নিজস্ব প্রতিবেদক: চেক ডিজঅনার মামলায় বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি দূর করতে যুগান্তকারী রায় প্রকাশ করেছেন আপিল বিভাগ। আদালত বলেছেন, চেকের বৈধ বিনিময় প্রমাণে ব্যর্থ হলে এ সংক্রান্ত মামলায় কোনো ব্যক্তিকে সাজা নয়। অর্থাৎ, চেক ডিজঅনার মামলায় কনসিডারেশন বা চেক প্রাপ্তির বৈধ কারণ প্রমাণ করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ আজ বুধবার প্রায় ২০ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করেছেন। চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত এক আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করে রায় ঘোষণা করা হয়েছিল।
এ মামলার অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ মাসুদ রায় প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, আগে চেক ডিজঅনার হলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চেকদাতার সাজা হতো। চেকমূলে চেক গ্রহীতার টাকা পাওয়ার কোনো কারণ রয়েছে কি না, সেটি দেখার বাধ্যবাধকতা বা দিকনির্দেশনা ছিল না। এখন থেকে চেক গ্রহীতাকে প্রমাণ করতে হবে যে চেকদাতা ও চেক গ্রহীতার মধ্যে লেনদেন সম্পর্কিত কোনো বৈধ চুক্তি ছিল। চেক প্রাপ্তির বৈধ কোনো কারণ প্রমাণ করতে না পারলে এখন আর চেকদাতার সাজা হবে না।
ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের ফলে চেক দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে চেকের বৈধ বিনিময় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে হবে। চেকের বৈধ বিনিময় প্রমাণে ব্যর্থ হলে চেকের মামলায় কোনো ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের এ রায়ের ফলে চেক দাতারা তাঁদের নির্দোষ প্রমাণের একটা সুযোগ পেলেন। এ ছাড়া এ রায়ের ফলে চেক-সংক্রান্ত মামলায় বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি ও হয়রানি কমবে।
এর আগে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত এক আপিল আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়।
জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার প্রয়াত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরীর ছোট ভাই, সাবেক কূটনীতিক কায়সার রশিদ চৌধুরীর স্ত্রী (মৃত) সামছি খানমের মালিকানাধীন নর্থ গুলশানে ৩০ কাঠা জমি ১৯৭৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সম্পাদিত ইজারা চুক্তিমূলে আমেরিকান দূতাবাসকে ১১০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। যেহেতু ওই ইজারা চুক্তিটি নিবন্ধন (রেজিস্ট্রি) করা হয়নি এবং বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে মৃত সামছি খানমের উত্তরাধিকারগণ (ইমরান রশিদ চৌধুরী, পারভেজ রশিদ চৌধুরী ও জিনাত রশিদ চৌধুরী) জমিটি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন।
বিষয়টি জানতে পেরে আবুল কাহের শাহিন নামের এক ব্যক্তি ইমরান রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং জমিটির বর্তমান বাজারমূল্য ১৫০ কোটি টাকায় কিনতে আগ্রহী ক্রেতা রয়েছে এবং তিনি তা বিক্রি করে দিতে পারবেন। ইমরান রশিদ চৌধুরী ওই আশ্বাসের ভিত্তিতে সরল বিশ্বাসে ২০১২ সালের ১৩ মার্চ শাহিনের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন। এ চুক্তির শর্তানুযায়ী, ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে বর্তমান বাজারমূল্যে জমিটি বিক্রি করে দেবেন এবং তার জন্য শাহিন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ১৩ শতাংশ টাকা পাবেন। তখন ইমরান রশিদ চৌধুরী পোস্ট ডেটেড চার কোটি ৫০ লাখ টাকার চারটি চেক আবুল কাহের শাহিনের নামে ইস্যু করেন। কিন্তু ৯০ দিন পার হওয়ার পরও শাহিন বর্তমান বাজার মূল্যে কোনো ক্রেতা জোগাড় করতে ব্যর্থ হন। ফলে চুক্তিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ২০১২ সালের ১৬ আগস্ট জমিটির ইজারা গ্রহীতা আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে মালিকরা একটি বায়না চুক্তি সম্পাদন করেন এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের ৩ জুলাই বিক্রয়পূর্বক দলিল সম্পাদন করেন। এরপর শাহিনকে চেকগুলো ফেরত দিতে বলেন।
এদিকে আবুল কাহের শাহিন ওই পোস্ট ডেটেড চেক চারটি ফেরত না দিয়ে নিজে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার ফন্দি করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি চেক চারটি নগদায়নের জন্য ব্যাংকে উপস্থাপন করেন। ইতোমধ্যে ইমরান রশিদ চৌধুরী শাহিনকে দেওয়া চেকগুলো সম্পর্কে ব্যাংকে ‘স্টপ পেমেন্ট ইন্সস্ট্রাকশন’ দিয়ে রাখলে সেগুলো যথারীতি ডিজঅনার হয়। তারপর শাহীন সিলেটের আদালতে চেক ডিজঅনারের মামলা করে তাঁর পক্ষে রায় পান।
ইমরান রশিদ চৌধুরী ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে ফৌজদারি আপিল দায়ের করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ শুনানি শেষে আপিল মঞ্জুর করে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট রায় দেওয়ার মাধ্যমে ইমরান রশিদ চৌধুরীকে মামলার অভিযোগ থেকে খালাস দেন। এতে আবুল কাহের শাহিন ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ১ নম্বর আদালত দীর্ঘ শুনানি শেষে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ওই আপিল (আপিল নং ৬৩/৬৪/৬৫/৬৬/২০১৭) খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।