বাংলাদেশে প্রতিবছরই বিভিন্ন ধরনের অগ্নিকাণ্ডে শত শত মানুষ হতাহত হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আবাসিক গৃহে অগ্নিকাণ্ড হয়েছে আট হাজারের বেশি। এই সময়ে আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছে ১৮৪ জন। আর আহত হয়েছে ৫৬০ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বড়দের ক্ষেত্রে শরীরের ১৫ শতাংশ এবং শিশুদের ক্ষেত্রে যদি শরীরের ১০ শতাংশ পুড়ে যায় তাহলে তা ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধরা হয়। তবে খুব কম বয়সী শিশু বা নবজাতক এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই পরিমাপ সব সময় খাটে না। এসব এক্ষেত্রে ১০ কিংবা ১৫ ভাগের চেয়ে কম পুড়ে গেলেও অনেক সময় তা প্রাণঘাতী হতে পারে।

পোড়া অংশের পরিমাণ যত বেশি হবে মৃত্যুর আশঙ্কা তত বেড়ে যাবে। এছাড়া এটা বয়সের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্থাৎ বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে কম পরিমাণ পোড়াও প্রাণহানির কারণ হতে পারে।

মানবদেহকে ১০০ ভাগ ধরা হয়। এর মধ্যে ১৫% এর বেশি পুড়ে গেলে অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু হয়। এটা ৩০ ভাগের বেশি হলে সেখানে এক্সটেনসিভ ট্রিটমেন্ট (বিশেষ চিকিৎসা) দরকার হয়। শরীরের ৪০ ভাগের বেশি পুড়ে গেলে সেই রোগীকে ক্রিটিক্যাল বা সংকটাপন্ন বলে ধরা হয়। আর ৭০ ভাগের বেশি হলে ধরে নেয়া হয় যে তার বাঁচার আশা নেই বললেই চলে।

কেউ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হলে সাথে সাথে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে সে বিষয়ে চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের কিছু পরামর্শও উল্লেখযোগ্য। এগুলো হচ্ছে-

১. প্রচুর পানি ঢালুন:

বিশেষজ্ঞদের মতে, আগুনে পোড়ার প্রথম আধাঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসময় রোগীর শরীরে যত বেশি সম্ভব পানি ঢালতে হবে। শুধু পানি ঢাললেই পোড়ার পরিমাণ কমিয়ে আনা যেতে পারে। যেখানে ২০% পুড়তো সেটাকে পানি ঢালার কারণে ১৫ বা ১০% এ নামিয়ে আনা যেতে পারে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বহমান ঠাণ্ডা পানি দিয়ে পোড়া জায়গা অন্তত ২০ মিনিট ধরে পানি ঢালতে হবে। তবে বরফ, বরফ শীতল পানি, কোন ধরনের ক্রিম ও তৈলাক্ত পদার্থ লাগানো যাবে না।

পানি ঢালার পর রোগীর শরীর গরম রাখার চেষ্টা করতে হবে যাতে হাইপোথারমিয়া না হয়। সেক্ষেত্রে কম্বল দিয়ে তাকে জড়িয়ে নেয়া যেতে পারে।

২. কাপড় ও গহনা খুলে ফেলুন:

কেউ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হলে তার পরিহিত কাপড় ও গহনা যত দ্রুত সম্ভব খুলে ফেলতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে ন্যাপি কিংবা ডায়াপার থাকলে সেটি খুলে ফেলতে হবে। কিন্তু পোড়া চামড়া বা পেশীর সাথে যদি কোন ধাতব পদার্থ বা কাপড়ের টুকরো আটকে গিয়ে থাকে তাহলে তা সরানোর চেষ্টা করা যাবে না। এক্ষেত্রে ক্ষত আরও বেশি বাড়ার আশঙ্কা থাকে।

তবে শরীরের যে অংশ পুড়ে গেছে সেখানে যাতে কোন ধরনের কাপড় না থাকে সেটি খেয়াল রাখতে হবে।

৩. যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে:

আগুনে পোড়োর পর প্রথম ২৪ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে মধ্যে হাসপাতালে নেয়া হলে রোগীর মৃত্যু ঝুঁকি অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, প্রথমত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে নেয়া হলে রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে ২০-৩০ লিটার পর্যন্ত স্যালাইন দেয়া যায়। কিন্তু এর চেয়ে বেশি সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ৩-৪ লিটারের বেশি দেয়া সম্ভব নয়। ফলে তার মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।

প্রথম ২৪ ঘণ্টায় স্যালাইন দেয়ার কারণে যে উপকার পাওয়া যায় পরে আর সেটি পাওয়া যায় না। এ জন্য এই ২৪ ঘণ্টাকে পোড়া রোগীর জন্য ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলা হয়।

৪. টুথপেস্ট, লবণ ও ডিমের সাদা অংশ দেয়া যাবে না:

পোড়া রোগীকে তার ক্ষত স্থানের উপর টুথপেস্ট, লবণ বা ডিমের সাদা অংশ দেয়া যাবে না। এগুলো প্রাথমিকভাবে জীবাণুমুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে রোগীকে সংক্রমণের দিকে ঠেলে দেয়। যদি এগুলো পোড়া জায়গায় লাগানো হয় তবে রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার পর এই জিনিসগুলোকে পরিষ্কার করা হয়। আর তখন এগুলো জমাট বেঁধে থাকে বলে চামড়া উঠে আসার শঙ্কা থাকে। অর্থাৎ তার ক্ষত আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

যদি রোগীর মুখ কিংবা চোখ পুড়ে যায়, তাহলে রোগীকে যতক্ষণ সম্ভব সোজা করে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে। এতে ফোস্কা পড়া বা ফুলে যাওয়া কমে যায়।

৫. বেশি করে তরল খাওয়াতে হবে:

পোড়া রোগীকে স্যালাইন দেয়া সম্ভব না হলে মুখে অন্তত স্যালাইন, ডাবের পানি বা তরল জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। এছাড়া ক্যালরি ও প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন ডিম বা মুরগি খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে