ভোলা জেলার মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগর কন্যা মনপুরা উপজেলা। এখানে নদী আর সাগরের মিতালীর অপরূপ সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনপুরার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে চিন্তানিবাস গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এখানকার সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি। নীল জলরাশির সমুদ্র সৈকত, মায়া হরিণের সৌন্দর্য, ঝাঁকে-ঝাঁকে পাখিদের উড়ে বেড়ানো, নদীর বুকে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য যে কারও মন ভোলায়।
জানা যায়, জেলা সদর থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ পুর্ব দিকে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে মেঘনার মোহনায় ৪ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত মনপুরা উপজেলা প্রায় দেড় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। অতি প্রাচীন দ্বীপটি এক সময় পুর্তগীজদের আস্তানা ছিল। যার নিদর্শন এখনও বয়ে বেড়ায় এখানকার লোমশ কুকুর। মনপুরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সারিসারি ম্যনগ্রোভ বনাঞ্চল। এখানকার ছোট বড় ৮-১০ টি চরে বন বিভাগের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে সবুজের বিপ্লব। শীত মৌসুমে শত-শত অতিথি পাখির কলতানে মুখরিত থাকে এসব চরাঞ্চল। এই চরগুলো হলো চর তাজাম্মুল, চর পাতালিয়া, চর পিয়াল, চর নিজাম, চর সামসুউদ্দিন, লালচর, ডাল চর, কলাতলীর চর ইত্যাদি।
সরেজমিনে মনপুরার বিভিন্ন স্থান ঘুরে ও সেখানকার মানুষের সাথে আলাপ করে জানা যায়, মনপুরা শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও দর্শনীয় জায়গা হিসেবে পরিচিত। যে কোন মানুষ কাজে অথবা ভ্রমণে এসে এখানকার রূপে মুগ্ধ হয়ে ভালোবেসে ফেলেছেন। এখানে না এলে বোঝার উপায় নেই সবুজের দ্বীপ মনপুরায় লুকায়িত আছে কি সৌন্দর্য আর পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। কি এক মায়াজালে পর্যটক আর ভ্রমণ পিপাসুদের আটকে দেয় ৮ শত বছরের পুরানো এ দ্বীপটি। এখানে কাক ডাকা ভোরে নদীর বুক চিরে লাল টুকটুকে সূর্য হাসতে-হাসতে যেমন তার দিন শুরু করে, তেমনি শেষ বিকেলে মেঘের হাত ধরে টুপ করেই ডুব দেয় নদীর জলে। অর্থাৎ এখান থেকে একই সাথে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা সম্ভব। এসব অপার সম্ভাবনাকে পুঁজি করে মনপুরায় সম্প্রতি গড়ে উঠেছে ‘মনপুরা সী-বীচ’। আর ঐ পর্যটন কেন্দ্রটি এখন ভ্রমণ পিপাসুদের বাড়তি আকর্ষণ হয়ে দাড়িয়েছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এখানে বিশেষ কিছু খাবার রয়েছে। তার মধ্যে শীতের হাঁস, মহিষের কাচা টক দই, টাটকা ইলিশ, বড় কইমাছ, মাগুর, কোরাল, বোয়াল ও গলদা চিংড়ি অন্যতম। মেঘনা নদীর টাটকা ইলিশ আর চরের মহিষের কাঁচা দুধের স্বাদ এনে দিতে পারে ভিন্ন এক অনুভূতি।
মনপুরার নামকরণ নিয়ে জানা যায়, জনৈক মনগাজি নামের ব্যক্তি সে সময়ের জমিদার থেকে মনপুরার জমি বন্দোবস্ত নেন অষ্ঠাদশ শতাব্দীর মধ্য যুগে। এখানে বেশ ভালই ছিলেন তিনি। কোন এক সময় মনগাজি বাঘের থাবায় প্রাণ হারালে তখন তার নামানুসারে দ্বীপটির নাম করণ হয় মনপুরা। তবে স্থানীয়দের মতে, এখানকার খাঁটি দুধ খেয়ে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলা দেখে মানুষের মন ভরে যেত। এ জন্য এর নামকরণ করা হয় মনপুরা। তবে মনপুরার নামকরণ নিয়ে এখনও নানা মতভেদ রয়েছে।
১৮৩৩ সালে মনপুরাকে ভোলা জেলার অধীনে স্থাায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সালে মনপুরাকে উপজেলায় রুপান্তরিত করা হয়। এভাবে এগিয়ে যায় আজকের মনপুরা। আয়তন ৩৭ হাজার ৩১৯ বর্গ মিটার। ইউনিয়ন ৪টি, গ্রাম ৩৮ টি, জনসংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষাধিক। কৃষি জমি ৩০ হাজার ৫০৪ একর। বনায়ন ১১ হাজার ১১৯ বর্গমিটার। রাস্তার দুই পাশে বনায়ন ১০০ কিলোমিটার।
এখানে প্রধান সমস্যা যোগাযোগ ব্যাবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে রুটিন মাফিক। প্রতিদিন ঢাকা থেকে একটি লঞ্চ বিকাল সাড়ে ৫টা, আরেকটি লঞ্চ সাড়ে ৬ টায় হাতিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে মনপুরা হয়ে পরদিন সকাল ৯টার সময় হাতিয়া পৌঁছে। ঐ লঞ্চ ২টি আবার হাতিয়া থেকে ছাড়ে দুপুর ১২ টায় আরেকটি ১টায়। মনপুরাতে আসে দুপুর ১ টায় আরেকটি ২টায় এবং ১ ঘণ্টা যাত্রা বিরতি থাকে রামনেওয়াজ লঞ্চঘাটে। মনপুরার মানুষ যে লঞ্চে করে ঢাকা থেকে মনপুরা আসেন আবার ঐ লঞ্চে করে ঢাকায় চলে যান।
এ ছাড়া ঢাকা কিংবা বরিশাল থেকে ভোলা হয়ে তজুমুদ্দিন সি-ট্রাক ঘাট থেকে মনপুরা যাওয়া যায়। সী-ট্রাকটি প্রতিদিন সকাল ১০ টায় মনপুরা হাজীর হাট ঘাট থেকে ছেড়ে দুপুর ১২টায় তজুমদ্দিন সী-ট্রাক ঘাটে পৌঁছে। আবার ঐ দিন বিকেল ৩ টায় তজুমদ্দিন সী-ট্রাক ঘাট থেকে ছেড়ে সন্ধা ৬ টায় মনপুরা হাজীর হাট সী-ট্রাক ঘাটে পৌঁছে। অপরদিকে চরফ্যাসনের বেতুয়া ঘাট থেকে মনপুরার সাকুচিয়া জনতা বাজার রুটে প্রতিদিন ২ টি লঞ্চ চলাচল করে। এ ছাড়া প্রতিদিন সাকুচিয়া থেকে রামনেওয়াজ হয়ে আলেকজেন্ডারের উদ্দেশ্যে একটি লঞ্চ ছেড়ে যায়। ঐ রুটেও প্রতিদিন শত-শত মানুষ আসা-যাওয়া করে। তবে আশার কথা হচ্ছে দিন-দিন এখানকার যোগাযোগ ব্যাবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
মনপুরাতে ভালো মানের পর্যটন হোটেল গড়ে উঠেছে। সরকারিভাবে জেলা পরিষদের অর্থায়নে আধুনিক ৪ তলাবিশিষ্ট ডাক বাংলো রয়েছে। বেসরকারিভাবে তজুমদ্দিন রুটে এবং চরফ্যাশন মনপুরা রুটে স্প্রীডবোট সার্ভিস চালু আছে। পর্যটকরা কম সময়ে মনপুরা আসতে পারবেন। মনপুরায় ভাল মানের আরও হোটেল গড়ে উঠলে পর্যটকদের আগমন বাড়বে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধার ব্যাবস্থা করলে মনপুরা হতে পারে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।
মনপুরার মানুষ অতিথি পরায়ন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে যে কাউকে আপন করে নেয়। এখানকার মানুষ কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। মনপুরার শতকরা ৮০% লোক কৃষক ও মৎস্যজীবী।
মনপুরার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল লতিফ ভুইয়া জানান, এখানকার অপার সম্ভাবনা নিয়ে মানুষ তেমন ভাবছেন না। এখানকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। তাছাড়া শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে এ দ্বীপের মানুষ দেশের মূলধারা থেকে অনেকটা পিছিয়ে আছে। তবে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে এখানে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা সম্ভব।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন জানান, মনপুরাকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করার পাশাপশি সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগের বিনোদনের ব্যাবস্থা করলে মনপুরা হতে পারে আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র।
মনপুরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্বে থাকা চরফ্যাসন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘এ দ্বীপটি ভোলা জেলার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নানা উপকরণ ছড়িয়ে আছে এ দ্বীপে, মনপুরার অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা, ভাল মানের হোটেল, যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতিসহ বিভিন্ন সুবিধা বাড়াতে পারলে মনপুরা হতে পারে পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান।’
(বাসস)