Dhaka ১০:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভারতের মরণবাঁধ ফারাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৬ কোটি মানুষ

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৪:০৬:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
  • ৩৭ Time View

আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। পদ্মার উজানে ফারাক্কায় বাঁধ তৈরি করে গঙ্গার পানি একতরফা প্রত্যাহারের ভারতীয় ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের এ দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে এ লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি ফারাক্কা দিবস হিসাবেও পরিচিত। পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এ লংমার্চ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

দিবসটি উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে এক সংবাদ সম্মেলনে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের অন্তত ছয় কোটি মানুষ সেচ সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে খুলনা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমে গেছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত মরণবাঁধ ফারাক্কা চালুর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয়। গণমানুষের অধিকার আদায়ে অকুতোভয় বিপ্লবী মওলানা ভাসানী ভারতের আধিপত্যবাদী এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন তিনি। দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে মওলানা ভাসানীই প্রথম ফারাক্কায় বাঁধ দেওয়ার প্রতিবাদে তার চিরচেনা রূপে জ্বলে ওঠেন। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘পিন্ডির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব করতে নয়।’ তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চের ডাক দেন। পরিবেশ, প্রতিবেশ, নদী ও মানুষ বাঁচাতে তিনি দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দেশপ্রেমিক অগণিত মানুষ তার ডাকে সাড়া দেন। ভারতবিরোধী ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে প্রতিবাদী জনতার ঢল নামে। সেখান থেকেই মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ শুরু হয়। ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেদিন অগণিত জনতার বজ কণ্ঠের প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি দিল্লিতে পৌঁছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদের ঘটনা।

রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে জনতার পদযাত্রা শুরু হয় সকাল ১০টায়। জনতার স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলীতে পৌঁছায় দুপুর ২টায়। সন্ধ্যা ৬টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে এসে লংমার্চের যাত্রাবিরতি ঘটে। পরদিন সকাল ৮টায় পুনরায় যাত্রা শুরু হয়। লংমার্চকারীরা মহানন্দা নদী পার হন নৌসেতু তৈরি করে। এরপর ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হাইস্কুল মাঠে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানীর ডাকে লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ সমাবেশে যোগ দেন।

সমবেত জনতার উদ্দেশে সেদিন আপসহীন মওলানা ভাসানী বজ কণ্ঠে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না, কারও হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হলো, তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির রুখে দাঁড়ানোর জ্বলন্ত নজির।’

গবেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ ষোলো আনা সফল হয়েছিল। এই লংমার্চের পর ফারাক্কা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়। ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ভারত ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়।

ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস : পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ভারত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। উত্তরে ভারত ১৯৫২ সালে জানায়, গঙ্গার বাঁধ নির্মাণ এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই রয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারত প্রথম এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বসে। এ প্রক্রিয়া চলা অবস্থায়ই ১৯৬১ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। এভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগেই ১৯৭০ সালে ফিডার খাল ব্যতীত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করে ফেলে ভারত। বাংলাদেশের ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এ বাঁধটি অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ ২ হাজার ২৪০ মিটার লম্বা। প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় এ বাঁধ নির্মাণ করে ভারত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথমে ফিডার ক্যানেলে পানিপ্রবাহের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক চালুর কথা বলে মাত্র ৪১ দিনের জন্য (১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়। সেই পরীক্ষামূলক প্রত্যাহারই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতি : ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে অংশ নিয়েছিলেন রাজশাহীর নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ও রাজনীতিক মাহমুদ জামাল কাদেরী। ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী মহানগরীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব সিদ্দিকী।

সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের অন্তত ছয় কোটি মানুষ নানা সংকটে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীতে পানিশূন্যতা ও সেচ সংকটে বিপর্যস্ত হয়েছে কৃষি ও পরিবেশ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের আরও চার কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতির শিকার। তিনি বলেন, ফারাক্কার কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে পানির ঘাটতিতে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদুপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যার ফলে মাটির উর্বরতা কমে এসেছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের শতভাগ অগভীর নলকূপ এবং অনেক এলাকার গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে অনেক এলাকায় নলকূপের পানি পানযোগ্য নেই।

মাহবুব সিদ্দিকী আরও বলেন, বর্তমানে প্রতি শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-পদ্মা নদীর প্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে যায়। নদীর বুকে গরুর গাড়ি চলে, বালুবাহী ট্রাক চলে, অথচ পানি নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাহবুব বলেন, গঙ্গার আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পানি নেই বলে ইলিশ আর আসে না, ডলফিন আর ঘড়িয়াল বিলুপ্তপ্রায়। পাশাপাশি হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। সুন্দরবনের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে।

রাজশাহীতে লংমার্চ দিবসের কর্মসূচি : ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবসের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আজ রাজশাহীতে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিকাল ৩টায় রাজশাহী কলেজের সামনে থেকে র‌্যালিটি বের করবে ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। র‌্যালি শেষে বিকাল ৪টায় রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনে আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য দেবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Raj Kalam

ভারতের মরণবাঁধ ফারাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৬ কোটি মানুষ

Update Time : ০৪:০৬:০২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫

আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। পদ্মার উজানে ফারাক্কায় বাঁধ তৈরি করে গঙ্গার পানি একতরফা প্রত্যাহারের ভারতীয় ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের এ দিনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর আহ্বানে এ লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। দিনটি ফারাক্কা দিবস হিসাবেও পরিচিত। পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এ লংমার্চ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

দিবসটি উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে এক সংবাদ সম্মেলনে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের অন্তত ছয় কোটি মানুষ সেচ সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার কারণে খুলনা অঞ্চলে ধান উৎপাদন কমে গেছে। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।

জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত মরণবাঁধ ফারাক্কা চালুর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশে পরিলক্ষিত হয়। গণমানুষের অধিকার আদায়ে অকুতোভয় বিপ্লবী মওলানা ভাসানী ভারতের আধিপত্যবাদী এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন তিনি। দেশের রাজনীতিকদের মধ্যে মওলানা ভাসানীই প্রথম ফারাক্কায় বাঁধ দেওয়ার প্রতিবাদে তার চিরচেনা রূপে জ্বলে ওঠেন। দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘পিন্ডির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব করতে নয়।’ তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চের ডাক দেন। পরিবেশ, প্রতিবেশ, নদী ও মানুষ বাঁচাতে তিনি দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের দেশপ্রেমিক অগণিত মানুষ তার ডাকে সাড়া দেন। ভারতবিরোধী ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানে প্রতিবাদী জনতার ঢল নামে। সেখান থেকেই মরণবাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ শুরু হয়। ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেদিন অগণিত জনতার বজ কণ্ঠের প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি দিল্লিতে পৌঁছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদের ঘটনা।

রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে জনতার পদযাত্রা শুরু হয় সকাল ১০টায়। জনতার স্রোত গোদাগাড়ীর প্রেমতলীতে পৌঁছায় দুপুর ২টায়। সন্ধ্যা ৬টায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে এসে লংমার্চের যাত্রাবিরতি ঘটে। পরদিন সকাল ৮টায় পুনরায় যাত্রা শুরু হয়। লংমার্চকারীরা মহানন্দা নদী পার হন নৌসেতু তৈরি করে। এরপর ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট হাইস্কুল মাঠে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানীর ডাকে লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ সমাবেশে যোগ দেন।

সমবেত জনতার উদ্দেশে সেদিন আপসহীন মওলানা ভাসানী বজ কণ্ঠে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না, কারও হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হলো, তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির রুখে দাঁড়ানোর জ্বলন্ত নজির।’

গবেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ ষোলো আনা সফল হয়েছিল। এই লংমার্চের পর ফারাক্কা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাতারাতি একটি ইস্যুতে পরিণত হয়। ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় এনে ভারত ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি পাঁচসালা চুক্তি করতে বাধ্য হয়।

ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস : পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ভারত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। উত্তরে ভারত ১৯৫২ সালে জানায়, গঙ্গার বাঁধ নির্মাণ এখনো অনুসন্ধান পর্যায়েই রয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারত প্রথম এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বসে। এ প্রক্রিয়া চলা অবস্থায়ই ১৯৬১ সালে ভারত গোপনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। এভাবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগেই ১৯৭০ সালে ফিডার খাল ব্যতীত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ করে ফেলে ভারত। বাংলাদেশের ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এ বাঁধটি অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ ২ হাজার ২৪০ মিটার লম্বা। প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় এ বাঁধ নির্মাণ করে ভারত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত সরকার ফারাক্কা বাঁধ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথমে ফিডার ক্যানেলে পানিপ্রবাহের মাধ্যমে পরীক্ষামূলক চালুর কথা বলে মাত্র ৪১ দিনের জন্য (১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে) ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হয়। সেই পরীক্ষামূলক প্রত্যাহারই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতি : ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে অংশ নিয়েছিলেন রাজশাহীর নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী ও রাজনীতিক মাহমুদ জামাল কাদেরী। ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী মহানগরীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিটির আহ্বায়ক মাহবুব সিদ্দিকী।

সংবাদ সম্মেলনে মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের অন্তত ছয় কোটি মানুষ নানা সংকটে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীতে পানিশূন্যতা ও সেচ সংকটে বিপর্যস্ত হয়েছে কৃষি ও পরিবেশ। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি এবং দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের আরও চার কোটি মানুষ সরাসরি ক্ষতির শিকার। তিনি বলেন, ফারাক্কার কারণে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পে পানির ঘাটতিতে ৬৫ শতাংশ এলাকায় সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উজান থেকে স্বাদুপানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে, যার ফলে মাটির উর্বরতা কমে এসেছে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের শতভাগ অগভীর নলকূপ এবং অনেক এলাকার গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। আর্সেনিক দূষণের কারণে অনেক এলাকায় নলকূপের পানি পানযোগ্য নেই।

মাহবুব সিদ্দিকী আরও বলেন, বর্তমানে প্রতি শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-পদ্মা নদীর প্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে যায়। নদীর বুকে গরুর গাড়ি চলে, বালুবাহী ট্রাক চলে, অথচ পানি নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি উল্লেখ করে মাহবুব বলেন, গঙ্গার আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পানি নেই বলে ইলিশ আর আসে না, ডলফিন আর ঘড়িয়াল বিলুপ্তপ্রায়। পাশাপাশি হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। সুন্দরবনের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে।

রাজশাহীতে লংমার্চ দিবসের কর্মসূচি : ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবসের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আজ রাজশাহীতে র‌্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বিকাল ৩টায় রাজশাহী কলেজের সামনে থেকে র‌্যালিটি বের করবে ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটি। র‌্যালি শেষে বিকাল ৪টায় রাজশাহী কলেজ মিলনায়তনে আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য দেবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।