সামিরা দাজানি আর আদেল বুদেইরি’র বাড়ির বাগানটি বড় সুন্দর। ফুটে আছে বোগেনভিলিয়া আর ল্যাভেণ্ডার, আছে ছায়াঘেরা ফলের গাছ। এখানে এলে মরুদ্যানের মত একটা শান্তির অনুভূতি হয়।

কিন্তু এ জায়গাটিই ছিল এক তীব্র-তিক্ত বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু। যার পরিণামে ইসরাইল আর গাজা নিয়ন্ত্রণকারী হামাসের মধ্যে সবশেষ রক্তাক্ত যুদ্ধটি হয়ে গেল।

পূর্ব জেরুসালেমে শেখ জারাহ নামের এলাকাটিতে সামিরা-আদেল দম্পতির একতলা পাথরের বাড়িটিসহ মোট ১৪টি বাড়ি হচ্ছে এই ঘটনার মূলে। এই ১৪টি বাড়িতে বাস করেন মোট ৩০০ ফিলিস্তিনি। তারা এখন উচ্ছেদের হুমকির সম্মুখীন। কারণ এই বাড়িগুলো ভেঙে ইহুদি বসতি নির্মাণ করার পরিকল্পনা করেছে ইসরাইল।

কিন্তু এই উচ্ছেদের চেষ্টার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং সেই মামলা শেষপর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে ইসরাইলের সুপ্রিম কোর্টে। সহিংসতা শুরু হবার পর এ প্রক্রিয়া থেমে গেছে। যে সহিংসতা ছড়াতে ছড়াতে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের রূপ পায়। কিন্তু বিপদ এখনো কেটে যায়নি।

দ্বিতীয়বার শরণার্থী হবার ঝুঁকিতে আদেল আর সামিরা
সামিরা যখন বাগানের ফুলগাছগুলোর মরা ডালপালা ছেঁটে দিচ্ছিলেন, তখন আদেল বলছিলেন, তারা এখন দ্বিতীয়বারের মত শরণার্থী হবার ঝুঁকিতে আছেন। কারণ তাদের পূর্বপুরুষরা এর আগেও একবার উচ্ছেদ হয়েছিলেন।

আদেল বলছিলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে, এই বাড়িতে আমরা যে অনাবিল সুখের সময় কাটিয়েছি তা হয়তো এখন শেষ হবার পথে। আমাদের মনে হচ্ছে আমরা দ্বিতীয় বারের মত শরণার্থী হতে যাচ্ছি।’

উনিশশ’ আটচল্লিশ সালে ইসরাইলের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আদেল ও সামিরা উভয়ের পরিবারকেই পশ্চিম জেরুসালেম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা এখন যেখানে থাকেন সেখান থেকে দাজানি আর বুদেইরি পরিবারের সেই হারানো বাড়ি মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে। কিন্তু ইসরাইলি আইনে এ বাড়ি আর কখনোই পুনরুদ্ধার করা যাবে না।

১৯৫০ এর দশকে শেখ জারাহতে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জন্য বাড়ি তৈরির একটি প্রকল্প নিয়েছিল জর্ডান। যাতে অর্থায়ন করেছিল জাতিসংঘ। কিন্তু এতে যে জমি ব্যবহৃত হয়েছিল তার কিছু অংশের মালিক ছিল দুটি ইহুদি সমিতি এবং সেটা ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির আগের ঘটনা।

তবে ১৯৬৭ সালে যখন ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল জর্ডনের কাছ থেকে পূর্ব জেরুসালেম দখল করে নেয়, তখন সেই দুটি সমিতি তাদের জমি পুনরুদ্ধার করার জন্য একটি মামলা করে।

সামিরা দাজানি- আদেল বুদেইরি

এই বিতর্কিত জমিটির অবস্থান শিমন হাৎজাদিক নামে এক প্রাচীন ইহুদি পুরোহিতের সমাধির কাছে। এখন ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের গোষ্ঠীগুলো জায়গাটি দাবি করছে। তাদের যুক্তি হলো, এখানকার ফিলিস্তিনি বাড়িগুলো কার্যত বস্তি, যাদের কোন আইনী মালিকানা নেই।

এখানে বলে রাখা দরকার যে, এই জমি ও মালিকানা সংক্রান্ত এই পুরো গল্পটির প্রতিটি দিক নিয়েই তীব্র বিতর্ক আছে।

এখন আদেল-সামিরার বাড়ির বাইরে রাস্তায় পরিস্থিতি শান্ত। রমজান মাসের দিনগুলোতে এবং ইসরাইল-হামাস সংঘাতের প্রথম দিনগুলোতে এখানে যে উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ ছিল, তার বিশেষ কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।

রাস্তাটির দুই প্রান্তে পুলিশের ব্যারিকেড আছে। ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা অবাধে চলাফেরা করছে। কিন্তু আপনি যদি ফিলিস্তিনি হন এবং এখানকার বাসিন্দা না হন তাহলে আপনি এখানে ঢুকতে পারবেন না।

জমি নিয়ে বিবাদ ছাড়া কিছু নয়
ইসরাইলি কর্মকর্তারা বলেন, শেখ জারাহ নিয়ে যে সমস্যা তা জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এক্ষেত্রে আইন বসতিস্থাপনকারীদের পক্ষে।

২০০৩ সালে ইহুদি সমিতি দুটি এই জমির অধিকার বিক্রি করে দেয় নাহালাত শিমন লিমিটেডের কাছে। এই প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এবং তারা জেরুসালেমের বিভিন্ন ফিলিস্তিনি এলাকায় ঢুকে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের প্রয়াসে সহায়তা দিয়ে থাকে।

১৯৮৭ সালে ইসরাইলের আদালত একটি বিতর্কিত রায় দেয়। যাতে ইহুদি সমিতিগুলোকে এ জমির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় কিন্তু ফিলিস্তিনিদেরকে সংজ্ঞায়িত করা হয় সংরক্ষিত ভাড়াটিয়া হিসেবে। ওই রায়ের কথা উল্লেখ করে জেরুসালেমের ডেপুটি মেয়র ফ্লোর হাসান-নাহুম বলছিলেন, ফিলিস্তিনি এই পরিবারগুলোকে ভাড়া না দেবার দায়ে উচ্ছেদ করা হবে।

‘ব্যাপারটা এখন জমি-জমা সংক্রান্ত বিবাদ, কিন্তু এটাকে একটা রাজনৈতিক বিবাদে পরিণত করা হয়েছে যাতে একটা উস্কানি সৃষ্টি করা যায়’ বলছিলেন তিনি। তার কথা, ‘আমি বুঝি না কেন পূর্ব জেরুসালেমকে ‘জুডেনরাইন’ হতে হবে। এই জুডেনরাইন শব্দটি ‘ইহুদিমুক্ত ইউরোপ’ বোঝাতে নাৎসীরা ব্যবহার করতো।

রমজান মাসে তৈরি হয় বিস্ফোরক পরিস্থিতি
কয়েক দশকের পুরোনো এ বিবাদ নিয়ে রমজান মাসে শেখ জারাহতে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়। নিকটবর্তী আল-আকসা মসজিদেও দেখা দেয় সংঘাত। হঠাৎ করেই যেন জেরুসালেমে তৈরি হয় অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি।

পূর্ব জেরুসালেমে গত ৩০ বছর ধরে ইহুদি বসতিস্থাপনের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছেন ইসরাইলি আইনজীবী ড্যানিয়েল সাইডেম্যান। তিনি বলছেন, ‘এটা কোন দুর্ঘটনা নয় যে টেম্পল মাউন্ট এবং শেখ জারাহ এই সহিংসতার ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছে।’

‘সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রয়াস আছে, যার লক্ষ্য তাদের সরিয়ে এখানে ধর্মীয়ভাবে উজ্জীবিত সেটেলারদের বসানো। ঠিক এটাই এখানে ঘটছে’ বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আছে একটি শহর, দুটি জনগোষ্ঠী- যারা উভয়েই জমি হারাচ্ছে। কিন্তু একদল তা ফিরে পাচ্ছে, আরেক দল তা পাচ্ছে না। শেখ জারাহর আদি পাপ হচ্ছে এখানেই।’

জেরুসালেমের ভবিষ্যৎকে কেন্দ্র করে হামাস যুদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু শেখ জারাহ’র এই ২৮টি পরিবারের পরিস্থিতি আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে।

আদেল আর সামিরা এখন ঝুঁকির মুখে আছেন, আগামী ১ আগস্ট তারা উচ্ছেদ হতে পারেন। গত ৪৭ বছর তারা যে বাড়িতে বাস করেছেন, তা জয় করা বা হারানোর জন্য তাদের হাতে এখন মাত্র দু’মাস সময় আছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে