Dhaka ০১:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫, ২২ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

খাবারের অভাবে কঙ্কালসার হয়ে গেছে গাজার শিশুরা

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৫:৪৭:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫
  • 34

খাবারের অভাবে কঙ্কালসার হয়ে গেছে গাজার শিশুরা। গাজা উপত‌্যকা, মধ‌্যপ্রাচ‌্যের এমন এক টুকরো ভূমি যেখানে জন্মই যেন হয়ে উঠেছে আজন্ম পাপ। শিশুর জন্মে পরিবারে যেখানে আনন্দ নেমে আসে কিন্তু গাজায় একটি শিশু জন্মালে প্রথমেই তার বাবা-মাকে চিন্তা করতে হয়—এই শিশুটিকে কী খাওয়াব? কখন যেন বোমার আঘাতে মারা যায় শিশুটি—সেই দুশ্চিন্তায় তটস্থ হয়ে থাকে তাদের মন।

টানা যুদ্ধে গাজার প্রাণহানি বিশ্ববাসীর চোখ এড়ায়নি। তবে আগ্রাসনের নতুন কৌশল হিসেবে ইসরায়েল যখন গাজায় খাবারসহ মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়, তখন বিশেষজ্ঞরা বারবার যে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন, আজ তা বাস্তব। শুধু তাই নয়, গাজার ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে খাবারকে মানুষ মারার কৌশল হিসেবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে ইসরায়েলি বাহিনী।

এর এসবের মধ্যে সবচেয়ে করুণ দশায় রয়েছে একেকটি নতুন প্রাণ। সেখানকার শিশুদের অবস্থার ভয়বহতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক ডাক্তার বলেন, ‘ওরা শুধু চামড়া ও হাড্ডিসার হয়ে গেছে।’

বর্তমানেও উপত্যকায় মানবিক সহায়তার প্রবেশ সীমিত করে রেখেছে ইসরায়েল। ফলে খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতির কারণে শত শত শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন গাজার চিকিৎসকরা।

খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আহমদ আল-ফাররা দ‌্য গার্ডিয়ানকে বলেন, তার ওয়ার্ডে মাত্র সপ্তাহখানেকের শিশুখাদ্য অবশিষ্ট আছে। ইতোমধ্যেই প্রি-ম্যাচিউর (অকালে জন্মানো) শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট করা বিশেষ ফর্মুলা (খাবার) শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে নবজাতকদের জন‌্য বাধ্য হয়ে সাধারণ শিশুখাদ‌্যই ব্যবহার করছেন তারা।

তিনি বলেন, ‘কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো ফর্মুলা (শিশুখাদ‌্য) আছে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের বাইরেও অনেক শিশু আছে, যাদের জন্য কোনো দুধই নেই। ভয়াবহ ব্যাপার চলছে এখানে।’

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রায় সম্পূর্ণভাবে সহায়তা বন্ধ করে রাখায় গাজায় শিশুখাদ্যের মজুদ ক্রমেই কমছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গাজা হিউম‌্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) সীমিত পরিসরে খাদ্য সহায়তা দিলেও তাতে শিশুখাদ্য থাকে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

পাঁচ সন্তানের জননী ২৭ বছর বয়সী হানাআ আল-তাওয়িল বর্তমানে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন। এই নারী জানান, তিনি নিজেই পর্যাপ্ত খাবার পান না। তাই নিজের সন্তানের জন্য বুকের দুধও তৈরি হচ্ছে না। ১৩ মাস বয়সী সন্তানের জন্য তাই শিশুখাদ্য খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন এই মা।

হানাআ বলেন, ‘ছেলের জন্মের পর থেকেই দুধের সমস্যা শুরু হয়। আমার অপুষ্টি ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে জন্মের পর থেকেই আমি ওকে ঠিকমতো স্তন্যদান করতে পারিনি।’

অপুষ্টির কারণে তার ছেলের বিকাশ পিছিয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তিনি নিজেও লক্ষ‌ করেছেন, তার অন‌্য সন্তানরা এই বয়সে হাঁটতে ও কথা বলতে শুরু করলেও এই শিশুটি তা করতে পারছে না।
একরাশ হতাশা ও কষ্ট নিয়ে হানাআ বলেন, ‘যখন সে ঘুমায়, পাশে এক টুকরো রুটি রেখে দিই। কারণ প্রায়ই সে রাতে জেগে উঠে খাবারের জন্য কাঁদে। সারাক্ষণ অসহনীয় দুঃখ ও আশঙ্কা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ভাবি—আমার সন্তানরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শেষ পর্যন্ত মারা যাবে না তো!’

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৬ ফিলিস্তিনি শিশু অনাহারে মারা গেছে।

ইসরায়েল গাজায় বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এটি ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোর একটি কৌশল বলে দাবি করেছে সংস্থাটি।

গাজায় মানবিক সহায়তা সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কগাটের দাবি, তারা গাজায় শিশুখাদ্য, ফর্মুলা ইত্যাদি প্রবেশে কোনো বাধা দিচ্ছে না। সংস্থাটি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ১ হাজার ৪০০ টনের বেশি শিশুখাদ্য গাজায় পাঠানো হয়েছে।

তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা গাজায় প্রবেশের সময় তাদের ব্যক্তিগত ব্যাগে শিশুখাদ্যের কৌটা ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এক মার্কিন চিকিৎসকের ব্যাগ থেকে একবার ১০টি শিশুখাদ্যের কৌটা জব্দ করে বলেও জানায় সংস্থাটি।

এক ফিলিস্তিনি-জার্মান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. ডায়ানা নাজ্জাল, যিনি মার্কিন চিকিৎসকের ব্যাগ এমনভাবে গুছিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন যাতে তা ইসরায়েলি সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তারা সব কৌটা জব্দ করল, যেগুলো অকালে জন্মানো শিশুদের জন্য বিশেষ ফর্মুলা ছিল। শিশুখাদ্য দিয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তার কী ক্ষতি হতে পারে?’

নাজ্জাল আরও জানান, অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী গাজায় প্রবেশের সময় ওষুধের বদলে প্রোটিন বার ও বাদামজাতীয় উচ্চ-ক্যালরির খাবারে তাদের ব্যাগ ভরছেন।

ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের কারণে গাজায় ক্ষুধা সংকট তীব্র হওয়ায় শিশুখাদ্যের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। প্রায় ৫ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছেন, বাকি জনগণও রয়েছেন তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। যেসব মায়েরা নিজেরাই তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছেন অথবা মারা গেছেন, তারা শিশুকে স্তন্যপান করতে পারছেন না। এই কারণে ফর্মুলার প্রয়োজন আরও বেড়েছে।

এদিকে, বাজারে সামান্য যে ফর্মুলার সরবরাহ আছে, তার দাম আাকশছোঁয়া। এক কৌটা ফর্মুলা কিনতে প্রায় ৫০ ডলার লাগছে—যা স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বেশি।

খান ইউনিসে আশ্রয় নেওয়া ২৫ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী নূরহান বারাকাত বলেন, ‘আমি এক মাসের মতো স্বাভাবিকভাবে স্তন্যদান করতে পেরেছিলাম, কিন্তু খাবারের অভাবে আর তা চালিয়ে যেতে পারিনি।’
বুকভরা কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি, স্তন্যদান মা-সন্তানের বন্ধন মজবুত করে, কিন্তু আমি আর কী করতে পারি?’

গাজায় খাদ্য সহায়তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।

জুনের শেষের দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস জানান, প্রতিদিন প্রায় ১১২টি শিশু অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য গাজার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তিন বছরের আগে অপুষ্টি শিশুদের স্থায়ী বিকাশগত ক্ষতি ডেকে আনে।

এ বিষয়ে ডা. আল-ফাররা বলেন, ‘একটি প্রজন্মকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। তারা স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বিকাশের বিলম্বে ভুগবে এবং সমস্যা হলো, পরবর্তীতে খাদ্য পেলেও এই ক্ষতি পূরণ হবে না।’

চিকিৎসকরা বলেছেন, শিশু মৃত্যুর শুরু গাজার আসন্ন দুর্ভিক্ষের একটি ভয়াবহ সংকেত। কারণ ক্ষুধা সংকটে শিশুদের মৃত্যুই আগে ঘটে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা আভাজের মাধ্যমে সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করা এক মেডিকেল দলের সদস্য ডা. থায়ের আহমদ বলেন, ‘যখন শিশুরা মরতে শুরু করে, তখন আতঙ্ক ও সতর্কতার ঘণ্টা বাজা উচিত। মূলত, খাবারের সংকটে শিশুরাই প্রথম মারা যায়।’

এই পরিস্থিতির জন‌্য ইসরায়েলের ত্রাণ-অবরোধকেই দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা। ইসরায়েল খুব সীমিত সংখ্যক ট্রাককে প্রবেশ করতে দিচ্ছে, যা গাজার জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অনেক কম। জাতিসংঘ বলছে, প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ট্রাক খাবারের প্রয়োজন, অথচ প্রায়ই ৫০টিরও কম ট্রাক ঢোকে গাজায়।

যে সামান্য সহায়তা আসে, তা-ও ক্ষুধার্ত জনতা ও সশস্ত্র গোষ্ঠী লুট করে নিচ্ছে। জিএইচএফের দেওয়া ত্রাণ পেতে সংস্থাটির বারবার পরিবর্তন হওয়া নিয়ম মেনে চারটি বিতরণকেন্দ্রের যেকোনো একটিতে লাইনে দাঁড়াতে হয় ফিলিস্তিনিদের। গত এক মাসে এইভাবে লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।

এসব নিয়ে জিএইচএফের নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকতে পারে এবং এটি মানবিকতার মূলনীতিগুলোর পরিপন্থী। তাছাড়া আগে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে গাজায় চার শতাধিক বিতরণকেন্দ্র ছিল, যা প্রয়োজনীয় স্থানে সহায়তা পৌঁছে দিত।

তবে জিএইচএফের ভাষ‌্য, তারা পাঁচ সপ্তাহে ৫ কোটি ২০ লাখ খাবার বিতরণ করেছে এবং যখন তাদের সহায়তা লুট হয়ে যায়, তখন অন্য সংস্থাগুলো নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইসরায়েলের অভিযোগ, জাতিসংঘের ত্রাণ ব্যবস্থা থেকে সহায়তা লুকিয়ে রাখত হামাস, যদিও মানবিককর্মীরা বলছেন এর কোনো প্রমাণ নেই।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির কাছে এসেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য কয়েকটি মূল বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।

এদিকে গাজার চিকিৎসকরা বলছেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। ডা. আল-ফাররা বলেন, ‘শিশুদের অবস্থা দেখলে বুঝতে পারবেন, ওরা শুধু হাড্ডি-চর্মসার হয়ে গেছে। এটি ভয়ঙ্কর। প্রকৃত সমাধান হলো যুদ্ধ বন্ধ করা, সীমান্ত খুলে দেওয়া এবং শিশুখাদ্য প্রবেশ করতে দেওয়া।’

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Raj Kalam

খাবারের অভাবে কঙ্কালসার হয়ে গেছে গাজার শিশুরা

Update Time : ০৫:৪৭:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ জুলাই ২০২৫

খাবারের অভাবে কঙ্কালসার হয়ে গেছে গাজার শিশুরা। গাজা উপত‌্যকা, মধ‌্যপ্রাচ‌্যের এমন এক টুকরো ভূমি যেখানে জন্মই যেন হয়ে উঠেছে আজন্ম পাপ। শিশুর জন্মে পরিবারে যেখানে আনন্দ নেমে আসে কিন্তু গাজায় একটি শিশু জন্মালে প্রথমেই তার বাবা-মাকে চিন্তা করতে হয়—এই শিশুটিকে কী খাওয়াব? কখন যেন বোমার আঘাতে মারা যায় শিশুটি—সেই দুশ্চিন্তায় তটস্থ হয়ে থাকে তাদের মন।

টানা যুদ্ধে গাজার প্রাণহানি বিশ্ববাসীর চোখ এড়ায়নি। তবে আগ্রাসনের নতুন কৌশল হিসেবে ইসরায়েল যখন গাজায় খাবারসহ মানবিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়, তখন বিশেষজ্ঞরা বারবার যে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন, আজ তা বাস্তব। শুধু তাই নয়, গাজার ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে খাবারকে মানুষ মারার কৌশল হিসেবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে ইসরায়েলি বাহিনী।

এর এসবের মধ্যে সবচেয়ে করুণ দশায় রয়েছে একেকটি নতুন প্রাণ। সেখানকার শিশুদের অবস্থার ভয়বহতা বর্ণনা করতে গিয়ে এক ডাক্তার বলেন, ‘ওরা শুধু চামড়া ও হাড্ডিসার হয়ে গেছে।’

বর্তমানেও উপত্যকায় মানবিক সহায়তার প্রবেশ সীমিত করে রেখেছে ইসরায়েল। ফলে খাদ্যের মারাত্মক ঘাটতির কারণে শত শত শিশু মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন গাজার চিকিৎসকরা।

খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. আহমদ আল-ফাররা দ‌্য গার্ডিয়ানকে বলেন, তার ওয়ার্ডে মাত্র সপ্তাহখানেকের শিশুখাদ্য অবশিষ্ট আছে। ইতোমধ্যেই প্রি-ম্যাচিউর (অকালে জন্মানো) শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট করা বিশেষ ফর্মুলা (খাবার) শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে নবজাতকদের জন‌্য বাধ্য হয়ে সাধারণ শিশুখাদ‌্যই ব্যবহার করছেন তারা।

তিনি বলেন, ‘কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো ফর্মুলা (শিশুখাদ‌্য) আছে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের বাইরেও অনেক শিশু আছে, যাদের জন্য কোনো দুধই নেই। ভয়াবহ ব্যাপার চলছে এখানে।’

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রায় সম্পূর্ণভাবে সহায়তা বন্ধ করে রাখায় গাজায় শিশুখাদ্যের মজুদ ক্রমেই কমছে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সমর্থিত বিতর্কিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গাজা হিউম‌্যানেটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) সীমিত পরিসরে খাদ্য সহায়তা দিলেও তাতে শিশুখাদ্য থাকে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

পাঁচ সন্তানের জননী ২৭ বছর বয়সী হানাআ আল-তাওয়িল বর্তমানে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে বাস করছেন। এই নারী জানান, তিনি নিজেই পর্যাপ্ত খাবার পান না। তাই নিজের সন্তানের জন্য বুকের দুধও তৈরি হচ্ছে না। ১৩ মাস বয়সী সন্তানের জন্য তাই শিশুখাদ্য খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাচ্ছেন এই মা।

হানাআ বলেন, ‘ছেলের জন্মের পর থেকেই দুধের সমস্যা শুরু হয়। আমার অপুষ্টি ও শারীরিক দুর্বলতার কারণে জন্মের পর থেকেই আমি ওকে ঠিকমতো স্তন্যদান করতে পারিনি।’

অপুষ্টির কারণে তার ছেলের বিকাশ পিছিয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তিনি নিজেও লক্ষ‌ করেছেন, তার অন‌্য সন্তানরা এই বয়সে হাঁটতে ও কথা বলতে শুরু করলেও এই শিশুটি তা করতে পারছে না।
একরাশ হতাশা ও কষ্ট নিয়ে হানাআ বলেন, ‘যখন সে ঘুমায়, পাশে এক টুকরো রুটি রেখে দিই। কারণ প্রায়ই সে রাতে জেগে উঠে খাবারের জন্য কাঁদে। সারাক্ষণ অসহনীয় দুঃখ ও আশঙ্কা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ভাবি—আমার সন্তানরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শেষ পর্যন্ত মারা যাবে না তো!’

গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৬ ফিলিস্তিনি শিশু অনাহারে মারা গেছে।

ইসরায়েল গাজায় বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। এটি ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা চালানোর একটি কৌশল বলে দাবি করেছে সংস্থাটি।

গাজায় মানবিক সহায়তা সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কগাটের দাবি, তারা গাজায় শিশুখাদ্য, ফর্মুলা ইত্যাদি প্রবেশে কোনো বাধা দিচ্ছে না। সংস্থাটি জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ১ হাজার ৪০০ টনের বেশি শিশুখাদ্য গাজায় পাঠানো হয়েছে।

তাদের অভিযোগ, চিকিৎসকরা গাজায় প্রবেশের সময় তাদের ব্যক্তিগত ব্যাগে শিশুখাদ্যের কৌটা ভরে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ এক মার্কিন চিকিৎসকের ব্যাগ থেকে একবার ১০টি শিশুখাদ্যের কৌটা জব্দ করে বলেও জানায় সংস্থাটি।

এক ফিলিস্তিনি-জার্মান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. ডায়ানা নাজ্জাল, যিনি মার্কিন চিকিৎসকের ব্যাগ এমনভাবে গুছিয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন যাতে তা ইসরায়েলি সীমান্ত কর্তৃপক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তারা সব কৌটা জব্দ করল, যেগুলো অকালে জন্মানো শিশুদের জন্য বিশেষ ফর্মুলা ছিল। শিশুখাদ্য দিয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তার কী ক্ষতি হতে পারে?’

নাজ্জাল আরও জানান, অনেক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী গাজায় প্রবেশের সময় ওষুধের বদলে প্রোটিন বার ও বাদামজাতীয় উচ্চ-ক্যালরির খাবারে তাদের ব্যাগ ভরছেন।

ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের কারণে গাজায় ক্ষুধা সংকট তীব্র হওয়ায় শিশুখাদ্যের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। প্রায় ৫ লাখ মানুষ চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় আছেন, বাকি জনগণও রয়েছেন তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। যেসব মায়েরা নিজেরাই তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছেন অথবা মারা গেছেন, তারা শিশুকে স্তন্যপান করতে পারছেন না। এই কারণে ফর্মুলার প্রয়োজন আরও বেড়েছে।

এদিকে, বাজারে সামান্য যে ফর্মুলার সরবরাহ আছে, তার দাম আাকশছোঁয়া। এক কৌটা ফর্মুলা কিনতে প্রায় ৫০ ডলার লাগছে—যা স্বাভাবিকের চেয়ে দশগুণ বেশি।

খান ইউনিসে আশ্রয় নেওয়া ২৫ বছর বয়সী তিন সন্তানের জননী নূরহান বারাকাত বলেন, ‘আমি এক মাসের মতো স্বাভাবিকভাবে স্তন্যদান করতে পেরেছিলাম, কিন্তু খাবারের অভাবে আর তা চালিয়ে যেতে পারিনি।’
বুকভরা কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি, স্তন্যদান মা-সন্তানের বন্ধন মজবুত করে, কিন্তু আমি আর কী করতে পারি?’

গাজায় খাদ্য সহায়তা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি প্রজন্মকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।

জুনের শেষের দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেয়াসুস জানান, প্রতিদিন প্রায় ১১২টি শিশু অপুষ্টির চিকিৎসার জন্য গাজার হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তিন বছরের আগে অপুষ্টি শিশুদের স্থায়ী বিকাশগত ক্ষতি ডেকে আনে।

এ বিষয়ে ডা. আল-ফাররা বলেন, ‘একটি প্রজন্মকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। তারা স্মৃতিশক্তি হ্রাস, বিকাশের বিলম্বে ভুগবে এবং সমস্যা হলো, পরবর্তীতে খাদ্য পেলেও এই ক্ষতি পূরণ হবে না।’

চিকিৎসকরা বলেছেন, শিশু মৃত্যুর শুরু গাজার আসন্ন দুর্ভিক্ষের একটি ভয়াবহ সংকেত। কারণ ক্ষুধা সংকটে শিশুদের মৃত্যুই আগে ঘটে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা আভাজের মাধ্যমে সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করা এক মেডিকেল দলের সদস্য ডা. থায়ের আহমদ বলেন, ‘যখন শিশুরা মরতে শুরু করে, তখন আতঙ্ক ও সতর্কতার ঘণ্টা বাজা উচিত। মূলত, খাবারের সংকটে শিশুরাই প্রথম মারা যায়।’

এই পরিস্থিতির জন‌্য ইসরায়েলের ত্রাণ-অবরোধকেই দায়ী করেছেন চিকিৎসকরা। ইসরায়েল খুব সীমিত সংখ্যক ট্রাককে প্রবেশ করতে দিচ্ছে, যা গাজার জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনীয়তার তুলনায় অনেক কম। জাতিসংঘ বলছে, প্রতিদিন অন্তত ৫০০ ট্রাক খাবারের প্রয়োজন, অথচ প্রায়ই ৫০টিরও কম ট্রাক ঢোকে গাজায়।

যে সামান্য সহায়তা আসে, তা-ও ক্ষুধার্ত জনতা ও সশস্ত্র গোষ্ঠী লুট করে নিচ্ছে। জিএইচএফের দেওয়া ত্রাণ পেতে সংস্থাটির বারবার পরিবর্তন হওয়া নিয়ম মেনে চারটি বিতরণকেন্দ্রের যেকোনো একটিতে লাইনে দাঁড়াতে হয় ফিলিস্তিনিদের। গত এক মাসে এইভাবে লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে ৫ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন।

এসব নিয়ে জিএইচএফের নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের দাবি, প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকতে পারে এবং এটি মানবিকতার মূলনীতিগুলোর পরিপন্থী। তাছাড়া আগে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে গাজায় চার শতাধিক বিতরণকেন্দ্র ছিল, যা প্রয়োজনীয় স্থানে সহায়তা পৌঁছে দিত।

তবে জিএইচএফের ভাষ‌্য, তারা পাঁচ সপ্তাহে ৫ কোটি ২০ লাখ খাবার বিতরণ করেছে এবং যখন তাদের সহায়তা লুট হয়ে যায়, তখন অন্য সংস্থাগুলো নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
ইসরায়েলের অভিযোগ, জাতিসংঘের ত্রাণ ব্যবস্থা থেকে সহায়তা লুকিয়ে রাখত হামাস, যদিও মানবিককর্মীরা বলছেন এর কোনো প্রমাণ নেই।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইসরায়েল ও হামাস উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির কাছে এসেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য কয়েকটি মূল বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়েছে।

এদিকে গাজার চিকিৎসকরা বলছেন, সময় ফুরিয়ে আসছে। ডা. আল-ফাররা বলেন, ‘শিশুদের অবস্থা দেখলে বুঝতে পারবেন, ওরা শুধু হাড্ডি-চর্মসার হয়ে গেছে। এটি ভয়ঙ্কর। প্রকৃত সমাধান হলো যুদ্ধ বন্ধ করা, সীমান্ত খুলে দেওয়া এবং শিশুখাদ্য প্রবেশ করতে দেওয়া।’