সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি:
বুধবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভায় বড়োসড়ো রদবদল ঘটালেন প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদী। ৪ জন নতুন মন্ত্রী পেল পশ্চিমবঙ্গ। বাঁকুড়ার ডাঃ সুভাষ সরকার তাদের মধ্যে অন্যতম।
জেলা জুড়ে উচ্ছ্বাস। বাঁকুড়া তথা ভারতের ইতিহাসে গতকাল এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে,যা ঐতিহাসিক বললে মনে হয় কোন ভুল হবে না।স্বাধীনতার প্রায় ৭৫ বছর পর, এই প্রথম বাঁকুড়ার একজন সাংসদ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। এছাড়া খুব গর্বের বিষয় এই জেলার শালতোড়া বিধানসভা থেকে একসময় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বাংলার রূপকার ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় বিধানসভার বিধায়ক হয়েছিলেন । বাঁকুড়া লোকসভার প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া রেলওয়ে স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পেলেও এর আগে কেউ কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীত্ব পাননি। বাঁকুড়া লোকসভা থেকে নির্বাচিত, বাঁকুড়া শহরের স্বনামধন্য চিকিৎসক সুভাষ সরকার সেদিক থেকে ঐতিহাসিক ভাবে প্রথম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকলেন।এটা জেলাবাসীর এক আকাশ গর্ব।
তাঁকে শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছে জেলাবাসী । জেলা জুড়ে আনন্দের পরিবেশ। বহু ধরনের পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে ,” জেলার মানুষ কাজ দেখতে চায়, শুধুমাত্র ভাষণে আর বিশ্বাসী নন,” খাতড়া মহকুমা শহরে বসবাস কারী শিক্ষক অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় অকপটে জানালেন , ” দক্ষিণ বাঁকুড়ার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, আধুনিক যোগাযোগ থেকে বঞ্চিত, কাজের জন্য অন্য রাজ্যে চলে যেতে বাধ্য হয় বহু সংখ্যক মানুষকে , কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি দরকার, মুকুটমণিপুর রেল অত্যন্ত জরুরি, নতুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডাক্তার বাবু নিজের জেলার জন্য কিছু করুন, যাতে আমরা গর্ববোধ করতে পারি,” জেলা শহরের পরিচিত কবি শিক্ষক ভজন দত্ত মহাশয় নিজের অনুভবের কথা জানালেন–” গতকাল যখন সংবাদে তাঁর নাম শোনা যায়, তখন মনে হয়েছিল, তিনি বোধ হয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তরের দায়িত্ব পেতে পারেন। তবুও চিন্তা হচ্ছিল, এইসময়ে স্বাস্থ্য! আরেকটা সাংঘাতিক বিপর্যয়ের ঢেউয়ের মুখে তিনি কি করবেন, কি করতে পারেন, এসব ভাবনা আসছিলো।আজ সকালে দেখলাম, তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী (Minister of State in the Ministry of Education)করা হয়েছে!
সারাদেশের শিক্ষাও এখন ভয়ংকর বিপর্যয়ের মধ্যে। গতবছরের মার্চ থেকে ধরলে প্রায় দেড়বছর সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তালা ঝুলছে।ইউনিভার্সিটি, কলেজ,হাইস্কুল স্তরে অনলাইনে ‘কিছু’ পড়াশোনা চললেও প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরের অবস্থা খুবই খারাপ বলা যায়।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালা খুলিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আবার পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনাটাও কম চ্যালেঞ্জ নয়! এদিকে শিক্ষা আবার যুগ্ম তালিকায়।সংবিধান রাজ্য ও কেন্দ্র উভয়কেই শিক্ষা নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দায়িত্ব দিয়েছে।অনেক সময় এই নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে সংঘাত হয়েছে, উভয়ের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলে অবশ্য এটা কোনো সমস্যা নয়।দেখা যাক! শিক্ষাক্ষেত্রে বাঁকুড়া জেলার ঐতিহ্য সুনাম সম্পর্কে তিনি অবহিত, আশায় থাকলাম ভালো কিছুর প্রত্যাশায়। আশা করছি, আগামীদিনে বাঁকুড়া একজন পূর্ণ দায়িত্ব প্রাপ্ত ক্যাবিনেট মন্ত্রী পাবে। আশা করতে কী দোষ!
আপামর ভারতবাসীর সঙ্গে সঙ্গে বাঁকুড়া লোকসভার প্রতিটি নির্বাচকও এখন ডাঃ সুভাষ সরকার মহাশয়ের দিকে তাকিয়ে।” মোদীর মন্ত্রিসভায় সকলের প্রিয় ডাক্তারবাবু
নরেন্দ্র মোদীর ক্যাবিনেটের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাবিনেটে জায়গা পেলেন বাঁকুড়ার সাংসদ। জেলাবাসী খুব খুশি, জেলার মানুষের প্রত্যাশার পারদ ক্রমশ চড়ছে । বাঁকুুুড়া থেকে মুুকুটমণিপুর পর্যন্ত রেল লাইনের অনুমোদন করেন তৎকালীন রেল মন্ত্রী, বর্তমানের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জি। তারপর দক্ষিণ বাঁকুড়ার মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, অনেকের মতে জঙ্গলমহলের মানুষ বঞ্চনার শিকার, রেলের জমি অধিগ্রহণের সব ধরনের সহযোগিতা রাজ্য সরকার করলেও বাঁকুুুড়া – মুকুটমণিপুরের স্বপ্নের রেলপথ আজও অধরা। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলের মানুষকে এক সময় স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, কাজও কিছুটা এগিয়ে ছিল, তারপর অজানা কারণে সেই রেলপ্রকল্প এখন ঠাণ্ডা ঘরে পড়ে, জেলার ভূমিপুত্র, সদ্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডাঃ সুভাষ সরকারের কাছে দক্ষিণ বাঁকুড়ার মানুষের বড় দাবি থমকে যাওয়া রেল প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হোক। চিকিৎসক সুভাষ সরকার কাজের মানুষ। সোনামুখী শহরের শিক্ষক বিশ্বজিৎ মণ্ডল জানালেন, ” আমরা আশাবাদী, এই জেলার জন্য তিনি অবশ্যই কাজ করবেন “।
বাঁকুড়া জেলার জনপ্রিয় ডাক্তার সুভাষ সরকার আজও মাটির মানুষ। সকালের জলখাবারে চপ মুড়ি না হলে ঠিক যেন জমে না। ঘুরতে দারুণ ভালবাসেন। অবসর সময়ে সঙ্গী রবীন্দ্র সংগীত। চিকিৎসক সুভাষ সরকার ঠিক এতটাই মাটির কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন। অবশ্য চিকিৎসকের পাশাপাশি, আরও একটি বিশাল বড় দায়িত্ব তাঁর নামের পাশে বসিয়ে দেওয়া যায় এখন থেকে অনায়াসেই। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বছর সাতষট্টির সুভাষ সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল।
বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ সুভাষ সরকার চিকিৎসক হিসেবে শুধু বাঁকুড়া নয়, আশপাশের এলাকাতেও রীতিমত জনপ্রিয়। অবশ্য তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে রয়েছে একটা বিশেষ কারণ। কথিত আছে , মাত্র দুটাকায় রোগী দেখতেন তিনি একটা সময়ে। এই পরিমাণ ফিজ নেওয়া, কোনও পারিশ্রমিক না নেওয়ারই সমতুল্য। গরীব মানুষদের কথা ভেবে এত কম ফিজ নিয়ে দিনের পর দিন চিকিৎসার পরিষেবা দিয়ে গিয়েছেন তিনি হাসিমুখে।
চিকিৎসক সরকার বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। বাঁকুড়া খ্রিষ্টান কলেজ থেকে ফিজিক্স অনার্স এবং স্পেশ্যাল বায়োলজি। বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। পরে ধীরে ধীরে বাঁকুড়া শহরের বুকে নিজস্ব নার্সিং হোম চালু করেন তিনি। সুনামের সাথে চিকিতসা পরিষেবা দিয়ে চলেছে সেই নার্সিং হোম।
তবে রাজনীতিতে তিনি এসেছিলেন আরএসএসের হাত ধরে। সপ্তম শ্রেনী থেকেই আরএসএস সংগঠনে যোগ দেন তিনি। কলেজ জীবনে এবিভিপি রাজনীতি করেছেন। ছিলেন রাজ্যের এবিভিপি ভাইস প্রেসিডেন্ট। ২০১৩ সালে বিজেপিতে যোগ। রাজ্যের বিজেপি সাধারন সম্পাদক দায়িত্ব সালেছেন তিনি বহু বছর। পরে সামলেছেন রাজ্যের সহ সভাপতির দায়িত্ব। ২০১৪ সালে বাঁকুড়া লোকসভার প্রার্থী হয়ে লড়াই করলেও, জিততে পারেননি। ফের ২০১৬ সালে বাঁকুড়া বিধানসভার প্রার্থী হয়ে লড়াই করার সুযোগ দেয় দল, কিন্তু তখনও তিনি জিততে পারেননি।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হয়ে লড়াই করে জয়ের হাসি হাসেন তিনি। বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে বিজেপি সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। মন্ত্রী হিসাবে জেলার জন্য কি করেন, মানুষের প্রত্যাশা কি পূরণ করতে পারবেন? এই প্রশ্ন ঘুুরপাক খাচ্ছে পিছিয়ে পড়া দক্ষিণ বাঁকুড়ার মানুষের মধ্যে।