বিনোদ সরদার,দক্ষিণ ২৪পরগনা জেলা প্রতিনিধি:
প্রথম সন্তানের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে,শােক বা দুঃখ তাকে কর্মচ্যুত করতে পারেনি। বৈভব ও প্রাচুর্য তাকে আকৃষ্ট করেনি আত্মপ্রতিষ্ঠার চেয়ে সমাজপ্রতিষ্ঠার মূল্য তার কাছে বড়।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সহ সংসার পরিজন তাঁর বর্তমান। কিন্তু সে মায়া তার কর্মে বাধা সৃষ্টি করেনি। বরং সংসারকে উপেক্ষা করে তিনি জীবন ও সমাজের জন্য অনেক অযাচিত সেবা করেছেন। এমন মহামানবকে সুন্দরবনবাসি বিদ্যাসাগর উপাধি দিয়েছেন ভালোবেসে। জীবনজুড়ে সাধনা করেছিলেন শিক্ষা,স্বাস্থ্য, সমাজব্যবস্থা উন্নয়নের। রাজনৈতিক পরিসরে হৃদয়বৃত্তির সুষমা ও সুগন্ধ আজও মনে রেখেছে সুন্দরবনবাসি।
১৩২৯ সালের মাঘ মাসে উত্তর চবিবশ পরগনার সন্দেশখালি থানার খুলনা গ্রামে কৃষিজীবী পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শিক্ষাপ্রাণ বিনােদবিহারী গায়েন। বাবা রুদ্রনাথ গায়েন, মা পার্বতী গায়েন। শৈশব অবস্থাতেই বাবাকে হারিয়ে ফেলেন বিনােদবাবু। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় দু’চোখে ক্ষত দেখা যায়। বড়দাদা প্রয়াত বিপিনবিহারী গায়েন তাকে বহু ডাক্তার- কবিরাজ দেখালেন। অবশেষে কলকাতার ব্লাইন্ড রিলিফ ক্যাম্পে (বর্তমান চক্ষু হাসপাতাল) নিয়ে গেলেন। সেখানেও ভাল হল না। পরে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ কে.হাজরার কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি জানালেন, জন্ম থেকেই ডান চোখটা ত্রুটিযুক্ত ছিল। তিনি যথাসম্ভব ওষুধ ও চশমার ব্যবস্থা করেন। বললেন, পড়াশুনাে বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় চল্লিশ বছর বয়সে অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু পড়াশুনাের প্রতি অদম্য আগ্রহ থাকায় ডাক্তার হাজরার অজ্ঞাতে তিনি পড়াশুনাে চালিয়ে যেতে থাকেন। আবার ক্ষত দেখা দিতে থাকে। পুনরায় ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার বলেন, বােধ হয় পড়া বন্ধ হয়নি। বারবার ক্ষত হওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে নবম শ্রেণিতেই তার পড়াশােনার পাঠ চুকে যায়।
অলৌকিক কোনাে ঘটনা নয়। চোখের রােগের জন্য প্রথাগত শিক্ষা অর্জন না হলেও সুন্দরবন এলাকায় বাহান্নের অধিক বিদ্যালয় স্থাপন করে নবম শ্রেণির এই ছাত্রটি মানুষের কাছে হয়ে গেলেন শিক্ষাপ্রাণ বিনােদবিহারী। ১৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯ টি জুনিয়ার হাই, ২০ টি হাইস্কুল নিয়ে ৫২টি স্কুল গড়েছেন বিনােদবাবু। গােটা জীবন কেটেছে স্কুল গড়ার নেশায়।
খুলনা পিসি লাহা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি।মাত্র ৭বছর শিক্ষকতা করে স্কুল গড়ার নেশায় স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল ৪১ বছর সুন্দরবনের নদীবেষ্টিত দ্বীপগুলিতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নিরলস লড়াই চালিয়েছেন।
সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, গােসাবা, বাসন্তী, ক্যানিং প্রভৃতি এলাকায় হাজার হাজার ছাত্র এখন যে সব স্কুলে পড়াশুনা করে তার
বেশীর ভাগেরই প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাপ্রাণ বিনােদবিহারী গায়েন।
বিনোদ বাবুর কথায়, “রাজনীতির চেয়ে আমার কাছে বড় শিক্ষাবিস্তারের কাজ। শিক্ষা না হলে কোনও কিছুই করা যাবে না। তাই যতদিন শরীর সুস্থ ছিল ততদিন এই কাজকেই অগ্রাধিকার দিয়েছি।” তাই রাজনীতির বাইরেও এলাকার সব মানুষের কাছেই তিনি ভালবাসা আর শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি মনে করেছিলেন, কোনাে নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেকে শিক্ষকরূপে বন্দী রাখলে সুন্দরবনের বিভিন্নপ্রান্তে নিরক্ষর দরিদ্র কৃষিজীবী মানুষের জন্য বিদ্যালয় নির্মাণ সম্ভব হবে না। তাই নিজের ব্যক্তিগত শিক্ষকতা জীবন থেকে মাত্র ৭ বছর শিক্ষকতা করে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে নেমে পড়লেন স্কুল গড়ার নেশা।
যােগ দিলেন কংগ্রেস রাজনীতিতে, পরে অবশ্য মনোরঞ্জন শূর তাকে ১৯৬৬ তে সিপিআই তে যোগ দেওয়ান,তিনি কৃষক আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দেন। তেভাগা আন্দোলনের নেতা সিপিআই এর মনোরঞ্জন শূরের হাত ধরে তিনি তেভাগা আন্দোলনের শরিক হন।
তার রাজনীতির একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল সুন্দরবনের গ্রামগঞ্জে বিদ্যালয় স্থাপন ও রাস্তাঘাট নির্মাণ।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বিভিন্ন গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের দরজায় দরজায় হেঁটেছেন।
দরবার করেছেন ব্রহ্মচারী ভােলানাথ-এর সঙ্গে, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। ইংরেজিতে ড্রাফট লেখায়, তিনি ছিলেন সিদ্ধাহস্ত, একনাগাড়ে ইংরেজীতে বক্তৃতা করার অসামান্য দক্ষতা ছিল।
তৎকালীন সময়ে(১৯৬০ এর দশক) ৫০০টাকা মাসিক বেতনের ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের চাকরির অফার নসাৎ করেন। ১৪বছর আলিপুর জাজেস কোর্ট এ জুরির বিচারক ছিলেন তিনি।
জাতীয় কংগ্রেসের থেকে টানা ১৫ বছর সন্দেশখালি ইউনিয়ন বোর্ড এর নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেন খুলনা হসপিটাল,শুধু তাই তৎকালীন সময়ে কলেরা রোগীর সেবা, অসহায় দুঃস্থ ছাত্রদের বই, খাতা,পড়ার খরচ যোগানো থেকে শুরু করে গ্রন্থাগার নির্মাণ ও নানান সমাজ কল্যান কাজে নিবেদিত ছিলেন তিনি।
১৯৭২ এর বিধানসভা নির্বাচনে হিঙ্গলগঞ্জ কেন্দ্রে সিপিআই ও কংগ্রেস জোটের প্রার্থীও ছিলেন তিনি। সিপিএম ২টি ব্যালেট বাক্স জলে ফেলে ব্যাপক কারচুপি করে, মাত্র ১০০০ভোটে পরাজিত হন বলে স্থানীয় সূত্র ও তার জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়।
বহুছাত্রকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করার পথ সুগম করেছেন তিনি। তার কৃতী ছাত্রদের মধ্যে আছেন- ভারত সরকারের রেলওয়ে ইলেকটিফিকেশনের ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার অনিলরতন পড়ুয়া। ইনি বর্তমানে অবসর নিয়ে সল্টলেকে বসবাস স্থির করেছেন। দক্ষিণ বারাসাত ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজের অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র মন্ডল। লক্ষ্মীকান্তপুর বিরেশ্বরপুর গৌরমােহন-শচীন মণ্ডল কলেজের অধ্যাপক মনােরঞ্জন মন্ডল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের ডেমনস্টেটর বঙ্কিম মণ্ডল,কালিনগর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শশাকেশেখর মণ্ডল। ইনি পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের সেচবিভাগের মন্ত্রী মাননীয় গণেশচন্দ্র মণ্ডল। ডায়মন্ডহারবার ফকির চাঁদ কলেজের অধ্যাপক অতুলানন্দ রায়। বিপ্রদাসপুর হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক হাজারীলাল মণ্ডল। কার্তিকপুর উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ভবেন্দ্ৰপ্ৰসাদ ঘােষ, বর্তমান কলকাতা নিবাসী জ্যোতি ভট্টাচার্য্য (ইনি প.ব.সরকারে একসাইজ ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ইনস্পেকটর ছিলেন), সােনারপুরের ব্যাংক কর্মী পুলিন মণ্ডল, রেলওয়ে দপ্তরের কর্মী অরবিন্দ মণ্ডল, বসিরহাট কলেজের ল্যাবরেটরী-ডেমনস্ট্রেটর সুনীল সরকার।
শিক্ষকতা জীবনের শুরুতে (১৯৪১ সাল) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজের বাইরে বিভিন্ন এলাকায় যেখানে বিদ্যালয় নেই সে সমস্ত স্থানে বিদ্যালয় গড়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন বিনোদবাবু। ১৯৪৫ সালে দক্ষিণ খুলনা জুনিয়র হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার কাজও চলে। সমকালেই কন্ট্রোলের খাদ্য বিলির জন্য একটি ফুড কমিটি গঠিত হয়েছিল। এতে সন্দেশখালি ইউনিয়নের সেক্রেটারী হয়েছিলেন তিনি।
বিন্দবাবুর কথা লােকের মুখে মুখে এখনও ঘোরে, “শিক্ষা মূলতঃ নির্ভর করে বংশ প্রভাব ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর। এই উভয় ব্যাবস্থা কোনটাই অনুকূল নয় তপশিলি ও আদিবাসীদের। তাই ভীষন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ও তপশিলী ও আদিবাসী এবং অনুন্নত সম্প্রদায়কে শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত করতে হবে নইলে মুক্তি নেই”।
জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে বিনােদবাবু ভেবেছেন ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বলে গেছেন “আমরা যারা গ্রামে বাস করি তারা সবাই কৃষক বললেও চলে। তাদের যদি সর্বাঙ্গীন কল্যাণ না হয়, তবে কার কল্যাণ হলাে? বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত প্ৰথায় কালটিভেশনের সঙ্গে সম্পর্ক ইরিগেশনের, ইরিগেশনের সঙ্গে সম্পর্ক ইলেকটিফিকেশনের এবং ইলেকট্রিফিকেশনের সঙ্গে সম্পর্ক কমিউনিকেশনের। এর জন্য দরকার প্রচুর অর্থের। সেই অর্থ কে দেবে?” সংসারী হয়েও সন্ন্যাসী ছিলেন তিনি। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-সংসারের দেখভাল উপেক্ষা করে তিনি অনায়াসে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের মধ্যে। এসেছে অনেক বাধা ও আঘাত। বহু কষ্টে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে গড়ে তুলেছিলেন ব্লক হসপিটাল। তিনি পরিকল্পনা করেছিলেন কলকাতা থেকে সড়বেড়িয়ার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে সরাসরি সরবেড়িয়া এবং বাসন্তী পর্যন্ত যদি রেললাইন বসানাে যায় তাহলে বিস্তীর্ণ কৃষিভূমির, কৃষক ও কৃষির উন্নতি হবে বলে তিনি মনে করতেন। শেষ বয়সে ও তিনি সেকথা ভেবে আফশোষ করেছেন, মানুষের জন্য কিছুই তাে তেমন করতে পারলাম না,সেই রাজনৈতিক ক্ষমতাও আমি অর্জন করতে পারিনি। তপশিলি ও আদিবাসী সেই আঁধারেই পড়ে রইলো।”
সরকারি কোনাে পুরস্কার না পেলেও পেয়েছেন মানুষের শ্রদ্ধা ও সাহায্য এবং ভালােবাসা। সুন্দরবনের প্রতিটি গ্রামে শিক্ষাপ্রাণ বিনােদবিহারী গায়েন এক পরিচিত নাম। তাঁর বড়পুত্র শ্যামল গায়েন স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, সম্প্রতি তিনি সেই ভোলাখালি আদিবাসী শিক্ষানিকেতন থেকে অবসর নিয়েছেন।
ছােটপুত্র মহীতােষ গায়েন কলকাতার সিটি কলেজে ইতিহাসের নামকরা অধ্যাপক, কবি ও সাংবাদিক। ছোটকন্যা সুমিত্রা বসিরহাটের একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা।মেজ কন্যা সুচিত্রা বাড়িতে বর্তমান, বড়কন্যা গৌরীও মোল্লাখালী বিটিসি বিদ্যামন্দির স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফনীন্দ্র নাথ হালদারের স্ত্রী।পুত্র, কন্যা,নাতি নাতনি ও ২৪পরগনা তথা সুন্দরবনের মানুষকে শোকসাগরে রেখে নিজ বাসভবনে বিগত 31শে জানুয়ারি 2011 সালে এই সংসার-সন্ন্যাসী পরিনির্বান প্রাপ্ত হন,সুন্দরবনবাসি অভিভাবক হারালেন।
সুন্দরবন সহ গোটা চব্বিশ পরগণা তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ শিক্ষাপ্রাণ’ এই মানুষটির কথা কখনই ভুলতে পারবে না। তাই শুধু সুন্দরবন নয় ২৪ পরগনার দল মত নির্বিশেষে আমজনতা রাজ্যের বর্তমান সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছেন যে শিক্ষাপ্রাণ এই মহান বিনোদ বিহারী গায়েনের নামে সুন্দরবন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজ প্রতিষ্ঠা করুক সরকার এবং রাজ্য সরকার তাকে মরনোত্তর শিক্ষারত্ন প্রদান করে তার এই মহৎ বিরল অবদানের মর্যাদা দিক । সাথে সাথে রাজ্যবাসী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছে যে তাকে মরনোওর পদ্মশ্রী প্রদান করে যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করুক কেন্দ্রীয় সরকার। সুন্দরবনের মানুষ সেই আশায় বুক বেঁধে আছেন আজও অনন্ত।