সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন বাদল রায়। হাজার ভক্তের হৃদয়ে নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রেখেই বিদায় নিলেন তিনি। ৬৩ বছর বয়সী এই ফুটবলার সত্যিকারের একজন কিংবদন্তি।
সেই আশির দশকের কথা। মোহামেডানের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি। সাদা কালো জার্সিধারীদের হয়ে অধিনায়কত্বও করেছেন। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মোহামেডানকে নেতৃত্ব দিয়ে জিতিয়েছেন লিগ শিরোপা। এছাড়াও খেলোয়াড় হিসেবে মোহামেডানের জার্সিতে জিতেছেন ছয়টি শিরোপা। ক্যারিয়ারের শুরুতে স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও পরবর্তীতে হয়ে যান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। তবে গোল করার অভ্যাস ঠিকই ধরে রেখেছিলেন তিনি।
মাঠ মাতানো কিংবদন্তি ফুটবলার বাদল রায় দীর্ঘদিন অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে ক্রীড়াঙ্গনের সবাইকে কাঁদিয়ে চলেই গেছেন। রোববার (২২ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিটে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিটে বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসারত অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ক্রীড়াঙ্গনের প্রিয়মুখ বাদল রায়।
১৯৫৭ সালের ৪ জুলাই। কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্ম এই কিংবদন্তির। নিজ এলাকায় ফুটবলের হাতেখড়ি হয় তার। পড়ালেখার পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ফুটবলে দারুণ পারফরম্যান্সে জনপ্রিয় হতে থাকেন লিকলিকে শরীরের বাদল। আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে বিভিন্ন দলের হয়ে নিয়মিত খেলার ডাক পেতেন সদ্য কলেজে যোগ দেওয়া এই ফুটবলার।
ক্লাব ফুটবলের অভিজ্ঞতাও হয়ে যায় দ্রুতই। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে সিএন্ডবি’র হয়ে যাত্রা শুরু। এরপরের বছর সুযোগ মেলে ইয়ংম্যান স্পোর্টিংয়ের হয়ে। তবে তখনও দ্বিতীয় বিভাগে খেলতেন। পরের বছর অবশেষে প্রথম বিভাগ ফুটবলেও নাম লেখান। আর বাদলকে সেই সুযোগ দেন ইয়ংম্যান সোসাইটি। আর এই দলের হয়ে খেলতে গিয়ে সাদা কালো জার্সিধারী মোহামেডানের হয়ে খেলার সুযোগ মেলে এই ফুটবলারের।
১৯৭৬ সালে মোহামেডানের ফুটবলাররা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলতে কুমিল্লায় যান। আর সেখানে প্রতিপক্ষ দলের হয়ে আলো ছড়িয়ে মোহামেডানে আসার সুযোগ করে রাখেন নিজেই। পরের বছরে কুমিল্লা ছেড়ে বাদল রায়ের ঠিকানা হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব মোহামেডানে।
১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপে ফুটবলে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মোহামেডানের জার্সিতে নামেন ১ম ম্যাচ খেলতে। থামেন ১৯৮৯ সালে।
বাদল রায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর জালে বল জড়াতে বেশ পটু ছিলেন। এক যুগেরও বেশি ক্যারিয়ারে আবাহনীর বিপক্ষে ভিন্ন পাঁচ ম্যাচে করেছেন পাঁচ গোল। আর বাদলের গোল মানে দলের জয়। আবাহনীর বিপক্ষে ওই পাঁচ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টিতে হেরেছে মোহামেডান।
বাদলের গোল মানে দলের জয়, জাতীয় দলের ক্ষেত্রেও কথাটি ছিল দারুণ সত্য। জাতীয় দলেও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে খেলা বাদল করিয়েছেন অনেক গোল। কিন্তু যখনই গোল করেছেন, জয় দেখেছে জাতীয় দল।
১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে তার গোলেই মালয়েশিয়াকে হারিয়ে ১ম জয় পায় বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সাদা দলের। প্রেসিডেন্টস গোল্ড কাপ নামে এই টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে এই ‘প্রায় মোহামেডান’ দলটিকে সেমিফাইনালে তোলেন অধিনায়ক বাদল।
ক্যারিয়ারে নিজের পারফরম্যান্সে নিজেকে নিয়ে যান কিংবদন্তিদের কাতারে। মাঠ ছাড়ার পরেও সংগঠক হিসেবে ফুটবলের সঙ্গেই ছিলেন। ক্যারিয়ারে যেমন মোহামেডানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও সাদা কালোদের শিবিরে ছিলেন। ক্লাবটির ম্যানেজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদেই ছিলেন লম্বা সময় ধরে। বাফুফের সহসভাপতি পদও রাঙিয়েছিলেন।
২০১৭ সালে ব্রেন স্ট্রোক দিয়ে শুরু। এরপর চলতি বছরের শুরুতে আবারও করেন স্ট্রোক। এরপর করোনার আক্রমণ। তারপর চতুর্থ স্তরের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। শরীরের সঙ্গে না পেরে প্রাণের সংগঠন বাফুফের নির্বাচনে থাকতে পারেননি, থাকতে পারেননি পৃথিবীর বুকেও।
বাদল রায়ের মৃত্যুতে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, বাফুফে সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন, বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন, বাংলাদেশ আরচারি ফেডারেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি বাদল রায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।