সানোয়ার আরিফ রাজশাহী:-
বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও, মুখের কথাই হয় যে গান, তুমি যদি গাও’ এমন বেদনা আর কথা, মিলে যদি ভালোলাগার গান হয় তাহলে দোষেরকি। তবে সব বেদনাই যে মধু এমনটি নয়, বধই বিদায়ের বেদনাই মধুর হয়। কারণ বিভিন্ন আড়ম্বর মধ্যদিয়ে ফুটে উঠে দেওয়া- নেওয়া, পাওয়া-না পাওয়া। গতকাল ছিল অশ্রুশিক্ত নয়নে বিদায়ের দিন।
বলছিলাম শিক্ষা জাদুকর অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হাবিবুর রহমান কথা। তিনি রাজশাহী কলেজের শুধু মাত্র একজন শিক্ষক। একজন প্রফেসার, একজন অধ্যক্ষ। তাতেও কিছুটা কম হয়, না তিনি কোটি শিক্ষার্থীর অভিভাবক। এতেও ক্ষানিকটা কম হয়। এমন অভিভাবকের বিদায় লগ্নে নিশ্চুপ কাঁদলো রাজশাহী কলেজের পুরো কলেজ ক্যাম্পাস।
প্রফেসর মহা. হাবিবুর রহমান অধ্যক্ষ হওয়ার পরে কলেজটির সকল কার্যক্রমে মাত্রা যোগ হয়। লেখা-পাড়া- বিনোদন, বিভিন্ন দিবস পালনসহ প্রতিবছর নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়- হ্যাটট্রিক ও রয়েছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনও। এসব অর্জন এই অধ্যক্ষের হাত ধরেই এসেছে এই ক্যাম্পাসে।
শিক্ষার্থীরা জানান- আজ অধ্যক্ষ স্যারের বিদায় দিন। দিনটি অনেক কষ্টের। স্যারের বিদায় হলেও পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে তার স্মৃতি থাকবে। পুরো ক্যাম্পাসে যেনো তার (অধ্যক্ষ) ছোয়া লেগে থাকবে আজীবন।
রাজশাহী কলেজ:
রাজশাহী কলেজের প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। শতবর্ষ কলেজটি জুড়ে অনেক স্মৃতি রয়েছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে কলেজটির আছে গৌরবোজ্বল ইতিহাস। ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে পর পর তিনবার বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। শুধু তাই নয়, কলেজটি অতীত গৌরবের ধারা অব্যাহত রেখেছে। দীর্ঘ পথ চলায় ইতিহাসের প্রায় বাঁক বাক প্রত্যক্ষ করেছে কলেজটি। বর্তমানে রাজশাহী কলেজ পরিনত হয়েছে জাতীয় উন্নয়নের অনুপ্রেরণার উৎসে।
কলেজটির সেই প্রাচীন ভবনগুলো আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু বছর বছর আগমন ঘটেছে নতুন অতিথির। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু। ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানে বিএ কোর্স চালু হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত করে এখানে বিএ কোর্স চালু করা হলে উত্তরবঙ্গের সর্বপ্রথম এবং পরবর্তীকালে সর্বশ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে পরিচিতি পায় কলেজটি। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে কলেজে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হয়।
কলেজের একাল-সেকাল:
প্রতিষ্ঠার শুরুতে রাজশাহী কলেজের কোনও নিজস্ব ভবন ছিল না। রাজশাহী এসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ কলেজের প্রথম ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। রাজশাহী কলেজের প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ হলো এর গ্রন্থাগার। যেখানে পুরাতন, মূল্যবান ও সাম্প্রতিক সংস্করণের বই, জার্নাল এবং সাময়িকীর প্রাচুর্য রয়েছে। কলেজ লাইব্রেরিতে অনেক দুর্লভ বই, গেজেট, এনসাইক্লোপিডিয়া এবং পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
শিক্ষক ও তাদের জ্ঞান বিনিময়:
এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হাবিবুর রহমানসহ মোট শিক্ষক ২৬১ জন । ২২ জন অধ্যাপক, ৫৭ সহযোগী অধ্যাপক, ৮০ জন সহকারী অধ্যাপক ও ৮২ জন প্রভাষক রয়েছেন। কোর্সসমূহের মধ্যে রয়েছে স্নাতক (পাস) : বিএ, বিএসএস, বিএসসি, বিবিএস; স্নাতক (সম্মান): বাংলা, ইংরেজি, আরবি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজ কর্ম, অর্থনীতি, মার্কেটিং, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও গনিতসহ ২৩টি বিষয় । মাস্টার্স প্রিলিমিনারি: বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ইতিহাস, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, ইসলামিক শিক্ষা, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, অর্থনীতি, হিসাব বিজ্ঞান, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, মার্কেটিং, ব্যবস্থাপনা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও গনিতসহ ২৩টি বিষয়। মাস্টার্স ফাইনাল: বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ইতিহাস, ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি, দর্শন, ইসলামিক শিক্ষা, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, সমাজকর্ম, অর্থনীতি, মার্কেটিং, ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, হিসাব বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও গনিতসহ ২৩টি বিষয়।
স্মরণীয়-বরণীয় যারা:
প্রথিতযশা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন- প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় কান্তকবি রজনীকান্ত সেন , ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার, খান বাহাদুর এমাদউদ্দীন আহমদ, গণিতবিদ আবদুল করিম মণ্ডল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবারু কাজী মোতাহার হোসেন, সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, ইতিহাসবিদ সাদত আলি আখন্দ, সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী, বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, সাবেক এম এল এ মাদার বখশ, সরোদশিল্পী পণ্ডিত রাধিকা মোহন মৈত্র, শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল হক, সাবেক স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজ, সাবেক প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, রাবির সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ আব্দুর রবি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রফেসর ড . এম মকবুলার রহমান সরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ একরামুল হক, শহীদ বুদ্ধিজীবি আনোয়ার পাশা, ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ সুলতান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল মুহাম্মদ গোলাম তওয়াব, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দল আজিজ খান (১৯৩১-২০১২), বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মাযহারুল ইসলাম,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ, বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম খাদেমুল বাসার প্রমুখ।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হাবিবুর রহমান বলেন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার অনন্য প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ।