মাত্র ক’দিন আগে পার হয়ে গেল বিশ্ববরেণ্য চিত্রপরিচালক, সঙ্গীতজ্ঞ, লেখক, চিত্রশিল্পী-সহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষ। তাঁর সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু যেটা বলার, সেটা হচ্ছে এই সত্যজিৎ রায় কি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র বংশধর?
আমরা এত দিন জানতাম, বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা, ওরফে সিরাজউদ্দৌলা, যাঁর পুরো নাম মির্জা মুহম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা, তাঁর কোনও ছেলে ছিল না। একটি মেয়ে ছিল। সেই মেয়ের জীবন প্রায় ভিখারির মতো অনাহারে কেটেছিল।
কিন্তু সম্প্রতি স্বনামধন্য ঐতিহাসিক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গুরু নানক অধ্যাপক’ অমলেন্দু দে’র লেখা ‘সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে’ বইটি পড়ে চমকিত হলাম। জানতে পারলাম, বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র বিশ্বস্ত সঙ্গী মোহনলালের এক বোন ছিল। তাঁর নাম মাধবী। যাঁকে হীরা নামে ডাকা হত। সেই হীরার সঙ্গে বিবাহ-পূর্ব সম্পর্কের জেরে সিরাজউদ্দৌলা’র একটি ছেলে হয়।
কিন্তু সেই সন্তানকে সামাজিক এবং পারিবারিক কারণে সিরাজউদ্দৌলা অস্বীকার করেন। তখন ছেলেটিকে তাঁর মামা, অর্থাৎ মোহনলাল উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
যদিও ঢাকা আকাডেমি থেকে প্রকাশিত একটি বইয়ে অন্য তথ্য রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে— সিরাজউদ্দৌলা সামাজিক বা পারিবারিক কারণে পুত্র ত্যাগ করেননি। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পতন যখন ঠেকানো যাবে না, তখন মোহনলাল বুঝতে পারলেন ইংরেজরা সিরাজউদ্দৌলাকে মেরে ফেলবে এবং হাতের কাছে সিরাজউদ্দৌলার ছেলেকে পেলে তাকেও মেরে ফেলবে। তাই মোহনলাল তাঁর ভাগ্নে, মানে সিরাজউদ্দৌলার সেই ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যান।
রেখে আসেন ময়মনসিংহের জমিদার শ্রীকৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরীর বাড়িতে। সেই জমিদারের কাছেই বড় হতে থাকে সিরাজউদ্দৌলা’র ছেলে। সেখানে তাঁর নতুন নামকরণ হয়— যুগলকিশোর রায়চৌধুরী।
পরে সেই জমিদার কৃষ্ণগোপাল রায়চৌধুরীর দুই স্ত্রী যুগলকিশোরের জন্ম বৃত্তান্ত জেনে ফেলার পরে স্বামীর সঙ্গে তাঁদের শুরু হয় বিরোধ। যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
ঠিক তখনই নিজের আসল পরিচয় জানতে পারেন সেই ছেলে, মানে যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। এটা জানার পরেই তাঁর মনে হয়, এই সত্যটা ইংরেজদের কাছে পৌঁছলে, যেহেতু তিনি সিরাজউদ্দৌলা’র ছেলে তাই তাঁকে ইংরেজরা কখনওই বাঁচিয়ে রাখবে না। ছলে বলে কৌশলে, যে কোনও উপায়ে ঠিক খতম করে দেবে। সে জন্য তিনি আত্মগোপন করেন।
পরে এই যুগলকিশোরের বিয়ে হয়। স্ত্রী রুদ্রাণীর কোল আলো করে পৃথিবীতে আসে হরকিশোর এবং শিবকিশোর নামে দু’টি ছেলে। একই সঙ্গে জন্ম নেয় আরও চারটি মেয়ে। কিন্তু তাঁর ছেলে দু’টি বেশি দিন বাঁচেনি। তাই ছেলের মুখ দেখার আশায় আবার তিনি বিয়ে করেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী যমুনার ঘরে জন্ম নেয় প্রাণকৃষ্ণনাথ রায়চৌধুরী। শেষ জীবনে এই প্রাণকৃষ্ণকেই নিজের জন্মের ইতিহাস বলে যান যুগলকিশোর।
পরে এই প্রাণকৃষ্ণেরও বিয়ে হয়।
প্রাণকৃষ্ণ’র দ্বিতীয় সন্তান শৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পরেন। তখন ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাবার পরামর্শে নাম বদল করেন তিনি। শৌরীন্দ্রকিশোর নাম পালটে প্রথমে হন প্রসন্নচন্দ্র রায়চৌধুরী। কিন্তু পুলিশের চোখে এই ‘রায়চৌধুরী’ পদবিটা সন্দেহের কারণ হতে পারে ভেবে তিনি ‘রায়চৌধুরী’ পদবির জায়গায় ‘দে’ বসিয়ে হয়ে যান— প্রসন্ন কুমার দে।
এই শৌরীন্দ্রকিশোর তিনটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী ত্রিপুরেশ্বরী দেবীর গর্ভে জন্ম নেয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
হ্যাঁ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীরই ছেলে সুকুমার রায়। আর সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায়।
স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় অধ্যাপক অমলেন্দু দে’র মতে, এই সত্যজিৎ রায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নাতি হওয়ার সুবাদেই বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র বংশধর।
কিন্তু অমলেন্দু দে’র এই গবেষণাধর্মী বইটিকে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক, পলাশী এবং মুর্শিদাবাদের ইতিহাস নিয়ে সব চেয়ে বেশি চর্চা করেছেন যিনি, সেই সুশীল চৌধুরী। কারণ, অমলেন্দু দে’র গবেষণার এই সব তথ্যের অস্তিত্ব তিনি নিজামতে খুঁজে পাননি। মাধবী কিংবা হীরার নামও কোনও রেকর্ড-এ নেই।
আসল সত্য কোনটা, সেটা যে এঁদের দু’জনের কারও কাছে গিয়ে জানার চেষ্টা করব, তারও উপায় নেই। কারণ ইতিমধ্যে অমলেন্দু দে গত হয়েছেন ২০১৪ সালের ১৬ মে আর সুশীল চৌধুরী এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ২০১৯ সালের ১ মার্চ।
তা হলে কোনটা সত্যি? সুশীল চৌধুরীর নস্যাৎ করে দেওয়াটা? নাকি অমলেন্দু দে’র গবেষণাধর্মী লেখা ‘সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে’ বইটি। যদি এই বইটিই সত্যি হয়, তা হলে একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে তো উঁকি দেবেই, আর সেটা হল— সত্যজিৎ রায় কি বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র বংশধর?
লেখক : সিদ্ধার্থ সিংহ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।