সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি:

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে প্রতি বছর শিক্ষক  দিবসে  যে “শিক্ষারত্ন” সম্মান প্রদান করা হয় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষকদের, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের অনন্য  অবদানের জন্য, এবছর  দক্ষিণ বাঁকুুুড়া মধ্যে একমাত্র শিক্ষারত্ন  পুরস্কারে ভূষিত  হচ্ছেন  রঘুনাথ  পণ্ডিত আবাসিক বিদ্যালয়ের (উ:মা)  প্রধান শিক্ষক মাননীয়  শ্রী  কৌশিক চট্টোপাধ্যায়।

এই সংবাদে  জঙ্গলমহলে জুড়ে  খুশির  হাওয়া বইছে।  তিনি দক্ষিণ বাঁকুড়ার পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের মধ্যে শিক্ষার  আলো ছড়িয়ে চলেছেন দীর্ঘ ২৮ বছর নিরলস ভাবে। প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করার পর  শিক্ষার্থীদের  সার্বিক কল্যাণে নানান ধরনের সুপরিকল্পিত ইতিবাচক  পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বদলে যেতে  শুরু করে বিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ।

সাজানো-গোছানো  সুবিশাল বিদ্যালয়  ক্যাম্পাস এই স্কুলের এক আকাশ  অহংকার।  ঐতিহ্য ও  আধুনিকতার ছোঁয়া এ-এক অন্যভুবন। দেখলে  মনে হবে, এ-যেন এক বিশাল নামজাদা কলেজ।

তাঁর  শুভ মানবিক  প্রচেষ্টা আজও  অব্যাহত।  প্রান্তভূমির  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে  শিক্ষা  ছড়িয়ে  দেওয়ার  মানবিক ভাবনা নিয়ে তাঁর   পথ চলা শুরু  হয়ে ছিল। এলাকার  সাধারণ মানুষ, সহ কর্মীদের সঙ্গে  অনলস প্রচেষ্টায়   বিদ্যালয়ের  চার পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে  শিক্ষার সঙ্গে  আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের  জোয়ার  এনেছিলেন।  সমস্ত  সমস্যা ও  বাঁধার  পাহাড়  সরিয়ে  তিনি  শিক্ষার অনির্বাণ  প্রদীপ  জ্বালিয়ে রেখেছেন পিছিয়ে পড়া  মানুষের মধ্যে ।  এ-এক অনন্য নজির। বিদ্যালয়ের  অন্দরমহল ও বহিরমহলের নান্দনিক  সৌন্দর্যে মুগ্ধ  হতে হয়,যেন  শিল্পী আঁকা ছবি।  শিখন প্রণালীতে এনেছেন  আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। সমৃদ্ধ লাইব্রেরি,অডিটোরিয়াম , কম্পিউটার শিক্ষার সুবৃহৎ শ্রেণী কক্ষ বিদ্যালয়ের বড় সম্পদ।   একটা প্রত্যন্ত  এলাকায়   এই ধরনের আয়োজন এক কথায় অসাধারণ ও অতুলনীয়।  বিদ্যালয়ের  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান  গোটা  জেলার কাছে গর্বের বিষয়।  এই বিদ্যালয়ের  কৃতিরা ছড়িয়ে পড়েছে  দেশে–বিদেশে। এ-এক পরমপ্রাপ্তি  দক্ষিণ বাঁকুড়ার  মানুষের কাছে। তাঁর এই অসামান্য কৃতিত্বের জন্য সমস্ত  বাঁকুড়া জেলা জুড়ে শিক্ষা  দরদী মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাসের  লক্ষ্য করা গেছে।

সমগ্র জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে  আসছে   অসংখ্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন বার্তা । শুধু পঠন-পাঠনে নয়,ছাত্রছাত্রীদের  সার্বিক বিকাশের কথা  মাথায় রেখে  গঠন করেছেন নানা কমিটি। সহকারী শিক্ষক ও পরিচালন সমিতিও সহযোগিতায় এগিয়ে  এসেছেন।  বিদ্যালয়ের  সভাপতি  জানালেন-” দক্ষিণ বাঁকুড়ার  পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রামের  জঙ্গলমহল এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য ।এবং সেই জন্য এই শিক্ষাবিদদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। ” শুধু তাই নয়,  ধারাবাহিকভাবে  মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়  নজরকাড়া  ফলাফল,  প্রচারের আলোয় এনেছে  এই বিষয়ে  সন্দেহের অবকাশ নেই ।

একটা  সময়   শিক্ষার  আলোবর্জিত অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম ছিল   দুন্দার। অসাধ্য সাধন  করতে  পেরেছেন  তাঁর  সুনিপুণ, কুশলী উদ্যোগ,দক্ষ পরিচালনা ও নেতৃত্ব। সহকর্মীদের  এবং  এলাকার  সমস্ত মানুষের সঙ্গে  নিবিড়  ভালোবাসার  সখ্যতা  চোখ পড়ার মতো। একের পর, এক  সাফল্যের মুকুটে ভূষিত হয়েছে  বিদ্যালয়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে  তিনি  ভগবান স্বরূপ। জঙ্গলমহলে এই স্কুল ১৯১৩ সালে নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার লাভ করে,     ২০১৪সালে শিশুমিত্র পুরস্কার পান কৌশিক চট্টোপাধ্যায়।

১৯১৯ সালে মাধ্যমিকে  অলচিকি বিভাগে রাজ্যে   এই স্কুলের ছাত্রী প্রথম হয়।  মাত্র  ২২  বছর বয়সে পায়রাগুড়ি স্কুলে  সহকারী শিক্ষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রমাণ করতে পেরেছেন,   তিনি  মানুষ তৈরির সার্থক কারিগর। পেশা শিক্ষকতা, কিন্তু নেশা শিল্প–সাহিত্য-সংস্কৃতি। একাধারে কবি, সঙ্গীত শিল্পী ও নাট্যব্যক্তিত্ব।  তাঁর  সোনালী শৈশব ও কৌতূহলী কৈশোর  কেটেছে  রাইপুর ব্লকের  প্রাকৃতিক বৈভব সমৃদ্ধ  রাইপুর শহরে। উচ্চ শিক্ষার মেধাবী  পাঠ নিয়েছিলেন কলকাতার  সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। আদ্যন্ত  মুক্তমনা সংস্কৃতিবান ,মার্জিত  রুচির শিক্ষাব্যক্তিত্ব।  পেশার পোশাকের বাইরে আর একটি মানুষকে ।আর এক পৃথিবীকে। একজন  মানুষের মধ্যে আসলে  লুকিয়ে থাকে অনেকগুলি টুকরো টুকরো মানুষ। একজন  প্রাজ্ঞ  আদর্শ শিক্ষকের হৃদয়ের  গভীরে থাকে একজন  বিহ্বল  শিশুসুলভ মন– আশা নৈরাশ্যের ধূপছায়ায় গড়া তাঁর  রূপ— আদর্শ প্রধান  শিক্ষক কৌশিক চট্টোপাধ্যায়        মহাশয়ের  মধ্যে  দিনের পর দিন  সেই  বিশ্বাসকে  সত্য হতে  দেখেছে এখানকার শিক্ষা  সচেতন  মানুষ। সবাই  দেখে অবাক হয়ে গেছেন। অচেনার আঙিনা  থেকে  চেনার আলোরবৃত্তে পৌঁছেও এ ধন্দ কাটে নি,কোন মানুষটা  আমাদের দক্ষিণ বাঁকুড়ার  জঙ্গলমহলের এক- আকাশ গর্ব?

একুশ শতকের বদলে যাওয়া  দুনিয়ায়  ক্ষমতা  এবং তার বিশ্বস্ত অনুচর ভোগবাদের অনন্ত ঘোড় দৌড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে  নিজেকে  বিজ্ঞাপিত  না করে  অন্য এক জীবনচর্যা বেছে নিয়েছিলেন আদর্শ শিক্ষক  কৌশিক চট্টোপাধ্যায়     ।সম্পূর্ণ দিগভ্রান্ত সময়ে  নিজের  জায়গায় সৎ,প্রত্যয়ে সুস্হির।   সুদীর্ঘ ২৮ বছরের  বর্ণময় কর্মজীবনের    সাফল্য  তৃপ্ত করলেও অহংকারী করে তোলেনি। তিনি আছেন নতুন  প্রজন্মের  শিক্ষকদের    প্রত্যেকের হয়ে  ওঠার  বর্ণিল  ইতিহাসে,সকল শুভ ও মানবিক  প্রচেষ্টায়  তাঁর  আগ্রহ ও ঔৎসুক্য  জেলার  তরুণ প্রজন্মের বিশেষ করে  জঙ্গলমহলের  শিক্ষকদের বারবার উজ্জীবিত করবে বলে মনে হয় । আলাপচারিতায়  বিরল  শিক্ষারত্ন প্রাপক প্রধান শিক্ষক  শ্রী কৌশিক চট্টোপাধ্যায়  তাঁর বর্ণিল উপলব্ধির  কথা  জানালেন- ” আমার  ২৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনে  এই  পুরস্কার আমার কাছে  এত  দিনের নিরলস কাজের এক স্বীকৃতি, যা অত্যন্ত  শ্রদ্ধার সঙ্গে  আগামী  ৫-ই সেপ্টেম্বর  শিক্ষক  দিবসে  গ্রহণ করতে চলেছি। আজ  অজ পাড়া গ্রামের এক অখ্যাত  আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার স্কুল  সারা রাজ্যে  পরিচিত  এক বর্ণময় নাম।  তিনি  আরও বলেন,  এই মুহূর্তে  ৬টি জেলার  ছাত্র-ছাত্রীরা এই স্কুলে পড়ছে। আরও অনেক পথ পেরোতেই চাই।আমি কৃতজ্ঞ  মাননীয়  শিক্ষামন্ত্রীর ও শিক্ষাদপ্তরের আধিকারিকদের  কাছে, যে আমার  কাজের  মূল্যায়ন  তাঁরা করেছেন। ” আরও  জঙ্গলমহলে  কৌশিক চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেক অনেক  শিক্ষক  শিক্ষারত্ন   পুরস্কারে ভূষিত  হয়ে জেলার  শিক্ষার মানচিত্রে নজির সৃষ্টি করুক এই আশা করে দক্ষিণ বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার  সাধারণ মানুষ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে