মহীতোষ গায়েন :

১৯৩৯ সালে ভাইফোঁটার গল্প লোকমুখে প্রচলিত।

ভাইবোনেদের মধ্যে তখন বেঁচে রয়েছেন দুজন—রবীন্দ্রনাথ আর বর্ণকুমারীদেবী। বৃদ্ধ, অশক্ত শরীরে ভাইয়ের কাছে যেতে পারেননি রবি ঠাকুরের ছোটোদিদি। শোভনা সুন্দরী।….

‘ভাইটি আমার, শুনলুম তুমি জোড়াসাঁকোয় এসেছ, সেইখানে গিয়ে ভাইফোঁটা দেবো ভেবেছিলু কিন্তু হলো না, ———–

ধিরেন নামে একজন চেনা লোক পেলুম তাকে দিয়ে সব আনিয়ে পাঠালুম কবির যা প্রিয় জিনিস তাই দিলুম আমি বড় তোমায় কিছু পাঠাতে হবে না। আশা করি তুমি ভাল আছ। ধানদূর্বা ফুল দিয়া আশীর্বাদ করিলাম কিন্তু দেখা হল না এই দুঃখ। ইতি বর্ণ।

চিঠির উত্তরের শব্দগুলি যেন নতজানু এক ভাইয়ের প্রণাম। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন উত্তরে—
‘ভাই ছোড়দি তোমার ভাইফোঁটা পেয়ে খুশি হয়েছি। আমাদের ঘরে ফোঁটা নেবার জন্য ভাই কেবল একটি মাত্র বাকি আর দেবার জন্য আছেন এক দিদি।

নন্দিনী তোমার প্রতিনিধিত্ব করেছে। আমার প্রণাম গ্রহণ করো।

ইতি ১৪/১১/৩৯
তোমার রবি।

রাণী চন্দ ‘গুরুদেব’ বইতে এই ভাইফোঁটার বর্ণনা লিখে ~গিয়েছেন।
~
১৯৪০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কালিম্পং থেকে কলকাতায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে অসুস্থ রবীন্দ্রনাথকে।

এমনি সময় এসে গেল ভাইফোঁটার পূন্য তিথি। আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন চুরাশি বছরের দিদি।

গৌরবরণ একটি শীর্ণ হাতের শীর্ণ আঙুল স্পর্শ করল অসুস্থ পৃথিবীবিখ্যাত ভাইয়ের কপাল।

দুজন দুপাশ থেকে ধরে রেখেছিলেন বর্ণকুমারীকে।

তারপর ভাইয়ের বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহাসক্ত দিদি খুব বকলেন। বৃদ্ধ ভাইয়ের অসুস্থতার মূল কারণ নাকি কালিম্পং যাত্রা।

নাহলে অসুস্থ হওয়ার কোনো কারণ আছে নাকি? বললেন, ‘দেখো রবি তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও। বুঝলে?’

রবি ঠাকুর এই বকুনি শুনে কৌতূকে পরিপূর্ণ এক গাম্ভীর্য নিয়ে বলেছিলেন, ‘না আর কখনও ছুটে ছুটে যাব না, বসে বসে যাব এবার থেকে।’

তারপর শুরু হল ভাইবোনের কথালাপ।

রোগশয্যায় এল উৎসবের আমেজ। তারপর প্রণাম পর্ব।

দিদিকেই পা তুলে দিতে হবে। নাহলে অশক্ত ভাই প্রণাম করবেন কেমন করে? দিদি বললেন, ‘থাক, এমনিতেই হবে, তোমাকে আর পেন্নাম করতে হবে না কষ্ট করে।’

এরপর আদরে, আশীর্বাদে ভাইকে ভরিয়ে দিয়ে দুজনের হাতে ভর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন বর্ণকুমারী। আর কোনোদিন তাঁর ভাইফোঁটা দেওয়া হবে না।
জীবনের স্মৃতির টুকরোই রয়ে যায় যশ, প্রতিপত্তি সব কিছুকে পিছনে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের জীবনের সব প্রতিষ্ঠার পাশে এই যে বৃদ্ধবয়সে স্নেহ পাওয়ার স্মৃতি তার মূল্যও কিছু কম নয়। যমের দুয়ারের কাঁটা একসময় সরে যায়। মৃত্যু তো অমোঘ। কিন্তু স্মৃতি অমলিন।

(সংগৃহীত )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে