অনুকূল বিশ্বাস, মালদহ জেলা প্রতিনিধি:

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলতেন, ” জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা।”

গবেষকদের মতানুসারে শ্রীরামকৃষ্ণের এই কালজয়ী বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, অনাথ আশ্রম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের মতো সমাজসেবামূলক কাজে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন যে, হত দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের সেবা করলেই প্রকৃত ঈশ্বরের সেবা সম্ভব।তাঁদের দুবেলা অন্নের সংস্থান করতে পারলেই আসলে ঈশ্বর সেবা হয়। তিনি মনেপ্রাণে মানতেন জীবের মধ্যেই পরমেশ্বর বাস করেন।

যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ ও দুর্গতদের পাশে থাকা রামকৃষ্ণ মিশনের চিরাচরিত ঐতিয্য। এই করোনাকালের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর ছোবলে মানুষ যখন দিশেহারা ও চারিদিকে মৃত্যু মিছিলে স্বজনহারাদের হাহকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে, এমন কঠিন সময়ে মালদা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম, বিদ্যামন্দির, শুভাকাঙ্খী ভক্তবৃন্দ ও প্রাক্তন ছাত্রদের ঐকান্তিক সহযোগিতায় তাঁরা নিরবিচ্ছিন্ন সেবা কার্য অব্যাহত রেখেছেন। মালদা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের পূজনীয় সম্পাদক স্বামী ত্যাগরুপানন্দজি মহারাজ ও রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের সম্মানীয় প্রধান শিক্ষক স্বামী তাপহরানন্দজি মহারাজের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও মানবিক উদ্যোগে মালদা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করোনা রুগী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দীর্ঘ ৩১দিন ধরে রাত্রিকালীন আহারের ব্যবস্থা করে চলেছেন।

গত ১৬ই মে থেকে এখানে লকডাউন চলছে।ফলে মালদা মেডিকেল কলেজের আশেপাশে যে সমস্ত খাবার হোটেল ছিল সেগুলি এই মুহূর্তে সব বন্ধ। যার ফলে রোগীর আত্মীয়রা বিশেষ করে রাত্রিকালীন আহার গ্রহনে মহা সংকটের মধ্যে পড়েছিলেন। এমতাবস্থায় মালদা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম প্রতিদিন তাঁদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নেন। মিশনের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা প্যাকেট বন্দি খাবার যেখানে রয়েছে ভাত, ডাল, সবজি , ডিম বা সোয়াবিন সেইসব অসহায় মানুষের হাতে তাঁরা তুলে দেওয়া হচ্ছে। যেহেতু প্রতিদিন এই খাবার বিতরণ করা হচ্ছে তাই অসহায় মানুষগুলো অনেকটা নিশ্চিন্তে রুগীর পাশে থাকতে পারছেন। রাতের খাবার নিয়ে তাদের আর টেনশন করতে হচ্ছে না। রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিদিন গড়ে দুশো থেকে আড়াইশো প্যাকেট খাবার বিতরণ করছেন। ঝড়, বৃষ্টি , বর্ষা, এমনকি ইয়াসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগেও তাঁদের এই মানবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়নি। একাজে প্রতিদিন মিশনের সম্পাদক মহারাজ ও বিদ্যামন্দিরের প্রধান শিক্ষক মহারাজ নিজেরা সশরীরে উপস্থিত থেকে মানুষের সেবাকার্য তদারকি করছেন।

এছাড়াও মালদা শহরের যে সমস্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সেইসব পরিবারে রামকৃষ্ণ মিশন এই প্যাকেটজাত খাবার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন। কিছু সহৃদয় ব্যক্তি মোটর বাইকে চড়ে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছানোর কাজে সহায়তা করছেন। মালদা রামকৃষ্ণ মিশন একাজে এক অনন্য মানবিক নজির সৃষ্টি করেছেন।

সেই সঙ্গে যেসমস্ত গরীব মানুষ যাঁরা করোনা আক্রান্ত হলে অক্সিজেন প্রয়োজন অথচ কেনার সামর্থ নেই, তাঁদের রামকৃষ্ণ মিশন বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন।জীবন বাঁচানোর এই মহৎ কর্মযজ্ঞে নিরলস কাজ করে চলেছেন মিশন।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর ইংরেজ বাজার মিউনিসিপ্যালিটির (মালদহ শহরের মিউনিসিপ্যালিটির নাম ইংরেজ বাজার) অধিকাংশ ওয়ার্ড জলের তলায় চলে যায়। ফলে প্রচুর বাড়ি জলে ডুবে যায়।এর মধ্যে কাঁচা বাড়ি গুলির বাসিন্দারা বাড়ি ছেড়ে উঁচু রাস্তায় আশ্রয় নেন। মালদা রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে গত কয়েকদিন ধরে সেইসব দূর্গত মানুষদের মধ্যে বিশেষ করে সানিপার্ক থেকে ঘোড়াপির হয়ে বাগবাড়ি পর্যন্ত এলাকায় আড়াইশ মানুষকে খিচুরির সঙ্গে একটি করে ডিম খাওয়ানো হচ্ছে।এর ফলে ঘর ছাড়া পথে আশ্রয় নেওয়া মানুষ গুলো একবেলা পেটভরে খেতে পাচ্ছেন।সেই সঙ্গে বাগবাড়ি ও এরোড্রাম সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ছিন্নমূল পরিবার বসবাস করেন। এরা প্রায় সকলেই আশেপাশের ইট ভাটায় কাজ করতেন। করোনাকালে লকডাউনে এদের প্রায় সকলেই কাজ হারিয়েছেন। কাজ হারানো সেইসব মানুষগুলোর পাশেও মালদা রামকৃষ্ণ মিশন তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন । ওই এলাকার প্রায় দেড় শতাধিক পরিবারকে মিশনের তরফ থেকে চাল, ডাল, সোয়াবিন ও ডিমসহ বিভিন্ন রকম পুষ্টিযুক্ত সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন।

সন্ধ্যায় যে খাবার বিতরণ করা হয় তার জন্য বাজার থেকে চাল, ডাল, আলু, সবজি, ডিম, সোয়াবিনসহ বিভিন্ন সামগ্রী কিনে বিদ্যামন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিদিন রান্না করা হচ্ছে। এই সমস্ত কাজে প্রতিদিন যাঁরা স্ব-ইচ্ছায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তাঁদের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এঁদের প্রায় সকলেই বিদ্যামন্দিরের শিক্ষাকর্মী ; বলা যায় বিদ্যামন্দিরের জন্য এদের মন প্রাণ উৎসর্গিত । এঁরা হলেন তপন রায়,শ্যামল মন্ডল,ও যুধিষ্ঠির মন্ডল।দৈনন্দিন বাজারের দায়িত্ব রয়েছে শ্যামল মন্ডলের কাঁধে।

রান্নার দায়িত্ব সামলায় তপন রায়। রান্নার কাজে তপনকে সাহায্য করেন শ্যামল সহ মিশনের কয়েকজন মহিলা ভক্ত। রান্না সম্পন্ন হলে সন্ধ্যা ছটা থেকে একঝাঁক প্রাক্তন ছাত্র খাবার প্যাকেটবন্ধীর কাজে হাত লাগায়। তারা দ্রুত প্যাকেটের কাজ সম্পূর্ণ করে মহারাজদের সঙ্গে সেগুলি বিতরণের জন্য বেরিয়ে পড়েন।একদল যান মালদা মেডিক্যাল কলেজের দিকে, একদল যান ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছে ও অন্যদল বাইক নিয়ে যান বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিতে।

করোনাকালে মালদা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম স্বামীজীর সেই ” জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর ” ——এই আপ্তবাক্যকে সামনে রেখে অসহায় মানুষের সেবাকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের যে স্বরূপ দেখেছিলেন মালদা রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিমুহূর্তে ঠাকুরের সেই দর্শনকে বাস্তব রূপায়নে সর্বদা সচেষ্ট থাকছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে