Dhaka ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০৯ এপ্রিল ২০২৫, ২৬ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জামাই ষষ্ঠীর সুলুক-সন্ধান : বিনোদ সরদার

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৩:৪৯:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুন ২০২১
  • ২৯৫ Time View

মিষ্টির হাঁড়ি হাতে ফিনফিনে সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি আর মালকোচা মারা ধুতিতে শ্বশুরঘর আলো করা জামাই বাবাজি।

পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো জামাইয়ের পাত। আম-কাঁঠাল, ইলিষের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে ভুরিভোজ ৷ আর তার আগে জামাইকে পাখা হাওয়া আর শান্তি জলের ছিটা দেওয়া! এমনকী, মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ বলে জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে দেওয়া! ‘জামাইষষ্ঠী’ বললেই যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৷ এতো তাই-ই ৷ তবে, মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্কটা কী এ প্রশ্ন উঠতে পারে ৷ মনের মাঝে উঁকি দিতে পারে এ সম্পর্কে শাস্ত্র কী বলছে ও জেনে নেওয়া যাক সামাজিক বিশ্লেষণ।

একান্নবর্তী পরিবার আজ হাতোগোনা বিষয়। ক্রমশ ছিঁড়ে যাচ্ছে আত্মীয়তার আদি নাড়ি। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার চর্চা চলছে অহরহ। তবু কিছু সামাজিক প্রথা বা রীতি এখনও গুরুত্ব হারায়নি। এত ভাঙনের মধ্যেও জামাইষষ্ঠীর মতো প্রথা বেঁধে বেঁধে থাকার কথাই বলে।

ইতিহাসে বার বার দেখা যায়, যুগের প্রয়োজনে সমাজ কী ভাবে পুরনো আচার-অনুষ্ঠানগুলি সংশোধিত করে নেয়। ষষ্ঠী সন্তানের কল্যাণের জন্য পালনীয় একটি ব্রত, কন্যার ভবিষ্যত্‌ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাঙালি মা অন্তত একটি ষষ্ঠীকে পালটে নিয়েছেন, জামাইয়ের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন করেছেন। নাম তার জামাই ষষ্ঠী।
যদি ও বা এটি বাবু কালচার ছিল। বর্তমানে সামর্থ্য থাকলেই বাঙালি হিন্দুদের সব ঘরেই চলছে এমনকি মুসলমান পরিবারে সংস্কৃতি টি ঢুকে পড়েছে আবার অবাঙালি সমাজে ও ঢুকে পড়েছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রকমফের হয়েছে যুগে যুগে। নারী আর অন্তঃপুরবাসিনী নন। নিজের বাড়ি যা যাওয়ার জন্য তাঁদের এখন আর তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় না। আগে এমনটা ছিল না। তখন জামাইদের ঘনঘন যাতায়াতের রেওয়াজ ছিল না শ্বশুরবাড়িতে। আর সেই আদি কাল থেকেই জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ির টান ছিল আলাদা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিশেষ দিনগুলিকে বিশেষ মাহাত্ম্যে উদ্‌যাপন করার চল রয়েছে। জামাইষষ্ঠী তেমনই একটি দিবসের উদ্‌যাপন, যা আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ভাবনা।

মা ষষ্ঠী নিছক বাংলার এক গ্রামদেবী নন, শীতলা ও মনসার মতোই তিনিও ভারতের নানা অঞ্চলে পূজিত হন। এক শতাব্দী আগে উইলিয়ম ক্রুক লিখেছিলেন, ‘লোকসমাজে প্রচলিত নানা প্রথা ও রীতি নিয়ে যত চর্চা করা যায়, ততই হিন্দুধর্মের উত্‌সের কাছে পৌঁছনো যায়।’
আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকায়ত ধর্ম নিয়ে বিস্তর কাজ করেছিলেন। তাঁর মতে, ষষ্ঠী হলেন প্রসূতি এবং শিশুর রক্ষয়িত্রী। অন্য দিকে, নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসের পণ্ডিত সুধীর রঞ্জন দাস এই অভিভাবক দেবীর জনজাতীয় উত্‌সের সন্ধান করেছিলেন। আবার হরপ্পাতেও প্রাগৈতিহাসিক এমন দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে, যা দেখে নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেছেন, সিন্ধু সভ্যতাতেও ষষ্ঠীর আরাধনা চলত। এটা মানলে তো আমরা সোজা চার হাজার বছর পিছিয়ে যেতে পারি এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো লোভী জামাইদের এই গ্রাম্য দেবীটিকে আর একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখা উচিত। তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সন্তান জন্মের সঙ্গে প্রাচীন লোকবিশ্বাসে ‘ম্যাজিক’-এর যে যোগাযোগ ছিল, ষষ্ঠীর পুজো তার অনুসারী। জন মারডক, সি এইচ বাক-এর মতো গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কী ভাবে মেয়েরা ষষ্ঠী বা তাঁর অনুরূপ দেবীর আরাধনা করতেন। উইলিয়ম জোনস নাকি এই রীতির সঙ্গে প্রাচীন ইউরোপের লোকাচারের মিল দেখে চমত্‌কৃত হয়েছিলেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Raj Kalam

Popular Post

জামাই ষষ্ঠীর সুলুক-সন্ধান : বিনোদ সরদার

Update Time : ০৩:৪৯:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুন ২০২১

মিষ্টির হাঁড়ি হাতে ফিনফিনে সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি আর মালকোচা মারা ধুতিতে শ্বশুরঘর আলো করা জামাই বাবাজি।

পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো জামাইয়ের পাত। আম-কাঁঠাল, ইলিষের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে ভুরিভোজ ৷ আর তার আগে জামাইকে পাখা হাওয়া আর শান্তি জলের ছিটা দেওয়া! এমনকী, মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদ বলে জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে দেওয়া! ‘জামাইষষ্ঠী’ বললেই যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৷ এতো তাই-ই ৷ তবে, মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্কটা কী এ প্রশ্ন উঠতে পারে ৷ মনের মাঝে উঁকি দিতে পারে এ সম্পর্কে শাস্ত্র কী বলছে ও জেনে নেওয়া যাক সামাজিক বিশ্লেষণ।

একান্নবর্তী পরিবার আজ হাতোগোনা বিষয়। ক্রমশ ছিঁড়ে যাচ্ছে আত্মীয়তার আদি নাড়ি। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার চর্চা চলছে অহরহ। তবু কিছু সামাজিক প্রথা বা রীতি এখনও গুরুত্ব হারায়নি। এত ভাঙনের মধ্যেও জামাইষষ্ঠীর মতো প্রথা বেঁধে বেঁধে থাকার কথাই বলে।

ইতিহাসে বার বার দেখা যায়, যুগের প্রয়োজনে সমাজ কী ভাবে পুরনো আচার-অনুষ্ঠানগুলি সংশোধিত করে নেয়। ষষ্ঠী সন্তানের কল্যাণের জন্য পালনীয় একটি ব্রত, কন্যার ভবিষ্যত্‌ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাঙালি মা অন্তত একটি ষষ্ঠীকে পালটে নিয়েছেন, জামাইয়ের জন্য ভূরিভোজের আয়োজন করেছেন। নাম তার জামাই ষষ্ঠী।
যদি ও বা এটি বাবু কালচার ছিল। বর্তমানে সামর্থ্য থাকলেই বাঙালি হিন্দুদের সব ঘরেই চলছে এমনকি মুসলমান পরিবারে সংস্কৃতি টি ঢুকে পড়েছে আবার অবাঙালি সমাজে ও ঢুকে পড়েছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রকমফের হয়েছে যুগে যুগে। নারী আর অন্তঃপুরবাসিনী নন। নিজের বাড়ি যা যাওয়ার জন্য তাঁদের এখন আর তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় না। আগে এমনটা ছিল না। তখন জামাইদের ঘনঘন যাতায়াতের রেওয়াজ ছিল না শ্বশুরবাড়িতে। আর সেই আদি কাল থেকেই জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ির টান ছিল আলাদা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিশেষ দিনগুলিকে বিশেষ মাহাত্ম্যে উদ্‌যাপন করার চল রয়েছে। জামাইষষ্ঠী তেমনই একটি দিবসের উদ্‌যাপন, যা আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ভাবনা।

মা ষষ্ঠী নিছক বাংলার এক গ্রামদেবী নন, শীতলা ও মনসার মতোই তিনিও ভারতের নানা অঞ্চলে পূজিত হন। এক শতাব্দী আগে উইলিয়ম ক্রুক লিখেছিলেন, ‘লোকসমাজে প্রচলিত নানা প্রথা ও রীতি নিয়ে যত চর্চা করা যায়, ততই হিন্দুধর্মের উত্‌সের কাছে পৌঁছনো যায়।’
আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকায়ত ধর্ম নিয়ে বিস্তর কাজ করেছিলেন। তাঁর মতে, ষষ্ঠী হলেন প্রসূতি এবং শিশুর রক্ষয়িত্রী। অন্য দিকে, নৃতত্ত্ব ও ইতিহাসের পণ্ডিত সুধীর রঞ্জন দাস এই অভিভাবক দেবীর জনজাতীয় উত্‌সের সন্ধান করেছিলেন। আবার হরপ্পাতেও প্রাগৈতিহাসিক এমন দেবীমূর্তি পাওয়া গেছে, যা দেখে নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেছেন, সিন্ধু সভ্যতাতেও ষষ্ঠীর আরাধনা চলত। এটা মানলে তো আমরা সোজা চার হাজার বছর পিছিয়ে যেতে পারি এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো লোভী জামাইদের এই গ্রাম্য দেবীটিকে আর একটু শ্রদ্ধার চোখে দেখা উচিত। তবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, সন্তান জন্মের সঙ্গে প্রাচীন লোকবিশ্বাসে ‘ম্যাজিক’-এর যে যোগাযোগ ছিল, ষষ্ঠীর পুজো তার অনুসারী। জন মারডক, সি এইচ বাক-এর মতো গবেষকরা দেখিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কী ভাবে মেয়েরা ষষ্ঠী বা তাঁর অনুরূপ দেবীর আরাধনা করতেন। উইলিয়ম জোনস নাকি এই রীতির সঙ্গে প্রাচীন ইউরোপের লোকাচারের মিল দেখে চমত্‌কৃত হয়েছিলেন।