প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বলেছেন, বাংলাদেশ-ভূটান পিটিএ পারস্পরিক স্বার্থের দিক দিয়ে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুসংহত করবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ উভয় পক্ষের স্বাক্ষরিত অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) আমাদের দু’দেশের সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখবে।’ সেক্ষেত্রে পরবর্তী ৫০ বছর আমাদের অঞ্চলের নাগরিকদের টেকসই উন্নয়ন এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ প্রত্যক্ষ করবে, বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি গণভবন থেকে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ভূটানের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন সময় এসেছে যে আমরা পারস্পরিক সুবিধার জন্য এবং আমাদের নাগরিকদের সামগ্রিক উন্নতি ও কল্যাণের জন্য আমাদের অসাধারণ সম্পর্ককে আরও বেশি অর্থবহ করে তুলি।’
তিনি বলেন, এই চেতনায় আমরা আজ ভূটানের সঙ্গে পিটিএতে স্বাক্ষর করেছি। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এবং ভূটান থেকে বিস্তৃত পণ্য একে অপরের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে। চুক্তিতে পারস্পরিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে অতিরিক্ত তালিকা অন্তর্ভুক্ত করারও বিধান রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেননা আমরা বিশ্বের কোন দেশের সঙ্গে আমাদের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর করছি। আর ভূটানই প্রথম দেশ যেটি একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভূটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং সেদেশের রাজধানী থিম্পু থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। রাজধানীর বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মূল অনুষ্ঠানের অন্যপ্রান্তে ভূটানও সংযুক্ত ছিল।
বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এবং ভূটানের অর্থমন্ত্রী লিয়নপো লোকনাথ শর্মা নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভোম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া ভুটানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তির এই দিনটিকেই শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা স¤প্রসারণের লক্ষ্যে দুই দেশ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের দিন হিসেবে বেছে নেয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ভূটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্ডি দরজি এবং অর্থমন্ত্রী লিয়নপো লোকনাথ শর্মা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশের বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প এবং বিনিযোগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম, বাংলাদেশে ভূটানের রাষ্ট্রদূত কুসাব রিনচেন কিউয়েনটিল অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশ প্রান্তের চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে এবং ভূটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত একেএম শহিদুল করিম থিম্পু প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-ভূটান সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে উভয় প্রধানমন্ত্রী একযোগে একটি লোগো উম্মোচন করেন এবং পৃথক কেক কাটেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই চুক্তির ফলে ভূটান তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত কৃষি পণ্য এবং ইলেকট্রনিক্সসহ ১০০টি বিভিন্ন বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে শুল্ক সুবিধা প্রদান করতে সম্মত হয়েছে। অন্যদিকে, ফলমূলসহ ৩৪ টি ভূটানের পণ্য বাংলাদেশে একই সুবিধা পাবে। পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে আরও পণ্য দু’দেশের তালিকায় সংযুক্ত করা হবে। এ চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক পিটিএ এবং এফটিএ স্বাক্ষরের যাত্রা শুরু হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কেননা আমরা বিশ্বের যে কোনও দেশের সাথে আমাদের প্রথম পিটিএ স্বাক্ষর করছি। আর ভূটানই প্রথম দেশ যা একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরে একটি সার্বভৌম এবং স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’
তিনি বলেন, এই দিনে আমরা ভূটানের কাছ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ-ভূটান সম্পর্ক উদযাপন করতে যাচ্ছি। এই বছরটি আশীর্বাদযুক্ত, কেননা আমরা আমাদের জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছি এবং জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক-এর ও ৪০ তম জন্মবার্ষিকী।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূটানের ৩য় রাজা এবং জনগণের অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, প্রকৃতপক্ষে, সমস্ত বাংলাদেশের হৃদয়ে ভুটানের একটি বিশেষ অবস্থান এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি স্থায়ী জায়গা রয়েছে। রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আপনার দেশের স্বীকৃতি আজও আমাদের হৃদয়কে ব্যাপক আবেগ তাড়িত করে তোলে।
১৯৭১ সালের এই দিনে ভূটানের স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনার স্মৃতিরোমন্থন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁরা তখন রাজধানীর একটি একতলা বাড়িতে তিন মাসের শিশু সজিব ওয়াজেদ জয় এবং শিশু রাসেলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে বন্দি, বাবা বন্দি পাকিস্তানে। শেখ কামাল এবং শেখ জামাল পালিয়ে তখন মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছে। এমন অবস্থায় সেদিন মেঝেতে বসে ছিলেন তখনই এই সংবাদটি তাঁরা পান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘মুহূর্তেই আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট ভূলে গেলাম, আমরা চিৎকার- চেচাঁমেচি, হুল্লোড় এবং কান্না জুড়ে দিলাম। যা আমি কখনও ভূলতে পারবো, না। দীর্ঘসময় বন্দি অবস্থায় কাটানোর পর এটি এমনই একটা ঘটনা ছিল।’
‘এটি এমন একটি উৎসাহ ব্যঞ্জক, প্রেরণাদায়ক এবং আনন্দময় ঘটনা ছিল যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না,’ বলেন তিনি। সেদিনের ঘটনার স্বাক্ষী তিনি এবং বোন রেহানা এবং পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ছাড়া ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরিবারের সকলে নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়।
একাত্তরের সেই বিশেষ দিনটির কথা স্মরণ করে তিনি বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘সেই দিনটি আমাদের পরিবার এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বিশেষ দিন ছিল। কাজেই, ভূটান আমাদের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে, এর বেশি আর আমি বলতে পারবো না।’
বাংলাদেশ ও ভূটানের যোগসূত্রকে ‘অত্যন্ত প্রাচীন’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, সাধারণ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আজ আমাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলি বাণিজ্য, পর্যটন, জলবিদ্যুৎ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, স্বাস্থ্য, জীব-বৈচিত্র, কৃষি-প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষি, আইসিটি, শিক্ষা, জল সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে।