সারা বিশ্বে করোনা এখনো বিভীষিকা হিসেবে রয়ে গেলেও সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সচেতনতামূলক পদক্ষেপে দেশে করোনা ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে। ফলে আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ সবকিছুই দিন দিন স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে আসছে।
এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ১০ মাস বন্ধ থাকার পর শিগগিরই খুলে দেওয়া হতে পারে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে ইতিমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মনোবল শক্ত করার বিভিন্ন অনুশীলনের কথা বলা হয়েছে। নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের মেডিটেশন, যোগ-ব্যায়াম, পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক শক্তি বৃদ্ধির কর্মকাণ্ডে জোড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষাবিদরাও সরকারের এমন চিন্তাবাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরেই করোনা সংক্রমণের হার বেশ কমে এসেছে এবং ধারাবাহিকভাবেই এ হার নিম্নমুখী রয়েছে। এছাড়াও সম্প্রতি শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন কার্যক্রম। এমন প্রেক্ষাপটে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিসরে খুলে দেয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্কুলগুলোতে ধোয়ামোছাসহ সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। তবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করে এখন দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শুরুতে ক্লাসে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলছে কর্তৃপক্ষ। আর স্কুল খুলে দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলে অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক বা দুদিন স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
নেত্রকোনার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাহমিনা খান জানান, সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী স্কুলকে প্রস্তুত করতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতিই তারা নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘পুরো বিদ্যালয়ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করছি। শিক্ষার্থীদের বসার বেঞ্চ থেকে শুরু করে বাগান, টয়লেটসহ সব কিছু পরিষ্কার করা হচ্ছে। প্রতি শিক্ষার্থীকে স্কুল থেকে দুটি করে মাস্ক দেয়া হবে। আর ইনফ্রারেড থার্মোমিটার সেট করবো। আর প্রতিদিন একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা আসবে। তাদের বিভিন্ন রুমে বসিয়ে আমরা ক্লাস নেবো’।
সরকারিভাবে স্কুলগুলোতে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানের সময় শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাইকে সবসময় মাস্ক পরতে হবে। শিক্ষার্থীদের তিন ফুট শারীরিক দূরত্বে রাখা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার কথাও আছে নির্দেশনায়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে- স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইউনিসেফের সহযোগিতায় প্রায় ৩৯ পাতার একটি গাইডলাইন তৈরি করে ইতোমধ্যেই স্কুলগুলোতে পাঠানো হয়েছে। যার ১৪ নং পাতায় শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সহায়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক কার্যক্রমের কিছু উদাহরণ হিসেবে- খেলাধুলা, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, গাছ লাগানো ও তার পরিচর্যা, সঙ্গীত চর্চা, ছবি আঁকা ও সামাজিক সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সতর্কতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অনেকগুলো বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া, জাতীয় পর্যায়ের সকল স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনা মেনে এবং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যবিধিসমূহ বিবেচনায় রেখে সর্বোচ্চ নিরাপদ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালুকরণ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সম্পৃক্তকরণ, স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুকরণ এবং সার্বক্ষণিক যোগাযোগের মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রাপ্তি, বাছাই ও তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাসঙ্গিকীকরণ, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত, জেন্ডার, নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধিতা বিবেচনা করে সকলের জন্য প্রযোজ্য ব্যবস্থা গ্রহণ, প্রতিটি শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আনন্দঘন শিখন পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, প্রতিটি শিক্ষার্থীর পুষ্টি উন্নয়নের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পুষ্টি শিক্ষা এবং পুষ্টিসেবা প্রদান নিশ্চিতকরণ, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে নতুন স্বাভাবিকতা হিসেবে বিবেচনা করা। এতে আরও যেসব স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা সূচকসমূহকে প্রধান্য দেয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবস্থানকালে সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্টাফ ও সংশ্লিষ্ট সকলের সর্বদা মাস্ক পরিধানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রমে নির্দেশিত (৩ ফুট) শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, একসাথে অধিক সংখ্যক মানুষের জমায়েতকে নিরুৎসাহিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট সময় পর পর নিয়ম মেনে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার/পরিষ্কারের ব্যবস্থা করা, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার পালন করা ও উৎসাহিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেঝেসহ সকল এলাকা প্রতিদিন নিয়মিত পরিস্কার ও জীবাণুমুক্ত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পানি, স্যানিটেশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধা রাখা এবং পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত পরিবেশ রাখার পদ্ধতি অনুসরণ করা, শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করা এবং কেউ অসুস্থ/আক্রান্ত থাকলে/হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার পাশাপাশি কন্টাক্ট ট্রেসিং করে অন্যদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটির মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে গুজবের আতংক ও মহামারির বিস্তার রোধে শিক্ষার্থীসহ সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
তবে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনেকেই মনে করেন, স্কুল প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার মতোই এক বছরের শিখন ঘাটতি পূরণ করাও খুব একটা সহজ হবে না। যদিও এর মধ্যে স্কুল কলেজের মতো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার চিন্তা শুরু হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই জানিয়েছে যে, মার্চে পরীক্ষার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরুর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন তারা। ফলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা আশা করছেন যে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।