ড. সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি :

( ভ্রমণকাহিনী)

বাংলার ঋতু রঙ্গে  ষড় ঋতুর কথা উল্লেখ থাকলেও আজ নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার বুক থেকে বেশ কয়েকটি ঋতুর উপস্থিতি আর উপলব্ধি করতে পারিনা।

কিন্তু পল্লী বাংলার বুক থেকে কিছুই হারিয়ে যায়নি । আজও চোখ চেয়ে দেখলে, কান পেতে শুনলে, পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি হয় পল্লী বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের ডালি। আবার স্থান বিশেষে এক এক ঋতু, তার রূপ-রস-গন্ধে  অনির্বচনীয় হয়ে ওঠে সেই জায়গায়। যেমন বসন্তের পুরুলিয়া। চারিদিকে রঙীন পলাশ, গাছের পাতার অপরূপ বাহার, পাখির ডাক, হালকা শীতল বায়ুর স্পর্শ -সবকিছু মিলিয়ে বসন্তের  ডালি সাজিয়ে লাল  পাথুরে মাটির দেশ পুরুলিয়া হয়ে ওঠে রূপবতী সুন্দরী। তার টানেই তিনদিনের জন্য ছুটে গেলাম পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ও তার সংলগ্ন মাটির বুকে। সমগ্র  পুরুলিয়া তন্নতন্ন করে  দেখার সখ অনেক  দিনের। করোনার  প্রভাব  বেশ  কমে গিয়েছিল নভেম্বর থেকে মার্চ  পর্যন্ত। কোলকাতা থেকে এলো  বড় পিসির ছেলে  বোম্বা আর ওর অধ্যাপক বন্ধু  প্রসেনজিত গায়েন,অন্যদিকে  আমার  আত্মীয় বটে।ওদের খুব  ইচ্ছা আমার  সদ্য কেনা  বালেনো  সুজুকি গাড়ি করে পুরুলিয়া  ঘুরবে। সময়টা গত বসন্ত। বসন্ত  মানেই বাঁকুড়া-পুরুলিয়া।     ভোরের আলো ফুটতেই আমরা  পাঁচ জন ( আমি, আমার স্ত্রী , আমার  পিসতুতো ভাই,ওর বন্ধু  আর আমার  গাড়ির ড্রাইভার সদানন্দ ) বেরিয়ে পড়লাম পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে। আমাদের  শহর খাতড়া   থেকে পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডির  দূরত্ব প্রায় ১২০ কিমি। সময় লাগলো   আড়াই   ঘন্টা। আগে  বলে রেখেছিলাম তাই হোটেল নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না।  রানিবাঁধ- ঝিলিমিলির জঙ্গল,  উচু নিচু মালভূমির পথ  আর লাল মাটির দেশে বসন্তের বার্তা বাহক ফুটন্ত পলাশের  অপরূপ রূপের বাহার উপভোগ করতে করতেই  সকাল ৮ টার   সময় পৌঁছে  গেলাম বাঘমুণ্ডি,সামান্য  বিরতি দিয়ে  সকালের  খাবার পর্ব সংক্ষেপে  সারলাম ,তারপর আবার  পথ চলা শুরু করলাম  ।  মুরগুমার – খয়রাবেড়া ড্যামের দিকে গাড়ি চলতে শুরু করল জঙ্গলমহলে মসৃণ স্বপ্নের রাস্তা ধরে। রাস্তার দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পলাশের অযাচিত অভ্যর্থনায়  মুগ্ধ  হলাম।

অযোধ্যা থেকে দূরত্ব মাত্র ২৫-৩০কিমি। প্রথমেই  পেলাম মনোমুগ্ধকর  খয়রাবেড়া  ড্যাম। তিনদিক সবুজপাহাড় দিয়ে ঘেরা জঙ্গলময় এলাকার মাঝে স্বচ্ছ নীল গভীর জলাধার – নাম খয়রাবেড়া ড্যাম। অনেকেই বলেন, ড্যাম নির্মাণের আগেই এটি নাকি একটি প্রাকৃতিক হ্রদ ছিল। একপাশে যতদূর চোখ যায় সঘনসবুজ বিস্তীর্ণ উপত্যকা আর সুনীল দিগন্ত । পড়ন্ত বিকেলের সূর্যালোকে সে যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। চারিদিকে তখনও অন্যকোন পর্যটক আসেনি। আমরাই রূপবতী খয়রাবেড়ার রূপ আস্বাদন করলাম।

আর  কবির লেখা কয়েকটি কলি মনে এল -খৈরাবেড়ার টল্টল্যা জলে,

মন ডুবেনছে কন তলে;

ভালুককুচা লদী লহে,
থির জলটা নাই বহে।
পাহাড় জঙ্গল আর জলে
মন ডুবেনছে কন তলে!

কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর , সূর্যের আলো নিভে  যেতে  লাগলো। । খয়রাবেড়া সাঁঝের অন্ধকারে ঢেকে নিতে লাগলো   নিজের মুখ। হাতে  সময়  খুব  কম। এরপর  আমাদের গন্তব্যস্থল  রূপসী  মুরগুমা। মুরগুমা লেকের উদ্দ্যেশে চলা শুরু করলাম । রাত কাটাবো ঐ খানের সেচ বিভাগের গেস্ট হাউসে । বেগুনকোদর   বাজার থেকে দূরত্ব তিন কিমি। বাজার ছাড়াতে  ধুলো ওড়া পথ। পথ ছবিতে সবুজের সঙ্গে আদিবাসী মানুষজনের ঘর-দুয়ার।ঝলক দর্শনেই মেলে স্হানীয়দের রোজ নামতার ছবি। গ্রাম ফুুঁড়ে় রাস্তা উঠেছে  বাঁধের উপরে। অবশেষে মুখোমুখি হলাম মুরগুমার সঙ্গে । সাহেবজোর নদীর উপর কৃত্রিম লেক। সবুুুজে ঘেরা এই লেকের দৃশ্য অতুলনীয়। একটি, দুটি পাহাড়    ঢুকছে দৃশ্যমান হয়ে।     আর দূরে সর্ষে ফুলের খেতটি যেন, পাহাড়ের পায়ের উপরে মেলে দেওয়া হলুদ  বর্ডারে সবুজ শাড়িটি মাঘের রৌদ্রে শুকোচ্ছে।   পথের ধারে  পাহাড়তলিতে শিমুল-পলাশেের দাবানল। দূরে দলমা পাহাড়ের হাতছানি। গোধূূলির আলোয় মুরগুমা  বড় মায়াময়, অপার্থিব সুন্দর।  মায়াবী নীলাঞ্জন মাখানো ছবির মতো সুন্দর।অনায়াসে কাটিয়ে  দেওয়া যায়  গোটা রাত। রাতের খাওয়ার শেষ হলো দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে। সবাই চলে এলাম লেকের পাড়ে। সৌভাগ্য বশত দিনটি ছিল ভরা চাঁদের রাত।  এক মায়াবি জগৎ।মন ছুঁয়ে যায়় কল্পলোকে।পরতে পরতে প্রকৃতির অকৃপণ উজাড়  করা অপার সৌন্দর্য্য।আমরা লেকের  অন্যপ্রান্তে  চলে এলাম । রাতে দৃশ্যমান হল দলমারেঞ্জ। মৌনতার নীরব সাক্ষী।  মায়াবী চাঁদের আলো এখানে পথে পথে আল্পপনা এঁকে এঁকে চলেছে।রাত গভীর থেকে গভীরতর হলো। ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম সকলে। ভাবছি,এবার তো ফিরে যাওয়ার পালা। নতুন সকালের জন্য অপেক্ষা।সময় যেন কিছুতেই কাটছে চাইছে না। পরেরদিন, নতুন ভোরে এক অন্যরূপ দেখলাম মুরগুমার। শান্ত,স্নিগ্ধ। ভোরের  সূর্যোদয়ের দৃশ্য এককথায় অতুলনীয়।টিফিন করে

চড়িদা গ্রামের পথে—
চড়িদা মুখোশ গ্রাম নামেই পরিচিত । ছৌ-ঝুমুরের দেশ পুরুলিয়া। পুরুলিয়া এসে বাঘমুন্ডির চড়িদা গ্রাম না ঘুরে গেলে কোথাও যেন জেলার হৃদস্পন্দন বোঝা যায় না! ছোট বড় সকলেই হাতে হাত লাগিয়ে পারিবারিক জীবন জীবিকায় সাহায্য করছেন। শিল্পীর হাতে তৈরি মুখোশ জীবন্ত হয়ে উঠছে। গ্রাম বাংলার এক সমৃদ্ধ কুঠির শিল্প আজও মাথা উচু করে নিজের মাহাত্ম্য বজায় রেখেছে। চড়িদা-য়  মুখোশ তৈরীর  একটি দোকানে এসে কিছু  মুখোশ দেখলাম, দুটি  কিনলাম।
সময়  নষ্ট না করে  আমরা বেড়িয়ে পড়লাম অযোধ্যার উদ্যেশে। ৩০মিনিট   সময় লাগলো অযোধ্যা হিলটপে পৌঁছাতে। যুব আবাসে যেহেতু খাবার ব্যবস্থা নেই, আমরা হিলটপের একটি হোটেলে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে চলে গেলাম যুব আবাসে।
অযোধ্যার বুকে যুব আবাস সত্যিই এক সুন্দর থাকার আস্তানা। কিন্তু দেখভালের অভাবে তার গরিমা হয়তো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। স্বল্প টাকার বিনিময়ে যুব আবাসের পরিকাঠামো যতটা ভাল, পরিষেবা ততটাই খারাপ। তাই একটু মানিয়ে নিতে পারলে কয়েকদিন দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায়।
অযোধ্যায় প্রথমদিন আমরা কাছাকাছি কিছু জায়গা যেমন, মার্বেল লেক, বামণি ফলস, ময়ূর পাহাড়, লোয়ার ও অপার ড্যাম দেখে নেব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু রাস্তায় নেমে মনে হলো এই পরিকল্পনা আমাদের সাথে পশ্চিমবঙ্গ তথা ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যারও বহু মানুষ করে ফেলেছেন। রাস্তা জুড়ে শুধু গাড়ি আর বাইকের লাইন। অযোধ্যাকে যে এত মানুষ ভালোবেসে ফেলেছেন তা দেখে যেমন ভাল লাগলো, গাড়ির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ততটাই বিরক্ত লাগলো। রবিবার হওয়ায় স্থানীয় মানুষের পিকনিকের ভিড়ও ছিল প্রচুর। শেষ পর্যন্ত আমরা শুধু মার্বেল লেক দেখে আর বামণি ফলসের কয়েক ধাপ নেমে, ডাবের জল খেয়ে মাথার বদলে পেট ঠান্ডা করে আবার হিলটপে ফিরে আসতে বাধ্য হলাম।
দুপুরে লাঞ্চ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোলাম হিলটপের দিকে চা খেতে। সেই সময় আবিষ্কার করলাম যুব আবাসের মেন গেটের ঠিক সামনেই একটি খাবার হোটেল আছে যেটা প্রথমে বন্ধ মনে হয়েছিল। ওখানে আরো লোকজন কে দেখে জানলাম যে উনাদের কাছে আগে থেকে অর্ডার করলে উনারা খাবার বানিয়ে দেন। পরিচয় হলো হোটেলের মালিক শম্ভুদার সাথে (শম্ভুদার ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি, তবে যুব আবাসে অফিসে উনার নাম্বার চাইলে পেয়ে যাবেন এবং উনাকে ফোনে অর্ডার দিলে উনি রুমে খাবার ডেলিভারি করেন)। শম্ভুদার সাথে আলোচনা করে ঠিক হলো যে আমরা দেশী মুরগী কিনে এনেদিলে উনি সেটা রান্না করে দেবেন আর রুটি বানিয়ে দেবেন। উফ! আর কি চাই। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম দেশী মুরগীর সন্ধানে আর হিলটপের কাছেই একটা দোকানে পেয়েও গেলাম। বলাই বাহুল্য যে সেখানেও লম্বা লাইন! অবশেষে দিনটা গরম গরম দেশী মুরগী আর রুটি দিয়েই  দুপুরের খাবার পর্ব শেষ করলাম।

হিলটপের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে শুরু  হলো আমার  মন খারাপের পালা l বছর কুড়ি আগে যে অযোধ্যাকে দেখেছিলাম সবুজে অবগুন্ঠিতা সুন্দরী যুবতীর মত, সরল -সাদা অথচ রহস্যময়ী | তার ব্যক্তিত্ব সেদিন কি গভীর আকর্ষণীয় ছিল l আজকের অযোধ্যা  হৃত যৌবনা এক নারী । জঙ্গল কেটে তৈরি  হয়েছে  অজস্র   লজ,রিসোর্ট। অনেকে  আবার  সগৌরবে  নামের সঙ্গে  ইকো শব্দটি জুড়ে দিয়েছেন। এমন নির্মম ভাবে  জঙ্গল কেটে নেওয়ায় অযোধ্যার   প্রাকৃতিক সৌন্দর্য  অনেক খানি  নষ্ট হতে বসেছে।  অযোধ্যা  সুন্দরীর সারা শরীরে কালশিটে  দাগের মতো অনন্ত পিচঢালা  মসৃণ রাস্তা দিয়ে    অসংখ্য  গাড়ি চলছে  সব সময়  কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে।সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে  বিকেলে  সামান্য  চা- বিস্কুট  খেয়ে  সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সাইটসিন দেখতে l  কুশপল্লীর- কাছেই লোয়ার ড্যাম আর লহরীয়া শিব মন্দির দেখে আমরা চললাম আপার ড্যাম দেখতে l আপার ড্যাম এর স্থানটি বেশ ভালো সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত l লেকটাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে গ্রুপ ছবি , সেলফি আরো কত কী l আমার চোখ খুঁজছে জঙ্গল মূর্মুকে l আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন বন্ধু  তাপস  আর আমি প্রথম এসেছিলাম এই অযোধ্যা পাহাড়ে, সেই সময় দেখা জঙ্গল মূর্মুর সঙ্গে l এই পাহাড় জঙ্গলের গভীরে তাকে জন্ম দিয়েই তার মা মারা গিয়েছিল কিংবা হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল, চিরদিনের জন্য এই সবুজ প্রকৃতির অন্তরালে l সে কথা কেউ নিশ্চিত করে আর বলতে পারেনি l এই পাহাড় বনানী তাকে মাতৃস্নেহে বড় করে তুলেছিল l আর সেও এই অরণ্যকেই  তার মা বলে ।অনেক  খোঁজাখুঁজির পরও  পেলাম না।কেউ  বলতে  পারল না যে,সে বেঁচে আছে  না মারা গেছে। মন খারাপের  বিকেল বেলায়  চললাম  মন ভালো করতে  মার্বেল  লেকের দিকে। অসাধারণ  সবুজ উপত্যকা আর মনোমুগ্ধকর পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে। চলছে, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম  জঙ্গল আর পাহাড়কে জড়িয়ে ধরে একটি রাস্তা ওপরে উঠে এসেছে। জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখলাম সবুজ উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য। বেশ কিছু সময়ের জন্য আমরা একটি ভিউ পয়েন্ট-এ  থামলাম ‌ । ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখলাম দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা আর পাহাড়। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড় ঘেরা বিশাল জলাশয়।টলটলে জলে  টইটুম্বুর। সূর্যের আলোতে
মায়াবী লাগলো। গোটা উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর রাস্তা আমাদের মুগ্ধ করলো।। পুরো পথটাতে প্রকৃতি তার উজাড় করা রূপ ঢেলেদিয়েছে। কখনো পাকদণ্ডী পথের গোলোক ধাঁধায় বেশ কয়েক বার ড্রাইভার পথ ভুল করলো।মনে হলো  অনেক গুলি পাহাড়ি রাস্তা যেন পাহাড় বেয়ে নেমে গিয়েছে কিন্তু পরে অনুভব করলাম আসলে ওটা একটিই রাস্তা। বেলা ৫টার সময় পৌঁছে গেলাম।সময় লাগলো প্রায় তিন ঘন্টা। একটি অসাধারণ বিনোদন কেন্দ্রের পাশে ও লেকের গাঁ ঘেষে  একটি লজে জিনিসপত্র রেখে আবার বেরিয়ে পড়লাম।

আসলে আমরা অযোধ্যা ভ্যালির সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না। একটু  সামান্য টিফিন সেরে চলেগেলাম লেকের একদম কাছে। সূর্য দেব ঢলে পড়েছে পশ্চিম দিগন্তে।ডুবন্ত সূর্যের আলোর ছটায় আর মোহময়ী হয়ে উঠলো মার্বেল  লেক ও উপত্যকা।  সূর্যাস্তের মুখে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।ব্যালকোণি থেকে দেখছি অপরূপা লেককে দু’চোখ দিয়ে। পূর্বদিগন্তের রক্তিমাভায় অপার্থিব শোভারঞ্জিত দৃশ্যাবলীতে বিমুগ্ধ, বিমোহিত হলাম।  রাতের খাবার পর্ব সারলাম। পরের দিন খুব সকালে লেকের নির্মল প্রকৃতির কাছে চলে গেলাম। উন্মুক্ত দিগন্তে পাহাড়গুলি অপরূপ গরিমায় দৃশ্যমান। চোখ-মন ভরে গেল সে স্বর্গীয় দৃশ্যে। সূর্য তখন অনেক উপরে উঠে গেছে। সেই নির্মেঘ সূর্যালোকে সবুজ উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য আমাদেরকে মুগ্ধ করলো।    অযোধ্যার মার্বেল   লেক আর সবুজ উপত্যকায় আমরা মজে গেলাম। ভীড় খুব বেশি ছিল না।
 গাড়ি এবার চলল মার্বেল লেকের উদ্দেশ্যে l  l সেদিনের সেই গ্রাম আজ আর গ্রাম নেই l চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা , পাকা দোকান আর ছৌ নাচের দোতলা মিউজিয়াম , সবকিছুতেই শহুরে জীবনের ছোঁয়া লেগেছে l বদলে গেছে মুখোশের চরিত্রগুলোও l হলিউডের  কিংকং জায়গা করে নিয়েছে পুরুলিয়ার ছৌ নাচে,  তৈরি হয়েছে তারও মুখোশ l ফিউশন আর কাকে বলে… তখনও বুঝতে পারিনি অবাক হওয়া আরো অনেক বাকি আছে আজকের এই অযোধ্যা পাহাড়ে l

সন্ধ্যেবেলা ম্যানেজারের সহকারি ছেলেটি এসে খবর দিল ছৌ নাচের আয়োজন করেছে হোটেলের অন্য বোর্ডাররা l হাজার টাকা দিলে আমরাও তাতে সামিল হতে পারি l সবাই রাজি হওয়ায় আমরা দারুন উৎসাহ নিয়ে চললাম ছৌ নাচ দেখতে l নাচের আয়োজন হয়েছে লহরীয়া শিব মন্দিরের মাঠে l সঞ্জয় দা ক্যামেরা নিয়ে তৈরি l আমাদের গাড়িতে মন্দির পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়ার জন্য আবার 200 টাকা আলাদা করে দিতে হলো lঅবশেষে শুরু হলো ছৌ নাচ l বেশ যাচ্ছিল , হঠাৎ শুনলাম পদকারের মধু মাখা , বাঁশ চেরা গলায় বলিউডের জনপ্রিয় হিন্দি গান উঠে এলো l তারপর দেখলাম টলিউড থেকে বলিউড কিছুই বাদ যাচ্ছে না l আর কী তার গলা, যেমন গমক, তেমন গিটকিরি l একেবারে ব্রহ্মতালুতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা মারছে l এরই মধ্যে একজন বৃহন্নলা এসে অহেতুক ধেই ধেই করে খানেক নেচে গেল l বলাই বাহুল্য তার এই আরোপিত অংশটুকুর ছৌ নাচের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই l তবু তার সেই অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি পারফরম্যান্সের যথেষ্ট সর্বনাশ করে গেল l আমার মনে পড়ছিল গম্ভীরা সিংহের কথা l আমি আর অনির্বাণ বোধহয় সর্বশেষ তার সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম l কলকাতায় ফিরে খবরের কাগজে দেখি তিনি আর বেঁচে নেই l হয়তো তার সঙ্গেই মরে গিয়েছিল অযোধ্যা পাহাড় আর ছৌ নাচের সহজিয়া অথচ দারুন সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর l আজকে এখানে এসে যা দেখলাম তাকে সেই মৃত সংস্কৃতি আর পরম্পরার দুষ্ট প্রেত ছাড়া আর কী বা বলবো l
 ততক্ষণে অযোধ্যা পাহাড়ের মাথার উপর রূপোর  রেকাবির মতন মায়াবীনি চাঁদ উঠেছে l আগামীকাল মাঘী পূর্ণিমা l কাল আমরা এখান থেকে চলে যাব  জয়চণ্ডী আর বড়ন্তিতে l আমি সেই চতুর্দশী চাঁদের দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম , ভাগ্যিস এই পাহাড় বনানীর মানুষজন আর ছৌ নাচের মতো তুমিও বদলে যাওনি ঝুটো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে.. পরের দিন  খুব ভোরে   অন্ধকারের মধ্যে  চললাম  জয়চণ্ডী  পাহাড়ের  দিকে। ঘন্টা দেড়েক সময়  লাগলো। হীরক রাজার দেশের শ্যুটিং  স্পট হিসাবে আজও বিখ্যাত  পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়।  পাশে জয়চণ্ডী  রেল স্টেশন।  ঘড়িতে সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা।  গাড়ি থেকে নেমে  পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম।     প্রথমে সিঁড়ির সংখ্যা শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম বটে তবে যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করলাম তার চারপাশের সবুজের বাহার দেখে মনটা ভরে গেল। সিঁড়ির দুপাশেই গাছের সমারোহে আলো ও ছায়ার খুব সুন্দর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সূর্যিমামা  এই গাছের মাঝেই উকিঁঝুকি মারছে। একটি গড় ও মন্দির অতিক্রম করে ওপরে এসে  প্রকৃতির সৃষ্টি এই পটভূমিতে যখন  দাঁড়ালাম তখন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। জয়চন্ডীর ওপর থেকে পুরুলিয়াকে এক স্বপ্নের জগৎ বলে মনে হয়েছিল। পুরো ছবির মত লাগছিল। মনে হচ্ছিল তখনই জলরং করতে বসে যাই। বসন্তের আকাশটা কে অনেকটা শরতের মত লাগছিল। পেঁজা তুলোর মত মেঘের আড়াঁলে রোদের লুকোচুরি খেলাটা ভালোই জমে উঠেছিল। বসন্তে ওরকম আকাশ দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষণ ওইখানে সময় কাটিয়ে পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পরের গন্তব্যস্হল বড়ন্তি । দূরত্ব কম -বেশি  ২০  কিমি, সময় লাগল আধ ঘন্টা। মসৃণ স্বপ্নের রাস্তা ধরে  আমরা চলেছি  মুরারি পথে।   মুরাডির কোলঘেঁষা পথ ধরে লেকের ডান দিক ধরে পৌঁছনো যায় বড়ন্তি পাহাড়ের ঠিক নীচে। আমরা ধীর পায়ে ওই দিকেই চললাম। শাল, পিয়াল, পলাশ, আকাশমণি, মহুয়া গাছের ঘন জঙ্গলে ঘেরা লালমাটির পথ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে  মৃদুমন্দ হাওয়ায় মন দুলে ওঠা বিচিত্র নয়। মাটির দেওয়ালে সুন্দর আলপনার কারুকার্য করা সাঁওতাল গ্রাম পিছনে ফেলে, শালুক-শাপলাভরা তালবেড়িয়া টপকে, জঙ্গলের পথে যাওয়াই সাব্যস্ত করলাম প্রথাগত পথ ছেড়ে। কিছুদূর যাবার পরেই একটা শিয়াল সামনের শুকনো খাঁড়ির ওপর দিয়ে ছিটকে লাফ্ফা দিয়ে অরণ্যে মিলিয়ে যেতে যেতে তার গভীর প্রতিবাদ জানিয়ে গেল। বলাবাহুল্য এসব দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী হবার জন্য তৈরী হয় না। ক্রমে পৌঁছে গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত নীল জলের দেশে। সকালে জলের গাঢ় নীল যখন চোখ ধাঁধাচ্ছে, ঠিক তখনই নিঃস্তব্ধ চরাচরে এক আকাশ অনাবিল অনাড়ম্বর সৌন্দর্য – বড়ন্তি  লেকের জলে রঙের রংকেলির ছন্দে প্রভাতী সূর্য তার উপস্থিতি জানান দিল। অবাক মুগ্ধতায় বেশ কিছুক্ষণ স্থাণুবৎ স্থানমাহাত্ম্য উপভোগ করে ফিরতি পথ ধরে দেখি সিরাজ ভাই মানে আমাদের গাড়ি চালক পথের ধারে এসে আমাদেরই জন্য অপেক্ষমান। আর তার সাথে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ‘ম্যাক্স’ – এক প্রমাণ সাইজের গোল্ডেন রিট্রিভার যে সারা সফর আমাদের মাতিয়ে রেখেছে – তাই ওর কথা উল্লেখ না করলে এই যাত্রার বর্ণনা অসমাপ্ত থাকে। গাড়ির কাছে যেতেই ওকে গৃহবন্দী করে আসার জন্য তীব্র অভিযোগ জানাতে ও কার্পণ্য করল না।একটু এগিয়ে গড় পঞ্চকোট পেরিয়ে – হাতি পাহাড়ের পাশ দিয়ে  –  গড়পঞ্চকোট ফরেস্ট  টপকে আমদের গাড়ি ছুটে চলল মসৃণ কালো পিচঢালা রাস্তা দিয়ে   মাইথনের দিকে,  আধ ঘণ্টার মধ্যে  পৌছলাম  মাইথনে। পথে সকলে  দুপুরের খাবার পর্ব সংক্ষেপে সারলাম । মাইনের মনোমুগ্ধকর  প্রকৃতির  কোলে  বেশ কিছুটা সময়  কাটালাম।শুধু  মুগ্ধতার আবেশ। এবার ফেরার পালা। এই অদূরভ্রমণ কাহিনী এখানেই শেষ হতেই পারত, কিন্তু প্রকৃতিদেবী আরো অকৃপণ ছিলেন; বিকেল গড়াতেই গাঢ় মেঘের জটাজাল আকাশ ছেয়ে বৃষ্টি নামালো অঝোর ধারে, মুহুর্মুহু ক্ষণপ্রভার চকিতচমক আর গাড়ির চালে খটাখট শব্দের তুফান।  সদানন্দ  বাধ্য হয়ে  নিরাপদ জায়গায়   গাড়ি দিল দাঁড় করিয়ে; আর আমরা চা পর্বের লোভে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মন চুবিয়ে নিলাম। ইতিমধ্যেই নিপুণ হাতে  বোম্বা  ক্যামেরাবন্দী করে ফেলেছে ভয়াল সুন্দরী সৌদামিনীকে। তখন বড় বড় শিলাখন্ড এপাশওপাশ ছাপিয়ে দূর আকাশের বহু ওপার হতে আমাদের চারিপাশে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। বহু বছর পর আবার শিল কুড়িয়ে টুপিতে জড়ো করার আনন্দে মনটা শৈশবের দোরগোড়ায় কড়া নেড়ে এল যেন। বৃষ্টি একটু ধরতে আবার শহরজীবনের ব্যস্ততার রোজনামচার দিকে কিছু ক্লান্ত অবয়ব জোলো হাওয়ার ঠান্ডা গায়ে মেখে ছুটে চলল অনন্তের টানে, প্রাত্যহিক জীবনের পানে। আর সাথে নিয়ে এল বড়ন্তির শেষ পলাশের রংধনু – জানিনা আবার কবে অতিমারীর কোপ টপকে এভাবেই পাড়ি জমাবো নতুন কোনো অজানা অচেনা পথে – অরণ্যে – আকাশের গানে…

পেলব প্রকৃতি ঝরিয়ে বেড়ায় বর্ষামেদুর রাত,
আগামী চৈত্রে আবার আসুক এমন বৃষ্টিপাত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে