অরুন্ধতী সাহা গুপ্ত,চিত্তরঞ্জন,পশ্চিম বর্ধমান প্রতিনিধি:
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ।আমার সামনে একটা সাদা টাইলসের প্রশস্ত করিডর। সকাল প্রায় সাড়ে ন’টা। করিডোরের জানলাগুলো রম্বস আকৃতির সিমেন্টের জাফরি। সে জাফরির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় বুনোঘাস। কিছু গোলাপি অনন্তলতার বিছিয়ে চলা আর আমের কচিফলে মৌমাছি গুঞ্জন।অসামান্য প্রাণ যেন প্রকাশিত উচ্ছল উদ্ভাসে।আমার বাড়িরই জ্যেষ্ঠতম সদস্য সফেদ বিছানায় শুয়ে আছেন সেখানে সেই রোগ শয্যায়। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই। করিডরের প্রান্তে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘন্টা খানেক কেটে গেল। নিস্তব্ধতা কেটে মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল পাখিদের কিচিমিচি রব। আর হসপিটালের স্ট্যান্ড থেকে গাড়ির ধাতব হর্ণ। কিছু সাদা ব্যবহৃত তুলো উড়ে পড়ে আছে মেঝেতে। আর বেশ কিছু শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ফোঁটা। কি জানি কার!জমাট বাঁধা কালচে দাগ কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে থাকে মনকে। কিসের দাগ? কেন এখনো এভাবে পড়ে আছে?সাফাইকর্মীরা কি ভুলে গেছেন আজ? ভাবি আর
সান্ত্বনা দিই নিজেকে-‘ আসবে । আসবে, এই একটু পরেই আসবে’। কিন্তু যাঁকে দেখতে এলাম কেমন আছেন তিনি? অধৈর্য হয়ে উঁকি দিলাম সেই ঘরের ভেতর। দেখি উনি শুয়ে, বিছানা ঝকঝকে, সাদা চাদর বুক অবধি টানা। ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা পা দুটো বেডের সাথে। বাঁধা আছে হাতও। তবে হাল্কা ভাবে। শুয়ে আছে প্রাচীন শরীর। চোখ বন্ধ। একটি হাত উর্ধ্বে তুলে ঠোঁট নড়ছে। কি যেন ভারি একান্ত কথপোকথনের মহড়া চলছে কারো সাথে।গতকালের দুপুরে দেওয়া জলের বোতলের জলের সীমানা নামে নি এক ইঞ্চিও। দাদাকে দুদিন আগে বলেছিলেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বার বার জল খেতে ইচ্ছে করে। নিজে তো পারেন না। হাত কাঁপে। গ্লাসের ওজন তুলতে পারে না শরীর। চোখ বুজেই খবর নেন সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে থাকা নাতির। ছেলে বলে-‘ বাবা কি প্রব্লেম হচ্ছে তোমার’? ওভাবেই চোখ বন্ধ করে বলেন -“কিচ্ছু অসুবিধা নেই। শুধু গলা শুকিয়ে আসে”।
নার্স আসেন এবার। ধীর স্থির, গম্ভীর, বলি
-‘খাবার দিয়ে গেলাম ম্যাম’।-
-‘রেখে যান’।
উনি দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট জায়গা। বলি
-‘ম্যাম,একটু জল দেবেন ওনাকে? বার বার গলা শুকিয়ে যায়’।
উনি চুপ করে থাকেন। আবার বলি। উনি এদিক ওদিক জিনিস পত্র গুছান। আমি মরিয়া হয়ে বলে ফেলি -‘ একটু জল এখন দেবেন ওনাকে’?
উনি তাকান। আবার কি ভেবে বেডের পাশে যান।আমি ভাবি উনি জল দেবেন হয়তো বা। আমি খুশিতে চোখ বড় করে ফেলি। কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় মন। উঁকি দি অমূল্য জলপান দেখব বলে। নার্স শুভ্র পোশাকে মায়াময় হয়ে সেবার দেবীর মত পদক্ষেপে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। তারপর আমার দৃষ্টি বেয়ে বেয়ে যে পথে গিয়েছিলেন সে পথেই ফিরে আযৎসেন আবার জলস্পর্শ না করে।কোনো বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে যদি একই বিন্দুতে শেষ হয় তবে সরণের মান শূন্য। বিজ্ঞান বইতে সেই কবে পড়েছিলাম। বৃদ্ধ মুখ হাঁ হয়ে থাকে আকণ্ঠ পিপাসায়। অন্তর্জলী যাত্রা পথে তাঁর পা ছুঁয়ে ফুল দিতে গিয়ে কেবলই চোখ আটকে যাচ্ছিল সেই উন্মুক্ত বিবরের দিকে। সেই শুকনো কন্ঠ- তালু -মূর্ধা বিয়াল্লিশ ডিগ্রির তাপমাত্রার সব আদ্রর্তা শুষে নেয় প্রাণপণে। আশপাশের অনেক বন্ধু যখন সেদিন বিকেলে কালবৈশাখীর ছবি তুলে বৃষ্টির খবর দেয়-এখানে কিন্তু অনাবৃষ্টি —শুধু আমি জানি একবিন্দু জল আকাশ থেকে পড়ার আগেই কে অসীম পিয়াসে সব টুকু শুষে নিয়ে ইলেকট্রিক চুল্লিতে ভস্মীভূত করে দিলো যাবতীয় পার্থিব চাওয়া।