সুবীর মণ্ডল বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি:
(খাতড়)আজ সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন বৃটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সাঁওতাল জনতা। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আদিবাসীর বিজয় গাথাঁ, স্বাধীনতার পথযাত্রা।সাঁওতাল বিদ্রোহের সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পবিত্র দিন। জঙ্গলমহলের রাজ্যের সরকারি অফিস ছুটি, সরকারি ও বেসরকারি ভাবে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি। জঙ্গলমহলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে। একটি স্মরণীয় দিন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়,ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই দিনটি পালিত হয়েছে । প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড,ওড়িশাতে পালিত হচ্ছে হুল দিবস।
ঐতিহাসিক ভাবে দিনটি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। ৩০শে জুন সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনার দিন। জোতদার জমিদার অত্যাচারী মহাজনদের থেকে নিস্তার পাওয়ার শপথের দিন। ইংরেজ রাজ শক্তিকে দেশ থেকে তাড়ানোর অঙ্গীকারের দিন। সেই দিনটি স্মরণে বাঁকুড়া– পুরুলিয়া–ঝাড়গ্রাম জেলার বিভিন্ন জায়গায় সরকারী এবং বেসরকারী ভাবে সাঁওতাল বিদ্রোহ তথা হুল দিবস উদযাপন হলো। এই দিনটি নিয়ে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে জনমানসে। আদিবাসী গবেষকদের মতে — ‘আসলে ‘হুল’ কোন পরব বা উৎসব নয়।হুল হয়েছিল মান- সন্মান -স্বাভিমান রক্ষার জন্য, জল- জঙ্গল -জমিনের অধিকার রক্ষার জন্য। সেই মহান সিধু – কানু এবং সকল বিদ্রোহী বহুজন মহাপুরুষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যের পবিত্র দিন ৩০শে জুন’। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও জঙ্গলমহলের নানা জায়গায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হলো।খাতড়া মহকুমার সিমলাপাল ব্লকের অনুষ্ঠান হলো তালডাংরা ইকোপার্কে। সকাল ১০ দশটায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা হয়।সেই সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনের মধ্যে বস্রবিতরণ করা হয়। হীড়বাধ ব্লকের অনুষ্ঠান হলো ব্লক অফিসের সামনে সিধু- কানু মূর্তির পাদদেশে।ইন্দপুর ব্লকের জয়েন্ট মোড়ে আদিবাসীদের নিয়ে সিধু কানুর মূর্তিতে মাল্যদান ও স্মৃতিচারণ করা হলো। রাইপুর ব্লকে হুল দিবসে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হলো দুই আদিবাসী কৃতী ছাত্রীকে। সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব এর কৃতিত্বের পাশাপাশি এই দুই কন্যার সাফল্য আগামী প্রজন্মের এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রেরণা প্রদান করবে,এলাকার সাধারণ মানুষের ভাবনা। যুগ্ম ভাবে রাজ্যে প্রথম সনকা হেমরম ও অনিমা মান্ডি। দুজনেই রাইপুরে পন্ডিত রঘুনাথ মুম্মু আবাসিক বিদ্যালয় এর ছাত্রী। কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সাফল্য পেয়েছে তারা। পরবর্তী জীবনে আরো বড়ো সাফল্য আসুক এই কামনাকরেজঙ্গলমহলের আপামর জনসাধারণ।এছাড়াও সারেঙ্গা ব্লক ও বাঁকুড়া জেলা সদরে সাড়ম্বরে পালিত হলো হুল দিবস সরকারিভাবে। রানিবাঁধের পঞ্চায়েত সমিতির তত্ত্বাবধানে পালিত হলো হুল দিবস , প্রচুর মানুষের সমাবেশ ঘটে। হুল দিবসে সাঁওতাল বিদ্রোহের সকল শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানালেন রানীবাঁধ বিধানসভার বিধায়ক রাজ্যের মাননীয়া প্রতিমন্ত্রী জ্যোৎস্না মান্ডি (পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রতি মন্ত্রী) ।
খাতড়া “সিধু -কানহু চকে” (SDO মোড়ে ) বহু প্রতীক্ষার পরে বীর শহীদ “সিধু-কানহু” এর মূর্তি স্হাপিত হলো। মার্শাল টুডুর বক্তব্য …
“খাতড়া বাসীর দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ করতে পেরে আমরা গর্বিত”।সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ সিধু— কানুর মর্মরমূর্তি স্থাপিত হলো খাতড়া মহকুমা শহরের প্রাণকেন্দ্র এস,ডি,ও অফিসের মোড়ে । উদ্যোক্তা অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, বাঁকুড়া জেলা। মূর্তি নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ভাস্কর্য শিল্পী শ্রী চন্দন রায়,খাতড়া মহকুমা শহরের ভূমিপুত্র। শিল্পী চন্দন রায় সাক্ষা তে জানালেন–‘
“খাতড়া বাসীর দীর্ঘদিনের দাবী পূরণ করতে পেরে আমরা গর্বিত”।সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ সিধু— কানুর মর্মরমূর্তি স্থাপিত হলো খাতড়া মহকুমা শহরের প্রাণকেন্দ্র এস,ডি,ও অফিসের মোড়ে । উদ্যোক্তা অখিল ভারতীয় আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, বাঁকুড়া জেলা। মূর্তি নির্মাণ করেছেন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ভাস্কর্য শিল্পী শ্রী চন্দন রায়,খাতড়া মহকুমা শহরের ভূমিপুত্র। শিল্পী চন্দন রায় সাক্ষা তে জানালেন–‘
আজ হুল দিবস,, সেই উপলক্ষে চার সেট সিধু কানু ফুল ফিগার অর্ডার ছিলো(ফাইবার গ্লাস,,) 6 ফুট এক সেট ও7 ফুট দু সেট 8ফুট একসেট করে,,সব বসিয়ে এই মাত্র একটু ফ্রী হলাম।” রানিবাঁধের সাঁওতালি কবি ও শিক্ষক লক্ষ্মণ কিস্কু মহাশয় হুল দিবসের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানালেন–” ‘হুল’ মানে শুধু লড়াই–‘ হুল’ মানে অরণ্যের অধিকার রক্ষার,’ হুল’ মানে স্বাধীনতা ভাবে বেঁচে থাকার লড়াই। তিনি আরও জানান– ‘হুল ‘মানে বুকের আগুন,ন্যায় বিচার না পাওয়ার, ‘হুল’ মানে প্রতিবাদের আগুন, ‘হুল ‘মানে আগামী স্বপ্ন– স্বাধীনতার, “
জুন ১৮৫৫, ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন , যা “ঐতিহাসিক সাঁওতাল হুল দিবস” বা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস নামেই ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ভাগনডিহির মাঠে সিধু আর কানহু মুর্মুর নেতৃত্বে দশ হাজার আদিবাসী ও সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষেরা একজোট হয়ে তাঁদের ‘ঐতিহ্য ও অর্জন’-এর সুরক্ষা এবং অধিকার আদায়ের জন্যে প্রাণপণ লড়াইয়ের সংকল্প ও শপথ নিয়েছিল। তাঁদের সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে ওঠে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসন, লুঠেরা জমিদার ও সুদখোর দাদনদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে । তাঁরা লড়েছিলেন ভূমি আর অরণ্যের অধিকারের জন্যে, তাঁরা লড়েছিলেন বল্গাহীন শোষণ ও অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে , তাঁরা লড়েছিলেন মা-বোনেদের ইজ্জত রক্ষার তাগিদে। সাঁওতাল জনগণ মহাজন ও দাদন ব্যবসায়ীদের নিপীড়নে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল । মহাজনের ঋণের ফাঁস জড়িয়ে থাকতো বংশপরম্পরায়। স্ত্রী-পুত্র, ভাই-বোন মহাজন, দাদনদারদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যেতো। পুলিশ, জমিদারদের সাহায্যে সাঁওতালদের গবাদিপশু, জমিজমা, সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হতো। প্রতিবাদ করলে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো; এমনকি সে সময় ব্রিটিশ সরকারের লৌহ শাসনে জেল-জরিমানার খড়্গ নেমে আসত তাদেরই মাথার ওপর।
ক্রমে ক্রমে অন্যান্য সম্প্রদায়ের অন্ত্যজ, অধিকারহীন, অত্যাচারিত মানুষও — তাঁতি, জেলে, জোলা, মুচি, ছোটো চাষীরাও মৃত্যুভয়হীন এই সশস্ত্র সংঘর্ষে সামিল হলেন এবং এই বিদ্রোহ যথার্থই সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামে পরিণত হলো। ‘সাঁওতাল হুল’ নামেই ইতিহাসে এই বিদ্রোহের পরিচিতি। অবর্ণনীয় ও অমানুষিক অত্যাচারে ইংরেজরা এই বিদ্রোহ দমন করে। এ ভাবেই সাঁওতাল শোণিতধারায় লেখা হয় দেশের মুক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আট মাস জুড়ে বিদ্রোহ-আন্দোলনের শেষ হয় লেফটেন্যান্ট ফেগানের ভাগলপুর হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর হাতে সাঁওতালদের চরম পরাজয়ে। ফেগানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে অরণ্যের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা শান্ত সাঁওতাল গ্ৰামগুলোয় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই জ্বলন্ত অগ্নিপুঞ্জ ও তার ধূম্রজালে লেখা হয় ঘাতক ব্রিটিশ সরকার ও তার দুর্বত্ত দালাল দাদনদার-জমিদারদের অত্যাচারের ইতিবৃত্ত।
বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে শুধুই সিধু-কানু বা চাঁদ-ভাইয়েরা দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের সঙ্গে সাঁওতাল নারীদের নিয়েও সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়েছে দুই বোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমু। ব্রিটিশ সেপাইরা ফুলোকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ ফেলে দেয় রেল লাইনের ধারে। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতাল জাতিসত্তা আজও ফুলোকে শ্রদ্ধা ও গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করে। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আর দ্বিতীয় সপ্তাহে কানুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
সাঁওতাল হুলে সাঁওতালরা পরাস্ত হয়েছে, তাদের গ্ৰাম বিধ্বস্ত হয়েছে, মহিলাদের সম্মান লুন্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তারা অত্যাচারী শোষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তেভাগার লড়াই আর আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন সহ মানুষের শোষণমুক্তির সর্ববিধ আন্দোলনে সাঁওতাল-সংগ্ৰামের অবিস্মরণীয় অনুপ্রেরণা এবং অবদান তাই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তাদের অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করলে, ইতিহাসই একদিন তার মূল্য চুকিয়ে দেবে।
ক্রমে ক্রমে অন্যান্য সম্প্রদায়ের অন্ত্যজ, অধিকারহীন, অত্যাচারিত মানুষও — তাঁতি, জেলে, জোলা, মুচি, ছোটো চাষীরাও মৃত্যুভয়হীন এই সশস্ত্র সংঘর্ষে সামিল হলেন এবং এই বিদ্রোহ যথার্থই সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামে পরিণত হলো। ‘সাঁওতাল হুল’ নামেই ইতিহাসে এই বিদ্রোহের পরিচিতি। অবর্ণনীয় ও অমানুষিক অত্যাচারে ইংরেজরা এই বিদ্রোহ দমন করে। এ ভাবেই সাঁওতাল শোণিতধারায় লেখা হয় দেশের মুক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আট মাস জুড়ে বিদ্রোহ-আন্দোলনের শেষ হয় লেফটেন্যান্ট ফেগানের ভাগলপুর হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর হাতে সাঁওতালদের চরম পরাজয়ে। ফেগানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে অরণ্যের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা শান্ত সাঁওতাল গ্ৰামগুলোয় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই জ্বলন্ত অগ্নিপুঞ্জ ও তার ধূম্রজালে লেখা হয় ঘাতক ব্রিটিশ সরকার ও তার দুর্বত্ত দালাল দাদনদার-জমিদারদের অত্যাচারের ইতিবৃত্ত।
বিদ্রোহের নেতৃত্ব যে শুধুই সিধু-কানু বা চাঁদ-ভাইয়েরা দিয়েছেন তা নয়, তাঁদের সঙ্গে সাঁওতাল নারীদের নিয়েও সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নিয়েছে দুই বোন ফুলো মুরমু ও ঝানো মুরমু। ব্রিটিশ সেপাইরা ফুলোকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে তাঁর লাশ ফেলে দেয় রেল লাইনের ধারে। ইতিহাসের প্রথম বীরাঙ্গনা হিসেবে সাঁওতাল জাতিসত্তা আজও ফুলোকে শ্রদ্ধা ও গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করে। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ে সিধু নিহত হন ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আর দ্বিতীয় সপ্তাহে কানুকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
সাঁওতাল হুলে সাঁওতালরা পরাস্ত হয়েছে, তাদের গ্ৰাম বিধ্বস্ত হয়েছে, মহিলাদের সম্মান লুন্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তারা অত্যাচারী শোষকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। তেভাগার লড়াই আর আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন সহ মানুষের শোষণমুক্তির সর্ববিধ আন্দোলনে সাঁওতাল-সংগ্ৰামের অবিস্মরণীয় অনুপ্রেরণা এবং অবদান তাই সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। তাদের অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করলে, ইতিহাসই একদিন তার মূল্য চুকিয়ে দেবে।