ডঃ সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া পশ্চিমবঙ্গ ভারত:

রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন প্রচুর ঐশ্বর্যের অঙ্কবেদিতে লোকোত্তর প্রতিভা নিয়ে, মহাভাগ্যের জয়তিলক অঙ্কিত উন্নত ললাট নিয়ে, বিধাতার বর  ছিল তাঁর ললাটিকা।

তাই বিশ্ববরেণ্য কবির নাম-মন্ত্রে গৌরবমুখর শুভ পঁচিশে বৈশাখ। এই পুণ্য তিথিতে শ্যামল বঙ্গজননীর কোলে জেগে উঠেছিলেন শিশুরবি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ১৬১-তম জন্মবার্ষিকী ২৫-শে বৈশাখ আগামী শুক্রবার (৯-ই মে) ২০২১। প্রতিবারের মতোই এবারও সাড়ম্বরে হয়তো পালিত হবে না। কিন্তু হৃদয়ে ও মননে প্রাজ্জলভাবে ভাস্বর থাকবেন তিনি। বিশ্বব্যাপী মারণব্যধির আগ্রাসন এবং বিরামহীন মৃত্যুর মিছিলে গোটা বিশ্বের স্বাভাবিক জনজীবন আজ স্তব্ধ। থমকে গেছে সমস্ত মননের চর্চা। তবুও এই মহাসংকটে তাঁকে জন্মদিনে স্মরণ করবে সমগ্র বিশ্ব। অবহেলায়, অনাদরে বেড়ে ওঠা রবির জন্মদিন শৈশবে কখনো বর্ণময় ভাবে পালিত হয়নি। এমনকি কবির আশি বছরের জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর কোন জন্মদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়নি। জীবনের প্রথমদিকে জন্মদিন পালন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজেরও তেমন মানসিক উৎসাহ ছিল না। এব্যাপারে তিনি ছিলেন চরম উদাসীন। তাই আর দশটা দিনের মতোই জন্মদিন কবে এলো, গেলো কবি নিজেও টের পেতেন না।

মূলত চল্লিশ বছরের পর থেকেই কবির ভক্ত, শুভানুধ্যায়ীদের ও আপনজনের আন্তরিক উৎসাহে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জন্মদিন পালন শুরু হয়। কবি নিজেও তাঁর বিভিন্ন জন্মজয়ন্তীতে শুভানুধ্যায়ীদের ও ভক্তদের উদ্দেশ্যে অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, অনেক ভালো ভালো কবিতা লিখেছেন। জীবিতাবস্থায় নানা সময় পালিত উৎসবমুখর জন্মদিনে কবিগুরুর নিজস্ব অনুভূতির এক -ভুবন তৈরি হয়েছিল।আসলে জন্মদিনে আত্মভাবনায় নানা বর্ণময়় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল।তার হদিস আমাদের অনেকের ই  নাগালের বাইরে। কবিগুরুর নিজস্ব অনুভূতির অন্বেষণ করাই এই নিবন্ধটির মুখ্য উদ্দেশ্য।,১৩১৭সালে বোলপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংবর্ধনায় কবি প্রথম নিজের জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি বলেছিলেন, জন্মদিন সম্বন্ধে এখনো তাঁর কোন গভীর অনুভূতি নেই ।”কতো পঁচিশে বৈশাখ চলে গিয়েছে,তারা অন্য তারিখের চেয়ে কিছুমাত্র  বড়ো করে আমার কাছে প্রকাশ করেনি।”৫০তম জন্মদিবসে কবি নিজেকে আলোক প্রভায় প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,”আজ আমার জন্মদিনে তোমরা যে উৎসব পালন করতো তার মধ্যে যদি সেই কথাটি থাকে, তোমরা যদি আমাকে আপন করে পেয়ে থাকো আজ প্রভাতে সেই পাওয়ার কথা আনন্দকেই যদি তোমাদের প্রকাশ করবার ইচ্ছে হয়ে থাকে তাহলেই এই উৎসব সার্থক। আমার এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সেও আমাকে তোমরা নতুন ভাবে পেয়েছ । আমার সঙ্গে তোমাদের সম্বন্ধের মধ্যে জরাজীর্ণতার লেশমাত্র লবণ নেই ।তাই আজ সকালে তোমাদের আনন্দ  উৎসবের মাঝখানে বসে এই নবজন্মের নবীনতা অনর্থের বাইরে উপলব্ধি করছি।”কবির ৫৯তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেতনের আশ্রমে। পঁচিশে বৈশাখের আগের দিন অর্থাৎ ২৪শেবৈশাখ তিনি রচনা করেছিলেন, ‘আমার জীর্ণ পাতা যাবার  বেলায়।’১৩২৮সালের পঁচিশে বৈশাখে কবি ছিলেন জেনেভায়। সেখানে বাংলার শ্যামল প্রকৃতি ও মাটির আকর্ষণে কবি ব্যাকুল হয়েছিলেন।তিনিএণ্ড্রন্নজকে লিখেছিলেন,”  আজিকার দিন যথার্থভাবে আমার জন্য নহে।যাহারা আমাকে ভালবাসে তাদের ই জন্য আনন্দের দিন  ।তোমাদের কাছ হ ইতে দূরে আজিকার এই দিন আমার কাছে  পুসত্মিকার তারিখ মাত্র। আজ একটু নিরালা থাকিতে ইচ্ছা করিতেছি কিন্ত তাহা  হইবার নাই।”এ দিন জার্মান জাতির পক্ষ থেকে কবিকে সংবর্ধনা জানানো হয়।”কবির জন্যটমাসম্যান,অরকন,কাউন্ট কেইসার লিগ প্রমুখকে নিয়ে গঠিত হয় সংবর্ধনা কমিটি। কবিকে উপহার দেয়া হয় জার্মান ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থসমূহ। ১৩২১ সনে কবির ৬২তম জন্মজয়ন্তী পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে।কবি তখন শান্তিনিকেতনের ছায়ায়গ্রীষ্মের দিনগুলোর সঙ্গে গল্গমগ্ন ছিলেন।এই জন্মদিনে কবি উপহার দিয়েছিলেন,’ পঁচিশে বৈশাখ’কবিতা;  ‘রাত্রি হলভোর,আজি মোরজন্মেরস্মরণ পূর্ণবানী,/প্রভাতের রৌদ্রে-লেখা লিপিখানি/হাতে করে আমি,দ্বারে আসি দিল ডাকপঁচিশেবৈশাখ।” ১৩২৩ সনে কবির ৬৪তম জন্মোৎসবে কবি ছিলেন চীনে।সাথে ছিলেন নন্দলাল বসু,এলমাস্ট,ক্ষিতিমোহন সেনপ্রমুখ। অনেকদিন পর কবি ওর ধ বার চীনের সেই পঁচিশে বৈশাখের স্মরণে লিখেছিলেন,’। একদা গিয়েছি চীনদেশে–যেখানে বন্ধু পাই সেখানে নবজন্ম ঘটে।“
১৩৩২ এর ২৫শে বৈশাখে বিপুল উদ্দীপনায় কবির ৬৫তম জন্মোৎসব পালন করা হল শান্তিনিকেতনে। এতোদিন যে জন্মদিন শুধু ঘরের মানুষের কাছে ছিল, এবার তা বিশ্বসভার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কবি এ-সময় ইন্দিরা দেবীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “এমন একদিন ছিল যখন আমার জন্মদিনের স্বার্থকতা তোদের কাছে ছাড়া আর কোথাও ছিল না। ক্রমে এখন এক সময়ে আমার জীবনের ক্ষেত্র বহু বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ল, সেটা যেন আমার জন্মান্তরের মতো। সেই আমার নবজন্মের জন্মদিন এতোদিন চলে এসেছে। যেটাকে আমার জন্মান্তর বললুম, তাকে আমার পরলোকও বলা চলে। অর্থাৎ, যারা পর ছিল তাদের মধ্যেই একদিন আমার অভ্যর্থনা শুরু হয়েছিলো। তোদের লোক থেকে লোকান্তরগতকে তোরা হয়তো সুষ্ঠু করে দেখতে পাসনি। যে ঘাট থেকে জীবনযাত্রা প্রথম শুরু করেছিলাম আমার কাছে মাঝে মাঝে তা ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু এটা হলো মধ্যাহ্ন কালের কথা। এখন অপরাহ্নের মুলতানি সুর হাওয়ায় বেজে উঠেছে।“ কবির ৬৬তম জন্মদিবসও পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। এই জন্মদিনটি দেশি-বিদেশিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। জন্মদিনে কবি উপহার দিলেন, ‘নটীর পূজা’ ও ‘পরিশেষ’ কাব্যের ‘দিনাবসান’ কবিতা – “বাঁশি যখন থামবে ঘরে, নিভবে দীপের শিখা। / এই জন্মের লীলার পরে পড়বে যবনীকা। / সেদিন যেন কবির তরে, ভিড় না জমে সবার ঘরে। / হয়না যেন উচ্চস্বরে শোকের সমারোহ।“ এই অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দিয়েছিলেন, ‘জন্মদিন’ নাম দিয়ে তা ‘প্রবাসী’তে জৈষ্ঠ্য-১৩৩৩ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। “এই শ্যামল ধরণী, প্রান্তর, অরণ্যের মধ্যে আমার বিধাতা আমাকে অন্তরঙ্গতার অধিকার দিয়েছেন, এর মধ্যে নগ্ন শিশু হয়ে এসেছিলুম। আজও দৈববীণা অনাহূত সুরে আকাশে বাজে তখন সেদিনকার সেই শিশু জেগে ওঠে, বলতে চায় কিছু, সব কথা বলে উঠতে পারে না। আজ আমার জন্মদিন, সেই কবির জন্মদিন, প্রবীণের না।“
১৩৩৬ সালে জাপানের পথেই হয় কবির জন্মোৎসব। জাহাজের কাপ্তান ও যাত্রীরা কবিকে সংবর্ধনা জানান। ১৩৩৭ সালে কবির ৬৯তম জন্মজয়ন্তী বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই জন্মদিনে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন চিত্রশিল্পী রূপে। প্যারিসের দুই মহিলার উদ্যোগে তাঁর ছবির প্রদর্শনীও হয়। ফ্রান্স থেকেই কবি ইন্দিরা দেবীকে লেখেন, “ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখে অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছন্ন, তিনি এখন চিত্রকর রূপে প্রকাশমান। … এইবার আমার চৈতালী বর্ষ শেষের ফসল সমুদ্রপারের ঘাটে সংগ্রহ হল।“ ১৩৩৮ সনে কবির ৭০ তম জন্মজয়ন্তীতে সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে কলকাতায় তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সভাপতির ভাষণে শরৎচন্দ্র কবিকে মানবাত্মার কবি হিসেবে অভিহিত করেন। জন্মদিনের ভাষণে কবি বলেন – “একটিমাত্র পরিচয় আমার আছে, যে আর কিছুই নয়, আমি কবিমাত্র। আমার চিত্ত নানা কর্মের উপলক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নানা জনের গোচর হয়েছে। তাতে আমার পরিচয়ের সমগ্রতা নেই। আমি তত্ত্বজ্ঞানী, শাস্ত্রজ্ঞানী, গুরু বা নেতা নই – ক’দিন আমি বলেছিলাম, আমি চাইনে হতে নববঙ্গের নবযুগের চালক – সে কথা সত্য বলেছিলাম। … এই ধুলোমাটি ঘাসের মধ্যে আমি হৃদয় ঢেলে দিয়ে গেলাম বনস্পতি ঔষধির মধ্যে। যারা মাটির কোলের কাছে আছে, যারা মাটিতে মাটির হাতে মানুষ, যারা মাটিতেই হাঁটিতে আরম্ভ করে, শেষকালে মাটিতেই বিশ্রাম করে, আমি তাদের সকলের বন্ধু, – আমি কবি।“ কবি ৭১ তম জন্মদিনে ছিলেন ইরানে। সেখানে তিনি রচনা করেছিলেন, ‘ইরান, তোমার সম্মান মালে / নবগৌরব বহি নিজ ভালে / সার্থক হলো কবির জন্মদিন।‘ ১৩৪২ সালে কবির ৭৪ তম জন্মদিবস পালিত হয়। এ দিবসে পাওয়া যায় তাঁর নতুন উপলব্ধির জীবন ও জগত এবং মানুষ ও বিশ্বপ্রকৃতি। কবি রচনা করলেন ‘২৫শে বৈশাখ চলেছে’। কবিতাটি উতসর্গ করেন কবি অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীকে – “পঁচিশে বৈশাখ চলেছে / জন্মদিনের ধারাকে বহন করে / মৃত্যুদিনের দিকে / সেই চলতি আসনের উপর বসে / কোন কারিগর গাঁথছে মালা / ছোটো ছোটো জন্মমৃত্যুর সীমানায় / নানা রবীন্দ্রনাথের একখানা মালা।“ ১৩৪৪ সালে কবির ৭৬ তম জন্মদিবস পালিত হয় আলমোড়ায়। জন্মদিনের তিন দিন আগেই কবি ‘জন্মদিন’ নামে কবিতা রচনা করেছিলেন। ১৩৪৫ সালে কবির ৭৮ তম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর কবিতা যুদ্ধবিরোধী চেতনায় মুখরিত হয়েছিল। একদিকে কি অমানুষিক স্পর্ধা, আরেকদিকে কি অমানুষিক কাপুরুষতা! তিনি কালিম্পং থেকে বেতারে পড়ে শোনান সেজুতির ‘জন্মদিন’ কবিতাটি – ‘আজ মম জন্মদিন / জন্মদিন মৃত্যুদিন একাসনে দোহে বসে আছে / দুই আলো মুখোমুখি মিলিছে জীবনপ্রান্তে মম, / … হে মানুষ, হে ধরণী, / তোমার আশ্রয় ছেড়ে যাবে যবে নিও তুমি গনি।‘

কবির ৭৯ তম জন্মোৎসব পালিত হয় পুরীতে। সেখানে সরকারিভাবে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে কবি ভাষণ দেন, কবিতা পাঠ করেন। তিনি রচনা করেন, ‘নবজাতকের জন্মদিন’ কবিতা – ‘তোমরা যাকে রবীন্দ্রনাথ বলে জানো, সে আমি নই।‘ ১৩৪৭ সালের ২৫ শে বৈশাখে কবি মংপুতে ছিলেন মৈত্রীদেবীর অতিথি হিসেবে। কবির ৮০ তম জন্মজয়ন্তীতে তিনি লেখেন ‘জন্মদিনে’ কবিতাটি। ‘সেদিন আমার জন্মদিন … উদয় দিগন্তপানে মেলিলাম আঁখি।‘ এই জন্মোৎসব যেমন কবির জীবদ্দশায় সর্বশেষ জন্মোৎসব, তেমনি সভ্যতার সংকটও কবির শেষ অভিভাষণ। পয়লা বৈশাখ শান্তিনিকেতনে জন্মদিনের উৎসবে লেখা। ভাষণের শেষ দিকে কবি বলেছিলেন, “আজ আশা করে আছি পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে। … আশা করবো, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আরো একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাওয়ার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।“

(ডঃ সুবীর মণ্ডল বাঁকুড়া পশ্চিমবঙ্গ ভারত, লোকগবেষক, প্রাবন্ধিক, রম্যরচনা,অণুগল্প ও ছোটগল্প এবং ভ্রমণকাহিনীর লেখক)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে