Dhaka ১২:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে বৈশাখ

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৪:২০:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৯ Time View

হাজার দুয়ার খুলে ভোরের কিরণমালায় এসেছে বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস। বাঙালির বর্ষপঞ্জির আবাহনী জাগানো মাস। প্রকৃতি ও মানুষকে সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে উদ্বেলিত করার মাস বৈশাখ। এসো হে বৈশাখ, এসো হে, ধ্বণিতে মুখর পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের মাহেন্দ্রক্ষণ আজ।

বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস বৈশাখ বাঙালির প্রাণের মাস হয়ে নতুনের বার্তা নিয়ে আসে। প্রতিটি প্রাণে আনে সৃষ্টির উল্লাস। সৃজন করে মঙ্গলের ধ্বণিপুঞ্জ। পুরনো মলিন মুছে নতুনের বরাভয় জাগানিয়া শুভাশীষ হয়ে আসে বৈশাখ আবহমানের বাংলা ও বাঙালির চিত্ত, চিন্তা ও চৈতন্যে।

বৈশাখ মানেই নতুন সূচনা, ফসলের মাঠে সবুজের সমারোহ, প্রকৃতিতে শ্যামল ছোঁয়া আর মানুষের মনের আঙিনায় প্রাণচাঞ্চল্য। সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে বৈশাখ—এই পঙক্তিতে যেন বৈশাখের সম্পূর্ণ চিত্র ধরা দেয় প্রকৃতি ও মানুষের রাখিবন্ধনে।

সবুজে বৈশাখ

বাংলার প্রকৃতি এই সময়ে নতুন করে সাজে। আগের চৈত্র মাসের তীব্র খরার পর একটুখানি বৃষ্টিতে শস্যের মাঠে ফোটা কচি পাতায় সবুজের ঘন ছায়া নামে। কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। মানুষের মনে জাগে শিহরণ। কারণ এই সময়টাতে শুরু হয় নতুন করে জীবনের শুরু আর চাষাবাদের প্রস্তুতি। সবুজ প্রকৃতি শুধু চাষবাসেরই প্রতীক নয়, এটি জীবনের নবজাগরণেরও প্রতীক। গ্রাম থেকে নগরের চৌহদ্দি জুড়ে বৈশাখ রাঙিয়ে দেয় চিরায়ত বাংলাকে, শাশ্বত বাঙালিকে।

শ্যামলে বৈশাখ

শ্যামল মানে হল গভীর সবুজ, যা বাংলার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের পরিচায়ক। বৈশাখে গ্রীষ্মের দাবদাহ থাকলেও মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব। ফলত গাছপালার রং হয় আরও ঘন সবুজ, শ্যামল। এ সময় কাঁঠাল, আম, লিচুর গাছে পাকা ফলের ঘ্রাণে বাতাস ম ম করে। গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে এটি এনে দেয় আনন্দ ও সন্তুষ্টি। সঘন সবুজের প্রলেপে মানুষ ও প্রকৃতি অনির্বচনীয় বৈভবে ঋদ্ধিমান হয় পহেলা বৈশাখে, পুরো বৈশাখ মাসের দিনগুলোতে।

প্রাণের পরশে বৈশাখ

বৈশাখের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার উৎসবমুখর পরিবেশ আর জীবনমুখী চৈতন্য । পহেলা বৈশাখে বাঙালি জাতিসত্তা নানা আচার-অনুষ্ঠানে নিজেদের সংস্কৃতিকে নতুন করে ধারণ করে। শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা, লোকসঙ্গীত, লোকজ খেলা—সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বৈশাখী জনজীবন। বৈশাখ শুধু একটা ঋতুর পরিবর্তন নয়, বরং পুরনো বছরের জীর্ণতা মুছে এক নতুন প্রাণের উন্মেষ। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বৈশাখের উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই নব রবি কিরণে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহে বৈশাখ

বৈশাখ যেমন প্রাকৃতিকভাবে নবজীবনের প্রতীক, তেমনি সাংস্কৃতিকভাবে জাতিসত্তার পরিচয়ও বটে। বাংলা নববর্ষ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করায় লোকসংস্কৃতি ও লোকসংগীতের পরম্পরায়। বৈশাখে বাঙালি অনুভব করে মৃত্তিকার ছোঁয়া, শেকড়ের টান। সবুজ ও শ্যামল প্রকৃতির মাঝে বৈশাখ বাঙালির ঐক্য, চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা বহন করে সর্বজনীন উৎসবমুখর আয়োজনমালার দ্যুতিময় উদ্ভাসনে।

বাংলা, বাঙালির জীবন, সংস্কৃতিতে বৈশাখ

বৈশাখ মাস বাংলা ও বাঙালির জীবনে শুধু একটি ঋতু পরিবর্তনের সময় নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ও অর্থনৈতিক পুনর্যাত্রার পর্যায়। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষ বৈশাখের সাথে যুক্ত করেছে তাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে। চৈত্রের শেষদিনে বিগত দিনের হিসাবের খাতা মিলিয়ে ভবিষ্যতের রূপকল্প রচনা করা হয় বৈশাখী হালখাতার ঐতিহ্য ও আনুষ্ঠানিকতায়।

বৈশাখের অর্থনৈতিক প্রভাব

বৈশাখ মাসের শুরুতেই বহু ব্যবসায়ী হালখাতা উদযাপন করেন। এটি নতুন অর্থবছরের সূচনা, যেখানে পুরাতন দেনা-পাওনা মিটিয়ে নতুন খাতা খোলা হয়। ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের মধ্যে এ সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাশাপাশি, বৈশাখী মেলার মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যও চাঙ্গা হয়। গ্রামীণ ঐতিহ্য ও কুটির শিল্প পায় মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার রসদ।

বৈশাখের সাংস্কৃতিক প্রভাব

পহেলা বৈশাখ বাঙালির অন্যতম প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই দিনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, লোকনৃত্য, পল্লীগীতি, বাউল সঙ্গীত ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির লোকসংস্কৃতি নতুন প্রাণ পায়। শহর ও গ্রামে এই সময় যে উৎসবমুখরতা সৃষ্টি হয়, তা বাঙালির ঐক্য ও সংস্কৃতির গভীরতা প্রকাশ করে। আদি ও অকৃত্রিম বাঙালিয়ানার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাঙালি এগিয়ে আসার প্রত্যয় ও প্রতীতি পায় বৈশাখে। বিশ্বায়নের তোড়ে আসা অপসংস্কৃতির আবর্জনা সাফ করে দেওয়ার প্রেরণাও জাগ্রত করে বৈশাখ।

শেকড়ের পানে ছুটে চলার বৈশাখ

বৈশাখ পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং মিলনের এক অনন্য উপলক্ষ। সবাই মিলে আনন্দ ভাগ করে নেয়—নতুন জামাকাপড় পরা, ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়া (পান্তা-ইলিশ), মেলা ঘোরা—সব মিলিয়ে এক সার্বজনীন মিলনমেলা তৈরি হয়। মাটির টানে শেকড়ের পানে ছুটে চলার দিন পহেলা বৈশাখ। বিশ্বায়নের স্রোতে নিজেকে হারিয়ে বার বার সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের মধ্যে আত্মপরিচিতি পাওয়ার নাম পহেলা বৈশাখ, বৈশাখে বাংলা বর্ষবরণ।

সাহিত্য ও শিল্পকলায় বৈশাখ

বৈশাখ বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের অনুপ্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক কবিরাও বৈশাখকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য কবিতা, গান ও চিত্রকর্ম। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গানটি এক প্রতীক হয়ে উঠেছে নবজাগরণের। অসংখ্য কবিতা ও গানে চিত্রিত হয়েছে বৈশাখের অপার মহিমা। সুর ও তালের যুগলবন্দিতে বৈশাখ বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক পাটাতনকে করেছে ছন্দ ও সুষমাময়।

জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় জীবনের গৌরবময় অংশ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে বাঙালিত্বের ঠিকানায় একত্র করে বৈশাখ। বাঙালির আত্মপরিচয় ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বৈশাখ এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্তম্ভ। জাতীয় একতা, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব,সহাবস্থানের মর্মবাণী ধারণ করে বৈশাখ। বাংলা ও বাঙালির অবিচ্ছেদ্য আইকন বৈশাখ বৃহত্তর বাঙালির এক নান্দনিক সম্মিলনী হয়ে সমুন্নত করে জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।

সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে বৈশাখ—মানে বাংলাদেশের এবং বিশ্বময় বাঙালির কাছে প্রকৃতির রূপ, জীবনের গতি, আত্মপরিচিতির অন্ষেণ এবং সংস্কৃতির উৎসবমুখরতা। বৈশাখ যেন এক অনন্য বৈভবের প্রতিচ্ছবি, যা প্রকৃতি ও মনুষ্যজগতকে এক অভিন্ন সূত্রে গেঁথে দেয়। বাঙালির কাছে বৈশাখ কেবল ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়, এটি বাঙালির আত্মার আবেগ। বাঙালির বর্ণময় জীবনের দিগন্তে এক নতুন সূর্যোদয় নিয়ে প্রতিবছরের প্রতিটি বর্ষবরণে বৈশাখ ফিরে আসে সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশ নিয়ে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Raj Kalam

Popular Post

সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে বৈশাখ

Update Time : ০৪:২০:৫৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৫

হাজার দুয়ার খুলে ভোরের কিরণমালায় এসেছে বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস। বাঙালির বর্ষপঞ্জির আবাহনী জাগানো মাস। প্রকৃতি ও মানুষকে সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে উদ্বেলিত করার মাস বৈশাখ। এসো হে বৈশাখ, এসো হে, ধ্বণিতে মুখর পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণের মাহেন্দ্রক্ষণ আজ।

বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস বৈশাখ বাঙালির প্রাণের মাস হয়ে নতুনের বার্তা নিয়ে আসে। প্রতিটি প্রাণে আনে সৃষ্টির উল্লাস। সৃজন করে মঙ্গলের ধ্বণিপুঞ্জ। পুরনো মলিন মুছে নতুনের বরাভয় জাগানিয়া শুভাশীষ হয়ে আসে বৈশাখ আবহমানের বাংলা ও বাঙালির চিত্ত, চিন্তা ও চৈতন্যে।

বৈশাখ মানেই নতুন সূচনা, ফসলের মাঠে সবুজের সমারোহ, প্রকৃতিতে শ্যামল ছোঁয়া আর মানুষের মনের আঙিনায় প্রাণচাঞ্চল্য। সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে বৈশাখ—এই পঙক্তিতে যেন বৈশাখের সম্পূর্ণ চিত্র ধরা দেয় প্রকৃতি ও মানুষের রাখিবন্ধনে।

সবুজে বৈশাখ

বাংলার প্রকৃতি এই সময়ে নতুন করে সাজে। আগের চৈত্র মাসের তীব্র খরার পর একটুখানি বৃষ্টিতে শস্যের মাঠে ফোটা কচি পাতায় সবুজের ঘন ছায়া নামে। কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। মানুষের মনে জাগে শিহরণ। কারণ এই সময়টাতে শুরু হয় নতুন করে জীবনের শুরু আর চাষাবাদের প্রস্তুতি। সবুজ প্রকৃতি শুধু চাষবাসেরই প্রতীক নয়, এটি জীবনের নবজাগরণেরও প্রতীক। গ্রাম থেকে নগরের চৌহদ্দি জুড়ে বৈশাখ রাঙিয়ে দেয় চিরায়ত বাংলাকে, শাশ্বত বাঙালিকে।

শ্যামলে বৈশাখ

শ্যামল মানে হল গভীর সবুজ, যা বাংলার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের পরিচায়ক। বৈশাখে গ্রীষ্মের দাবদাহ থাকলেও মাঝে মাঝে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি প্রকৃতিকে করে তোলে সজীব। ফলত গাছপালার রং হয় আরও ঘন সবুজ, শ্যামল। এ সময় কাঁঠাল, আম, লিচুর গাছে পাকা ফলের ঘ্রাণে বাতাস ম ম করে। গ্রামবাংলার মানুষের জীবনে এটি এনে দেয় আনন্দ ও সন্তুষ্টি। সঘন সবুজের প্রলেপে মানুষ ও প্রকৃতি অনির্বচনীয় বৈভবে ঋদ্ধিমান হয় পহেলা বৈশাখে, পুরো বৈশাখ মাসের দিনগুলোতে।

প্রাণের পরশে বৈশাখ

বৈশাখের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার উৎসবমুখর পরিবেশ আর জীবনমুখী চৈতন্য । পহেলা বৈশাখে বাঙালি জাতিসত্তা নানা আচার-অনুষ্ঠানে নিজেদের সংস্কৃতিকে নতুন করে ধারণ করে। শোভাযাত্রা, বৈশাখী মেলা, হালখাতা, লোকসঙ্গীত, লোকজ খেলা—সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বৈশাখী জনজীবন। বৈশাখ শুধু একটা ঋতুর পরিবর্তন নয়, বরং পুরনো বছরের জীর্ণতা মুছে এক নতুন প্রাণের উন্মেষ। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বৈশাখের উল্লাসে মেতে ওঠে সবাই নব রবি কিরণে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহে বৈশাখ

বৈশাখ যেমন প্রাকৃতিকভাবে নবজীবনের প্রতীক, তেমনি সাংস্কৃতিকভাবে জাতিসত্তার পরিচয়ও বটে। বাংলা নববর্ষ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করায় লোকসংস্কৃতি ও লোকসংগীতের পরম্পরায়। বৈশাখে বাঙালি অনুভব করে মৃত্তিকার ছোঁয়া, শেকড়ের টান। সবুজ ও শ্যামল প্রকৃতির মাঝে বৈশাখ বাঙালির ঐক্য, চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা বহন করে সর্বজনীন উৎসবমুখর আয়োজনমালার দ্যুতিময় উদ্ভাসনে।

বাংলা, বাঙালির জীবন, সংস্কৃতিতে বৈশাখ

বৈশাখ মাস বাংলা ও বাঙালির জীবনে শুধু একটি ঋতু পরিবর্তনের সময় নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক নবজাগরণের ও অর্থনৈতিক পুনর্যাত্রার পর্যায়। কৃষিনির্ভর এই অঞ্চলের মানুষ বৈশাখের সাথে যুক্ত করেছে তাদের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে। চৈত্রের শেষদিনে বিগত দিনের হিসাবের খাতা মিলিয়ে ভবিষ্যতের রূপকল্প রচনা করা হয় বৈশাখী হালখাতার ঐতিহ্য ও আনুষ্ঠানিকতায়।

বৈশাখের অর্থনৈতিক প্রভাব

বৈশাখ মাসের শুরুতেই বহু ব্যবসায়ী হালখাতা উদযাপন করেন। এটি নতুন অর্থবছরের সূচনা, যেখানে পুরাতন দেনা-পাওনা মিটিয়ে নতুন খাতা খোলা হয়। ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের মধ্যে এ সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাশাপাশি, বৈশাখী মেলার মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যও চাঙ্গা হয়। গ্রামীণ ঐতিহ্য ও কুটির শিল্প পায় মর্যাদা ও অস্তিত্ব রক্ষার রসদ।

বৈশাখের সাংস্কৃতিক প্রভাব

পহেলা বৈশাখ বাঙালির অন্যতম প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব। এই দিনে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, লোকনৃত্য, পল্লীগীতি, বাউল সঙ্গীত ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির লোকসংস্কৃতি নতুন প্রাণ পায়। শহর ও গ্রামে এই সময় যে উৎসবমুখরতা সৃষ্টি হয়, তা বাঙালির ঐক্য ও সংস্কৃতির গভীরতা প্রকাশ করে। আদি ও অকৃত্রিম বাঙালিয়ানার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বাঙালি এগিয়ে আসার প্রত্যয় ও প্রতীতি পায় বৈশাখে। বিশ্বায়নের তোড়ে আসা অপসংস্কৃতির আবর্জনা সাফ করে দেওয়ার প্রেরণাও জাগ্রত করে বৈশাখ।

শেকড়ের পানে ছুটে চলার বৈশাখ

বৈশাখ পরিবার, প্রতিবেশী ও সমাজের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং মিলনের এক অনন্য উপলক্ষ। সবাই মিলে আনন্দ ভাগ করে নেয়—নতুন জামাকাপড় পরা, ঐতিহ্যবাহী খাবার খাওয়া (পান্তা-ইলিশ), মেলা ঘোরা—সব মিলিয়ে এক সার্বজনীন মিলনমেলা তৈরি হয়। মাটির টানে শেকড়ের পানে ছুটে চলার দিন পহেলা বৈশাখ। বিশ্বায়নের স্রোতে নিজেকে হারিয়ে বার বার সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের মধ্যে আত্মপরিচিতি পাওয়ার নাম পহেলা বৈশাখ, বৈশাখে বাংলা বর্ষবরণ।

সাহিত্য ও শিল্পকলায় বৈশাখ

বৈশাখ বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও সংগীতশিল্পীদের অনুপ্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আধুনিক কবিরাও বৈশাখকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করেছেন অসংখ্য কবিতা, গান ও চিত্রকর্ম। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের “এসো হে বৈশাখ” গানটি এক প্রতীক হয়ে উঠেছে নবজাগরণের। অসংখ্য কবিতা ও গানে চিত্রিত হয়েছে বৈশাখের অপার মহিমা। সুর ও তালের যুগলবন্দিতে বৈশাখ বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক পাটাতনকে করেছে ছন্দ ও সুষমাময়।

জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক বৈশাখ

পহেলা বৈশাখ বাঙালির জাতীয় জীবনের গৌরবময় অংশ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে বাঙালিত্বের ঠিকানায় একত্র করে বৈশাখ। বাঙালির আত্মপরিচয় ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বৈশাখ এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক স্তম্ভ। জাতীয় একতা, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব,সহাবস্থানের মর্মবাণী ধারণ করে বৈশাখ। বাংলা ও বাঙালির অবিচ্ছেদ্য আইকন বৈশাখ বৃহত্তর বাঙালির এক নান্দনিক সম্মিলনী হয়ে সমুন্নত করে জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।

সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশে বৈশাখ—মানে বাংলাদেশের এবং বিশ্বময় বাঙালির কাছে প্রকৃতির রূপ, জীবনের গতি, আত্মপরিচিতির অন্ষেণ এবং সংস্কৃতির উৎসবমুখরতা। বৈশাখ যেন এক অনন্য বৈভবের প্রতিচ্ছবি, যা প্রকৃতি ও মনুষ্যজগতকে এক অভিন্ন সূত্রে গেঁথে দেয়। বাঙালির কাছে বৈশাখ কেবল ক্যালেন্ডারের একটি মাস নয়, এটি বাঙালির আত্মার আবেগ। বাঙালির বর্ণময় জীবনের দিগন্তে এক নতুন সূর্যোদয় নিয়ে প্রতিবছরের প্রতিটি বর্ষবরণে বৈশাখ ফিরে আসে সবুজে, শ্যামলে, প্রাণের পরশ নিয়ে।