Oplus_131072

মো.আবুল কালাম আজাদ (রাজ কালাম) :

গত পর্বে লিখেছিলাম “সাংবাদিকতার নামে অপ-সাংবাদিকতা।”  সেই পর্বের আলোকেই আজকের শিরোনাম ” সাংবাদিকতা বনাম হলুদ সাংবাদিকতা। ” প্রকৃত সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখেই শুরু করছি। আর একটু পরিস্কার করে বলতে চাই, আমার এই লেখনীর মাধ্যমে প্রকৃত সাংবাদিকের সাথে হলুদ সাংবাদিকের পার্থক্য নিরুপণ করার চেষ্টা মাত্র।

প্রকৃত সাংবাদিক হিসেবে কাগজে কলমে যা পাই সেটা জানতে আমরা গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সচিব মো. শফিউল আলম স্যারের উদ্ধৃতি উল্লেখ করতে পারি। তিনি বলেন, আইনের ২(৮) ধারায় সাংবাদিক কথাটিকে ডিফাইন করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাংবাদিক অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যিনি প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার বা বার্তা সংস্থার কাজে একজন সার্বক্ষণিক সাংবাদিক হিসেবে নিয়োজিত আছেন অথবা উক্ত মিডিয়া বা সংবাদ সংস্থার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক, ফিচার লেখক, রিপোর্টার, সংবাদদাতা, কপিরাইটার, কার্টুনিস্ট, সংবাদচিত্র গ্রাহক, সম্পাদনা সহকারী এবং সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত কোনো পদকধারীগণও ইহার সাংবাদিক হিসেবে গণ্য হবে।

সেই অনুযায়ী, হাতে কলমে শিক্ষা, বিষয় ভিত্তিক যথাযথ প্রশিক্ষণ, উচ্চ শিক্ষা, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, বিনয়, বডি ল‍্যংগুয়েজ, স্মার্টনেস, ভাষা জ্ঞান, শব্দ চয়ন, ইনোভেটিভ মাইন্ড এসব গুলোই একজন ভাল মানের প্রকৃত সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্য বলে আমি মনে করি।

এখন আসা যাক হলুদ সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা কি?

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী হলুদ সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা বলতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনকে বোঝায়। এ ধরনের সাংবাতিকতায় ভালমত গবেষণা বা খোঁজ-খবর না করেই দৃষ্টিগ্রাহী ও নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হল সাংবাদিকতার রীতিনীতি না মেনে যেভাবেই হোক পত্রিকার কাটতি বাড়ানো বা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বাড়ানো। অর্থাৎ হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা  করার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি।

মার্কিন ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক ফ্রাংক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতার পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন:

সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়ে বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা।
ছবি আর কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার।
ভুয়া সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়া বিজ্ঞানমূলক রচনা আর তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার।

সম্পূর্ণ রঙিন রবিবাসরীয় সাময়িকী প্রকাশ, যার সাথে সাধারণত কমিক্স সংযুক্ত করা হয়।
স্র্রোতের বিপরীতে সাঁতরানো পরাজিত নায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি।

এখন একটি বিষয় যেটা নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়, এই হলুদ সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা কিভাবে প্রকৃত সাংবাদিকতা পেশাকে কলুষিত করছে এবং কিভাবে সমাজ, জাতি তথা দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

এই বিষয়ে লিখতে গিয়ে একটি জোকস ( কৌতুক) মনে পড়লো,জেলা থেকে ইন্সপেক্টর এসেছে গ্রামের একটা স্কুল পরিদর্শনে।
অষ্টম শ্রেনীর কক্ষে ঢুকলেন। এক ছাত্রকে প্রশ্ন করলেন।
পরিদর্শক : আমাদের দেশের রাষ্টপতি কে?
ছাত্র : শেখ হাসিনা।
পরিদর্শক : আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি প্রসিডেন্ট কে?
ছাত্র : প্রসিডেন্ট খালেদা জিয়া।
পরিদর্শক : তুমি ক্লাস এইটে উঠেছো কিভাবে ? আমি তোমার নাম কেটে দেবো।
ছাত্র : আমার তো স্কুলের খাতায় নামই নেই,আপনি কাটবেন কেমনে।
পরিদর্শক : নাম নেই মানে?
ছাত্র : আমি স্কুলের মাঠে গরু নিয়া আইছিলাম ,স্যারে কইলো তোরে দশ টাকা দিমু তুই ক্লাসে আইস্যা বইস্যা থাক।
পরিদর্শক : ছি: মাষ্টার সাহেব,আপনাদের লজ্জা করেনা!
শিক্ষা নিয়া ব্যবসা করেন? আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবো।
ক্লাস শিক্ষক : আরে আপনি আমাকে বরখাস্ত করতে পারবেন না, সামনে যে মুদি দোকানটা দেখছেন ঐটা আমার। মাস্টার সাবে আমারে কইলো শহর থেকে এক বেটা আইবো আমি হাটে গেলাম তুই একটু ক্লাস ঘরে যাইয়া বইসা থাকবি।
পরিদর্শক : ( রেগে হেড স্যারের রুমে গিয়ে ) আপনি হেড স্যার?
হেড স্যার : জ্বী,কোনো সমস্যা?
পরিদর্শক : কি করছেন আপনারা এসব,নকল ছাত্র-শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালান?
হেড স্যার : আমি না,আমার মামা এই স্কুলের হেড স্যার, উনি জমি কেনা-বেচার দালালী করেন।কাষ্টমার নিয়া অন্য গ্রামে গেছেন। আমারে কইলো ইন্সপেক্টর আইলে এক হাজার টাকার এই বান্ডিলটা দিয়া দিস।
পরিদর্শক : এই যাত্রায় আপনারা বেঁচে গেলেন।আসলে আমিও ইন্সপেক্টর না!
উনি ঠিকাদারীর কাজও করেন,টেন্ডার জমা দিতে সিটি কর্পোরেশনে গেছেন। আমাকে বললেন তুই আমার হয়ে পরিদর্শন করে আয়। জোকস্টির একটা বিষয় খেয়াল করলাম টপ টু বটম দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।

তেমনি প্রকৃত সাংবাদিকের যখন অভাব হয় তখন একটি সমাজ, একটি জাতি, একটি দেশ তখন রসাতলে যায়। যেমন ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই পরিস্কার হওয়া যাবে, এখন তো আবার ফেসবুক সাংবাদিক, ক্যাডার সাংবাদিক, (আরও অনেক নামে ডাকে তাদের আমি না হয় সেই ভাষা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলাম) সরকার দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আবাদি জমি খনন করা থেকে বিরত থাকতে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।  কেউ খবর দিল অমুক জায়গায় ভেকু দিয়ে পুকুর খনন চলছে, প্রথমে জানার চেষ্টা করে কার নেতৃত্ব খনন কাজ চলছে যদি শোনে অমুক নেতা যে মাঝে মাঝে ২০০/৫০০ টাকা দেয় তাহলে ওখানেই শেষ। আর জানতে ব্যর্থ হলে স্পটে যাবে, গিয়ে হুমকি ধামকি দিবে নিউজ করা হবে,ইউএনও, ভূমি সহকারী কমিশনার, থানায় জানান হবে। আবার ২০০/৫০০ দিলে ঠিক আছে সব ঠান্ডা কিন্তু সমঝোতা হলো না, সেখান থেকে গিয়ে ছোট করে ফেসবুকে একটা পোস্ট অমুক জায়গায় মাটি খননের মহা উৎসব চলছে, তারপর সেটা যখন খননকারীর দৃষ্টিগোচর হলো তার সাথে সমঝোতা হলো, তখন আরও অন্য গ্রুপ গেল এভাবে গ্রুপে গ্রুপে ম্যানেজ হয়ে চলে আসে, তারপর আবার প্রশাসনকে অবহিত করা হলো। প্রশাসন এসে জরিমানা করে ব্যাটারি খুলে নিয়ে গেল, আবার নেতা ধরে টাকা দিয়ে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ব্যাটারি ফেরত নিয়ে এসে কাজ শুরু হলো। তখন থেকে দফারফা হলো প্রশাসন এতো টাকা,থানা এতো টাকা, নেতা এতো টাকা, চেয়ারম্যান এতো টাকা, সাংবাদিক এতো টাকা। এই যে সিরিয়াল দুর্নীতি এটা ৯০% প্রকৃত সাংবাদিকের অভাবের কারণে। প্রকৃত সাংবাদিক যদি থাকতো একটি দুর্নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে এতগুলো জায়গা, এতগুলো মাধ্যম দুর্নীতি করার সুযোগ পেত না। (বিঃদ্রঃ – আমি শুধু তাদেরকেই বলছি যারা এমন দুর্নীতির সাথে জড়িত, সবাইকে একই কাতারে নয়)

পরিশেষে এটাই বলতে চাই যারা প্রকৃত সাংবাদিক তাদের উচিৎ হবে এমন হলুদ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে তাদেরকে প্রতিহত করা,  নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা। তাহলে নিজেদের সম্মান বৃদ্ধি পাবে, সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে, সমাজ, জাতি তথা দেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে