ছোট গল্প
জননীর বুকে কঙ্কাল
আরজু মুক্তা
ঘুপুত ঘুক! সর্বনেশে পাখি শুধু রাতের আঁধার ছাপিয়ে ডাকে। তার ডাক শুনে মানুষের অন্তরাত্মা কাঁপে। না জানি, কি বিপদ আসে? ঐ পাড়ার ময়েন উদ্দিন ভাই পাখিটারে গালিগালাজ করে। শালা….! তার গালি শুনে পাখিটা চুপ করে থাকলেও, রাতের বুক চিরে আবার ডাকে “ঘুপুত ঘুক!” মনে হচ্ছে, মগজ ভেদ করে ছাড়বে। ঘুম আসে না।
কয়েকদিন ধরে শোনা যাচ্ছে আর্মি আসবে। যে যার মতো খাট, আলমারি, চেয়ার, টেবিল পুকুরে ডুবায় দেই। মাটি খুঁড়ে শোয়ার ব্যবস্থা করি। চাল, একটু ডাল, কখনো আলু সেদ্ধ, কখনো শাক ভর্তা, কখনো ফেন দিয়ে খাওয়া চলে।
আজ আবার সিদ্দিক চাচা, ওমর চাচা ওনাদের ফ্যামিলি নিয়ে আসছে। শহরের স্টেশনে জমা হয়েছে আর্মি। সিদ্দিক চাচার বাড়িতে একটা বন্দুকের গুলি লাগছে। টিন ফুটা হয়ে গেছে। কাল যে কি ঘটে, বোঝা মুশকিল।
ময়েন উদ্দিন ভাইয়ের ৫ ছেলে ৪ মেয়ে। এতোগুলোর মুখের আহার যোগানো কঠিন। ছোট ছেলের বয়স ২ বছর। পুষ্টির অভাবে দেহ কঙ্কালসার। গরমে মাটির নীচে থাকতে থাকতে পোলাটার শ্বাসকষ্ট শুরু হইছে। তার মায়ের দোয়া দরুদ চলছে। গুলির আওয়াজ শুনে নিজের কানে হাত না দিয়ে পোলার দুকান ঢাকে। ময়েন উদ্দিন ভাই চেঁচায়, শালির বেটি ! গুলির শব্দ শুনে কাঁন্দিস। আর্মি গো কাম নাই। তোর কুঁড়েঘর কামানের লক্ষ্য হইছে। তবুও জমিলার কাঁপুনি থামে না। বেকুপ মাইয়্যা। ময়েন উদ্দিন মুখে পটর পটর করলেও, গুলির আওয়াজ শুনে গতি বোঝার চেষ্টা করছে। শব্দটা কি আমাদের গ্রামমুখি? মরার পাখি এখনও ডাকতেছে।
সকালে উঠে শুনে, খলিলগঞ্জের উত্তর পাশটায় আগুন ধরাইছে। দোকানপাট, হিন্দুদের বাড়িঘর কোনটাই বাকি রাখেনি। অনেক হিন্দু ; পাকিস্তানি পতাকা ওড়ায়। তাও লাভ হয়নি। ভয়ে কেউ দিনের বেলাও বের হয়নি।
ছেলেটার শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। আম্মা, সরিষার তেলে সূরা ফুঁ দিয়ে দিছে। মালিশ চলছে। উন্নতি হয়। আবার ব্যথা বাড়ে। জমিলা খালি কাঁদে। এইভাবে কাঁদলে চোখের পানি আর থাকবে না।
আজ রাতেও পাখি ডাকছে। ঘুপুত ঘুক। হঠাৎ চিৎকার। ছোট ছেলেটার বুকের খাঁচা ওঠানামা করছে। নিঃশ্বাস বুঝি যায়। গুলির দুরুম দারুম শব্দে, কষ্টও বাড়ছে। জ্বরে বিলাপ বকছে। মা, ” ললিপপ, ললিপপ ! ” ওর মায়ের চোখের জল শুকায়ছে। খালি বকে এখন। ছেলেটার যেদিন জন্ম হলো, ওর বাবা তাড়াতাড়ি ওযু করে আযান দিয়েছিলো। আর আজ। কাঁদতেও পারেনা। বাবা হলেও বুকে পাষাণ বেঁধে রাখে। গাছের গুঁড়ির মতো শক্ত হয়ে থাকে।
ভাদ্র মাসের আকাল বৃষ্টিতে ছেলেটার প্রাণপাখি উড়ে গেলো। যুদ্ধ, বৃষ্টি, পানি, কষ্ট সব এক হয়ে গেলো। সেনারাও চলে গেলো। কারও বাড়িঘর ছারখার হলো, কারও হৃদয়। মাটি খোঁড়া চলছে। খুঁড়লেই শুধু পানি আর পানি। শুকনা জায়গা নাই। তবুও কোপানো চলছে। পাখির ঘুপুত ঘুক আওয়াজ আর কোপানোর শব্দ মিলেমিশে একাকার। আশ্চর্য এক কবর খোঁড়া চলছে। কাফনের কাপড় নাই। মায়ের শাড়িতে মুড়িয়ে কবর। মাথা আর পায়ের দিকে গিট দেয়া হয়েছে। বাবার কাছে ছেলের লাশ ভারি। কিন্তু বাচ্চাটার শরীর পাখির মতো হালকা।
কবর শেষে দেখি, আকাশ পরিষ্কার। হায় ! কী এক যুদ্ধ্ ! কী এক লাশ ! কী এক কবর! এক মায়ের বুক খালি করে আর এক মায়ের বুকে মিললো ঠাঁই।