অনলাইন ডেস্ক: না ফেরার দেশে চলে গেলেন ভারতের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। আজ (সোমবার) বিকেলে দিল্লির সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। গতকাল থেকে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয় প্রণব মুখাজি। সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে চলেছিল চিকিৎসা। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গত ৯ অগস্ট ভারসাম্য হারিয়ে বাড়ির বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান প্রণব মুখার্জি এরপর দিল্লির সামরিক হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করানো হয়। করোনা পরীক্ষা করানো হলে রিপোর্ট পজেটিভ আসে। পড়ে গিয়ে তাঁর মাথায় যে রক্ত জমাট বেঁধেছিল তা বের করতে অস্ত্রোপচার করেছিলেন চিকিৎসকরা। তারপর থেকেই কোমায় চলে যান প্রণব মুখার্জি।

এর আগে আর্মি রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেল হসপিটালের তরফে সোমবার সকালে প্রণব মুখার্জির শারীরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, ‘রবিবার থেকেই প্রণব মুখার্জির শারীকিক অবস্থা খারাপ হয়। ফুসফুসে সংক্রমণের জেরে তিনি সেপটিক শকে ছিলেন।

মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর আট মাস। দেশের রাজনীতিতে পিতামহ ভীষ্মের মতোই সম্মান পেতেন প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়। বিপুল অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক চেতনায় সমৃদ্ধ এই রাজনীতিকের সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন।

অধুনা বীরভূম জেলার মিরাটিতে ১৯৩৫ সালের শীতকালে, ১১ ডিসেম্বর জন্ম প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। বাবার নাম কামদা কিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, মাতার নাম রাজলক্ষ্মী। কামদা কিঙ্কর কংগ্রেসের রাজনীতিকে নিজের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছিলেন, গান্ধীজির ডাকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। স্বাধীনতার পরে ১৯৫২ সালে কংগ্রেসের মনোনয়নে কামদা কিঙ্কর বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য হন, ওই দায়িত্ব সামলেছেন ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। তিনি কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির সদস্যও ছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রথমে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ ও পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন, পলিটিক্যাল সায়েন্স ও ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি আইন পড়েন ও এলএলবি ডিগ্রি পান।

পড়াশোনা শেষে তিনি প্রথম দিকে পোস্টাল দফতরে আপার ডিভিশন কেরানির কাজ করতেন। পরে ১৯৬৩ সালে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই পর্বে তিনি দেশের ডাক পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজও করেছেন।

১৯৭৩ সালেই ইন্দিরা গান্ধী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে শিল্পোন্নয়ন দফতরের প্রতিমন্ত্রী করেন। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা লোকসভা ভোটে পরাজিত হলে প্রণববাবুও নানা সমস্যার মধ্যে পড়েন। কিন্তু মাত্র তিন বছর পরেই আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফেরেন ইন্দিরা। ১৯৭৯ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজ্যসভায় কংগ্রেসের উপ-নেতা এবং পরের বছর নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় দেশের অর্থমন্ত্রী হন। সেই পর্বে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এই সময়ে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। প্রণববাবুই মনমোহন সিংহকে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর করে নিয়োগপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলে কংগ্রেসের নেতা হয়েছিলেন ইন্দিরার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজীব গান্ধী। প্রথমদিকে রাজীবের সঙ্গে প্রণববাবুর বনিবনা হয়নি, কিছুকালের জন্য তিনি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ১৯৮৬ সালে প্রণববাবু পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে দল গড়েন। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে দূরত্ব ঘুচিয়ে কংগ্রেসেই ফিরে যান, রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেসও মূল কংগ্রেসে মিশে যায়।

১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীও নৃশংস ভাবে খুন হন। সে বছর প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা নরসিংহ রাও। এই আমলে আবার প্রণববাবু কংগ্রেসে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হন। ওই বছরেই তিনি প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, ১৯৯৫ সালে নরসিংহ রাওয়ের ক্যাবিনেটে বিদেশমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সভানেত্রী হন, তখন প্রবীণ রাজনীতিক হিসেবে প্রণববাবু খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন।

১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। ২০০৪ সালে বামদলগুলি ও অন্য কয়েকটি দলের সমর্থনে প্রথম ইউপিএ সরকার হয়, প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিংহ। এবারই প্রথম প্রণব মুখোপাধ্যায় লোকসভায় জিতে আসেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গিপুর আসন থেকে কংগ্রসের টিকিটে জিতেছিলেন। এবার তিনি লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা নির্বাচিত হন। মনমোহন সিংহর আমলে তিনি বিদেশ মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন। ২০১২ সালে প্রণব মুখোপাধ্যায় কংগ্রেস ও সহযোগী দলগুলির সমর্থনে দেশের রাষ্ট্রপতি হন। ওই বছরের ২৫ জুলাই তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। তারপরে মাত্র দু-বছর কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। ২০১৪ সালে প্রণববাবুই নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রীত্বে অভিষিক্ত করেন। ২০১৭ সালে তাঁর রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর থেকে তিনি আর সক্রিয় রাজনীতি করেননি। ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মান পান। গত বছর তাঁকে ভারত রত্ন সম্মান দেওয়া হয়।

২০১৫ সালে প্রণববাবুর স্ত্রী শুভ্রা চলে যান না ফেরার দেশে। এবার চলে গেলেন তিনি। গত ১০ আগস্ট পড়ে গিয়ে আহত হন, হাসপাতালে যান। সেখানে তাঁর করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। তিনি নিজেই সে কথা ট্যুইট করে জানিয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ ট্যুইট। জরুরি ভিত্তিতে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়। তারপরে তিনি ভেন্টিলেশনে ছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাষ্ট্রপতি হওয়ায় লোকসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় সেই জঙ্গিপুর আসন থেকেই লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০১২ সালে। তাঁর কন্যা শর্মিষ্ঠা কত্থক নৃত্যশিল্পী এবং কংগ্রেসের কর্মী।

তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক ব্যক্ত করেছেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা নেত্রীরা। ভারতের রাজনীতির জগতে এক মহীরুহের পতন হল বলে মত রাজনৈতিক নেতাদের।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে