সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে সংসারের টানাপোড়েনের অংক যখন অমীমাংসিত, উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও যখন থাকে না তখনও এক মা সন্তানের সান্নিধ্যে যান। অথচ সন্তানের চোখ তখন মোবাইল বা ল্যাপটপের মতো ডিজিটাল ডিভাইসের স্কিনে ঘুরে বেড়ায়। অনলাইনেই যেন তাদের সকল কর্মকাণ্ড এবং ভাবের আদান প্রদান। যেখানে মায়ের আর জায়গা থাকে না। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অব্যক্ত ভালোবাসাটুকু আর অনুভব করা হয়ে উঠে না। এতে আপন মানুষের সঙ্গে ভালোবাসার লেনাদেনা অধরাই থেকে যায়। অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর আধিপত্যের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সমাজ ও নৃবিজ্ঞানীরা। 

মানুষের জীবনকে আরও সহজ করতে ভৌগলিক দূরত্বকে কমাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভূমিকা বড় হলেও তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে পরিবার ও আত্মীয়তার মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে অনলাইনের যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব সম্পর্কে নেতিবাচক কথাই বললেন দোলনচাঁপা মৌ নামে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

তিনি বলেন , ‘প্রযুক্তি ব্যবহারের আমাদের যোগাযোগ এখন সহজ হয়েছে। একই সময় অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা যায়। তবে এ রঙ্গিন দুনিয়ায় নিজের প্রশংসা শুনতে নষ্ট হয়ে অনেক সময়। একই সঙ্গে নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে আপনজনেরা একে অপরের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে উল্লেখ করে মৌ আরও বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে একটা সময় আমরা শেকড় বিহীন গাছে পরিণত হব।’

সহজলভ্য অনলাইন বন্ধুদের ভিড়ে প্রিয়জনদের সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন বেসরকারী চাকুরিজীবি ইমরান হোসাইন রনি।

নিজেকে অবিবাহিত উল্লেখ করে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আমরা মেসে সবাই এক হলে নিজেরা সকলকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও এখন তা হয় না। এখন যে যার মতো করে ইন্টারনেটে সময় ব্যয় করে।’

ইন্টারনেটের গতির সাথে ভালোবাসার বন্ধনটুকুও যেন হারিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ‘যখন শুধু মোবাইলই ছিল তখন ভালোবাসার মানুষের পুরো সময়টাই পেতাম। কিন্তু এখন সেই সময় যেন বিভিন্ন দিকে ভাগ হয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণেই এমনটা হচ্ছে।’

এমনটি বললেন সাইফুল ইসলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর যা হোক হৃদয়ের স্পন্দন থাকে না বলে উল্লেখ করেন সাইফুল।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আপনজন থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে কিনা এমনটি জানতে চাইলে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক তাহমিনা সুলতানা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির ফলে আমরা এখন ভার্চুয়ালি মনের ভাব আদান প্রদান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। তবে মিথ্যা মোহে আমরা অনেকেই গা ভাসাচ্ছি। ভার্চুয়াল যোগাযোগে সত্যিকারের বন্ধু ও শুধু পরিচিতজনদের মধ্যে তফাৎ টাও গুলিয়ে ফেলছি।’ এর ফলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তাহমিনা সুলতানা।

তিনি বলেন, ‘ভার্চুয়াল এ যোগাযোগ মাধ্যম পরিবার তথা সমাজ থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। সম্পর্কের গভীরতা টিকছে না। ঘটছে বিবহা বিচ্ছেদ, সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। এগুলো আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের দিকই নির্দেশ করে।’ একটু সচেতন হলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক সুফল ভোগ করা যায় বলে মনে করেন তিনি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে