত্মক ভিডিও গেম।2017 সালের মার্চ মাসে পিইউবিজি কর্পোরেশন নামক একটি কোম্পানি পাবজি গেম বাজারে আনে।ভারতে এই গেম লঞ্চ করে 2018 সালের এপ্রিল মাসে। এখানে রয়েছে প্রচুর অর্থ উপার্জনের কাল্পনিক প্রলোভন। অনলাইন ভিত্তিক এই গেমে একসঙ্গে একশ জন মানুষ একটি পরিত্যক্ত দ্বীপে থাকে। খেলোয়ারকে প্রথমে প্যারাসুটে করে সেই দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তাকে একে অপরকে হত্যা করে টিকে থাকতে হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে ছেলে মেয়েরা আনন্দ পায়। একজনকে হত্যা করলে অন্য জনকে হত্যা করার স্পৃহা বেড়ে যায়। এরকম যখন চলতে থাকে তখন খেলা ছেড়ে তারা উঠতে চায় না। ভয়ঙ্কর সব গোলাবারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একে একে হত্যালীলা চালাতে থাকে। সেই সঙ্গে চলতে থাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা। অনলাইনে বন্ধুরা পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তার মাধ্যমে হত্যালীলার ছক কষতে থাকে। হত্যা শেষে যে ব্যক্তি বা গ্রুপ বেঁচে থাকে তারাই বিজয়ী হয়। বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে এমন সব পাবশিক ও নোংরা ষড়যন্ত্রের কথা বলাবলি করে যে সেগুলি যাতে বাবা-মা শুনতে না পায় তার জন্য ঘরের দরজা বন্ধ করে গেম খেলে।

সব মিলিয়ে মোবাইলে পাবজি খেলায় তারা এতটাই মগ্ন হয়ে থাকেন যে,সেই সময় তারা বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ক্রমেই মনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এক ধ্বংসাত্মক প্রবণতা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এই গেম তাকে প্রকট করে দেয়। ফলে সে যত বেশি এই গেম খেলতে থাকে ততই তার মধ্যে এই নির্মম ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে মানসিক চাপ ও হারাতে থাকে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। নিজেদের কথাবার্তার মধ্যে আসতে থাকে অসংলগ্নতা। পরিবারের কেউ তার মনের বিরুদ্ধ কিংবা অপছন্দের কোন কথা বললে তারা সেগুলো সহ্য করতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দিয়ে ফেলে।

অনেক সময় সহজ-সরলমনা অভিবাবকরা বুঝতেই পারেন না যে ,এই তুচ্ছ বিনোদন তার সন্তানের এত মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। আসলে এই গেম হচ্ছে পুঁজিবাদী সভ্যতার বিনোদন।যা শুধু টাকার বিনিময়ে কথিত আনন্দ দিয়েই ক্ষান্ত হয় না ,উপরি পাওনা স্বরূপ কেড়ে নেয় সময়, সম্পদ ,মেধা,জীবনের সুন্দর ভবিষ্যৎ ,মানসিক সুস্থতা, পরিবারের শান্তি সহ জীবনের মহামূল্য আরো অনেক কিছু। যে সন্তানকে নিয়ে বাবা-মা স্বপ্ন দেখেছিলেন চোখের সামনে তা এই ভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া তাঁরা সহ্য করতে পারছেন না। ফলে সন্তানের সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকরাও মনের স্বাভাবিকতা হারাতে বসেছেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ চরম অন্ধকারের দিকে চলে যাওয়া তারা কিছুতেই মানতে পারছেন না।

পাবজির ধ্বংসাত্মক আসক্তি থেকে সন্তানকে রক্ষা করতে প্রথম ও প্রধান ভূমিকা নিতে হবে বাবা-মাকে ই। অসম্ভব ধৈর্য ও ঠান্ডা মাথায় তাঁদের বিষয়টা আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এই খেলার ভয়ংকর দিক গুলো তাকে বারে বারে বোঝাতে হবে। প্রথমেই খেলা একবারে বন্ধ করলে হবে না। এতে তার মনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে, এমনকি হঠাৎ করে মারাত্মক কিছু করেও বসতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমে বাবা-মা সন্তানকে অনেকটা বেশি সময় দিন,যাতে সে গেম নিয়ে ভাবারই সময় না পায়। এই অবস্থায় বাবা-মায়ের সন্তানের উপর কড়া শাসনের চাবুক চালানো একদম অনুচিত । মনে রাখবেন সে কিন্তু ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত হয়ে আছে। তাই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ,আদর করে ,ভালোবেসে কাছে টেনে নিন। বাবা-মা চেষ্টা করুন তাকে দিয়ে বাড়ির ছোটখাটো কাজ করানো। এতে যদি সে আপত্তি জানায় জোর করবেন না। পরের দিন আপনাদের সঙ্গেই বাড়ির কোন কাজে নিয়োজিত করার চেষ্টা করুন। সেটা সফল হলে পাড়ার মুদিখানা দোকানে ছোটখাট জিনিস আনতে পাঠান। ইন্ডোর বা আউটডোরে যে খেলাই সে ভালোবাসে সেই খেলায় তাকে নিয়মিত করুন ; সম্ভব হলে আপনারা তার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকুন।তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলবেন, গল্প করবেন। ছোটবেলা থেকে সে যা যা ভালোবাসতো সেগুলি তার জীবনে নতুন করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। প্রতিদিন বিকেলে তাকে নিয়ে নিজের শহরের মধ্যে বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে যান। এতে তার মনটা অন্য দিকে মোড় নেবে। সম্ভব হলে সন্তানকে নিয়ে সে যেখানে ঘুরতে পছন্দ করে সেরকম জায়গায় দীর্ঘ ছুটিতে চলে যান। এতে করে পরিবেশ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক পরিবর্তন আসবে। এর ফলে ওই গেমের আসক্তি একটু একটু করে কমে আসবে।বাবা-মা সব সময় মনে থাকবে এর কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। এর চটজলদি কোন সমাধান নেই। একমাত্র আপনাদের অগাধ ধৈর্য ও সহনশীলতাই আপনার সন্তানকে একসময় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনবে।

যে পাবজি গেম শিশুর মস্তিষ্ক ধ্বংস করছে, মেধা শক্তি বিকল করে দিচ্ছে,তাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করছে, তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত ঘোর অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে——— এমন সহিংস্র ও ধ্বংসাত্মক গেম অনতিবিলম্বে সরকারি আইন করে বন্ধ করা উচিত। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে ও অঙ্কুরিত মেধা বিনষ্ট ঠেকাতে দেশের সরকারের সময় এসেছে এর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার । ইতিমধ্যে ভারতের বম্বে হাইকোর্ট ও গুজরাট পুলিশ এই পাবজি গেম বন্ধের নোটিশ জারি করেছেন। দিল্লির শিশু অধিকার রক্ষা কমিটি শিশুদের পক্ষে পাবজি ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করেছেন। এই পাবজি নিয়ে দেশের অভিভাবক- অভিভাবিকারা কতটা উদ্বিগ্ন সমাজের আনাচে কানাচে কান পাতলেই টের পাওয়া যায়।তাই তো সারাদেশের ভুক্তভোগী অভিভাবকদের করুণ আবেদনে সাড়া দিয়ে দেশের সরকার পাবজি গেমকে বে-আইনি ঘোষণা করুন সেটাই তাঁরা চাইছেন এবং দেশের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষার্থে কঠোর ভাবে সেই আইন বলবৎ করার চেষ্টা হোক।