স্টাফ রিপোর্টার: হাটের নাম ‘কাইতলা’। গরুর হাটের জন্য বিখ্যাত। ঢাকার অদূরে গোরাই-সখীপুরের মাঝামাঝি মির্জাপুরের একটি হাট। আশপাশের কয়েক গ্রাম ও অন্যান্য উপজেলা থেকে হাটে গরু আসে। ঢাকার বেপারীরাও যান একটু সাশ্রয়ে গরু কিনতে। গত কয়েক হাটে প্রচুর বিক্রেতা থাকলেও ক্রেতার সংখ্যা অন্যান্য সময়ের চেয়েও যেন কম। আর এতে বিক্রেতাদের চোখে মুখে দুশ্চিন্তা। ঈদ-উল-আজহা আর কয়েক দিনের অপেক্ষা। কোরবানির জন্য দেশের ‘কাইতলা’ গরুর হাটের মতো দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে গরু ওঠানো শুরু করেছেন খামারি-ব্যাপারীরা।

ঢাকার স্থায়ী হাট গাবতলীতেও গরু উঠছে। রাজধানী অনুমোদন পাওয়া অস্থায়ী হাটে আর কদিন পরেই উঠবে গরু। দেশের বিভিন্ন হাটে গরু উঠলেও বিক্রি কমই। আর এতে এবার লাভ নয় বরং মূলধন উঠানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে খামারি-ব্যবসায়ীদের।

দেশের বিভিন্ন পশুর হাট সাধারণত সপ্তাহে এক থেকে দুবার বসে থাকে। হাটসংশ্লিষ্ট ও খামারিদের থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে কোরবানির ঈদের কমপক্ষে ২০-২৫ দিন আগে থেকে গ্রামীণ ও উপজেলার হাটগুলো জমে উঠে। দেশের বড় বড় শহর থেকে ক্রেতারা যান বিশেষ করে পাইকারি ক্রেতারা একটু সাশ্রয়ে পশু কিনে কোরবানির জন্য শহরের হাটে উঠান। এ সময় অনেক মৌসুমি ক্রেতাও দেখা যায়। আর এবার ঈদ চলে এলেও সে দৃশ্য নেই ফলে হাটে পর্যাপ্ত গরু থাকলেও কেনাকাটায় জমজমাট সেই দৃশ্য নেই।

একদিকে হাটে ক্রেতার সঙ্কটের কারণে বিক্রেতাদের মুখ ভার আবার মহামারী এই করোনার সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটগুলোতে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসেবে দেশে ১ কোটি ১৯ লাখ পশু রয়েছে আর কোরবানি হতে পারে ১ কোটি ১০ লাখের মতো। গতবার ১ কোটি ৬ লাখ কোরবানি হয়েছিল।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, এবছরও দেশে কোরবানির জন্য গবাদিপশুর পর্যাপ্ত যোগান রয়েছে। করোনার কারণে গবাদিপশু বিপণনে এবছর আমরা অনলাইন বাজারের ওপর জোর দেয়ার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যেই দেশের বেশ কয়েকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রিও হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ডেইরি ফারমারস ও্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, দেশে সারাবছরে যত গবাদিপশু বিক্রি হয়, তার অর্ধেকেরও বেশি হয় কোরবানির পশুর হাটে। দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আগে সারাদেশে দিনে ৪৫ কোটি টাকার গরু কেনাবেচা হয়েছে। সাধারণত মাংস বিক্রির জন্য কসাইদের কাছে এসব গরু বিক্রি হয়। কিন্তু গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে দিনে গড়ে ১০ কোটি টাকার বেশি গরু কেনাবেচা হয়নি।

ডেইরি ফারমারস এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির জন্য হাটেও ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম কম হতে পারে। আর্থিক মন্দা, করোনায় স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিসহ নানা কারণে অন্যান্য বারের চেয়ে এবার কোরবানি ২০ শতাংশের মতো কম হবে।

বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল ইউটিউবার এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান আজিম বলেছেন, গত বছর কোরবানির পশুহাটগুলোতে প্রচুর গরু অবিক্রীত ছিল। এবার আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকেই কোরবানি দিতে পারবেন না। কারণ, অনেকে এখন চাকরিহীন, নিম্নবিত্তরাও কর্মহীন। যারা আট-দশটা পশু কোরবানি দিতেন, তারা দু-তিনটা দেবেন। অনেকে কোরবানির জন্য বাজেট কমাবেন।

প্রান্তিক পর্যায়ের কয়েকটি হাট ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অন্যান্য বছরের মতো এবার হাট জমছে না। বিক্রেতা আর পশু পর্যাপ্ত হাটে থাকলেও ক্রেতার সঙ্কট রয়েছে। আবার অনেক হাটের ইজারা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন অনেকেই ঈদের দু’চার দিন আগে পশু কিনে থাকেন সে হিসেবেও বিক্রি কম হতে পারে। তবে খামারিরা বলছেন, এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে পশুর হাট একটু কমই জমবে। বিক্রেতাদের মতে, যারা কোরবানি দেন তারা দু’চারদিন আগে কিনলেও ব্যাপারীরা আগে থেকেই গরু কিনে রাখেন যা এবার ব্যাপারীরা খুব বেশি গরু কিনছেন না।

ময়মনসিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল উপজেলায় একাধিক হাট বসে। সাপ্তাহিক এই হাটগুলোতেও ক্রেতা সঙ্কট রয়েছে। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি, সখীপুর, মির্জাপুর গাজীপুরের শ্রীপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার হাটের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাটে প্রতিনিয়ত গরুর সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন আকারের ছোট বড় গরু পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের খাসি ওঠানো হচ্ছে। একেবারে বিক্রি হচ্ছে না তাও নয় তবে বিক্রিটা খুবই কম।

উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ কোরবানি পশুর হাট দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলায়। এই হাটে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা পশু কিনতে আসে। প্রতি শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাইকাররা ছাড়াও কোরবানি পশু কিনতে স্থানীয় ও বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ এ হাটে আসে। দেশের একাধিক স্থান থেকে ব্যাপারী এসে গরু কিনলেও অন্যান্য বছরের চেয়ে কম বলেও জানা গেছে। করোনার কারণে এবার মাইকিং, হাটের বাইরে হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে এই চিত্র একেবারেই নেই।

দিনাজপুর খামারি এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল ঘোষ বলেছেন, এবার গরু বিক্রি করে লাভের মুখ দেখতে পারবেন না খামারিরা। অনেক খামারিসহ কৃষকদের গরু বিক্রি করে লোকসান হবে। করোনার কারণে জেলার বেশিরভাগ মানুষ এবার কোরবানি দেয়া থেকে বিরত থাকবেন।

হাট ইজারাদার আবু সাঈদ বলেছেন, গতবছর প্রতি হাটে তিন থেকে চার হাজার গরু কেনাবেচা হয়েছে। এবার করোনার কারণে প্রতি হাটে ১৫-১৬শ’ গরু বিক্রি হচ্ছে। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করে গরুর পাইকার ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ঢাকার পাশে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর পশুর হাট। এই হাটে ছোট-বড় প্রচুর ষাঁড় গরু দেখা গেলেও এখানেও ক্রেতা সঙ্কটের অভিযোগ রয়েছে। কেরানীগঞ্জের এক ব্যাপারী জানান, হাটে প্রচুর গরু আছে কিন্তু অন্যন্য বারের মতো ক্রেতা নেই। তবে সামনে কিছুটা জমতে পারে বলে আশা করছেন বিক্রেতারা। নরসিংদী জেলার কয়েকটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাটের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে পর্যাপ্ত গরু হাটে ওঠার তথ্য। তবে গরু বিক্রি নিয়ে বিক্রেতারা হতাশ।

ঠাকুরগাঁওয়ের পশুর হাটগুলো পশু দিয়ে জমে উঠলেও হাটে ক্রেতা কম। এছাড়া কিছুদিন আগে এই অঞ্চলে গরুর ল্যাম্পি স্কিন ভাইরাসের কারণে দাম কমে গেছে। গত বছরে যে গরু বিক্রি হতো ৫০ হাজার টাকায়; সে গরু এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ হাজার টাকায়। হাটে মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি। এতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ভয়ানক আকার ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন বলেছেন, ল্যাম্পি স্কিন রোগটি নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই। এ রোগ থেকে গরু সুস্থ হলে মাংস খাওয়া যাবে। কারণ ল্যাম্পি স্কিন ভাইরাসটি ৬০-৬৫ ডিগ্রী তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে না। আমরা মাংস রান্না করে খাই ১৬০-১৭০ ডিগ্রী তাপমাত্রায়। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. কেএম কামরুজ্জামান সেলিম বলেছেন, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য হাটগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য উপজেলা প্রশাসন ও চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দেশের অন্যতম আকর্ষণ থাকে কুষ্টিয়ার হাটগুলোতে। এবার সেখানেও ক্রেতা সঙ্কট দেখা গেছে। এছাড়াও স্থানীয় হাটগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন। কুষ্টিয়ার সর্ববৃহৎ পশুর হাট সদর উপজেলার আলামপুর বালিয়াপাড়া মাঠে। শনিবার সাপ্তাহিক এ হাটে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা ক্রেতা-বিক্রেতারা মুখে মাস্ক পরতেও অনীহা!

এদিকে গাবতলী পশুর হাটেও গরু উঠেছে তবে ক্রেতা নেই। প্রতিবছরই গাবতলীর পশুর হাট জমজমাট হয়ে ওঠে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু-ছাগল নিয়ে আসতে থাকেন ব্যাপারীরা। ঈদের ১০-১২ দিন আগে বেচাকেনা জমে ওঠে। অনেক ব্যাপারী গাবতলী হাট থেকে পশু কিনে আবার এখানেই বিক্রি করেন। দূর দূরান্ত থেকে আসা ব্যাপারীরা ভাল দাম পেলে ঈদের অনেক আগেই পশু বিক্রি করে চলে যান। এক সপ্তাহ পরেই কোরবানির ঈদ। এখনও গাবতলী পশুর হাটের অধিকাংশ জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, পাবনা, রাজশাহী অঞ্চলের অনেকে গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন, কিন্তু ক্রেতা নেই। বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব ব্যাপারী গাবতলী হাটে এসেছেন তারা এবার হাট জমবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।

গাবতলীর হাটে গরু কিনে ব্যবসা করে মুনসুর মিয়া। তিনি বলেন, গরু এবার বেশি কিনছি না বাজার খারাপ গেলে বিক্রি হবে না। অন্যান্য সময় গরুতে পুরো হাটে ভরে যায় ক্রেতার সমাগমও বেশি থাকে। এখন পরিস্থিতি আগের মতো নাই। ১৯ জুলাই হাট থেকে ৫টি গরু কিনেন সোরহাব মিয়া। তিনি বলেন, এসব মোহাম্মদপুরে জবাই হবে। তবে গরুর দাম এখনও স্বাভাবিক মনে হয়েছে তার কোন ক্ষেত্রে দাম কিছুটা কমই।

কুষ্টিয়া থেকে ১৫টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছেন রকিব উদ্দিন নামের এক ব্যাপারী বলেন, গত বছর যে গরু ৭০-৮০ হাজার টাকায় অনায়াসে বিক্রি হতো সেই গরু এখন ৫০ সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার দাম বলে। গতবারের মতো দাম পাওয়া যাবে না বলেও মনে করেন তিনি। এক্ষেত্রে নিয়ে আসা গরুতে লাভ নয় কোন ভাবে বিক্রি করে চালানের টাকা ওঠাতে পারলেও স্বস্তি তার।

একাধিক গরু বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্যান্য বছর তিন মাস আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যাপারীরা গরু কিনেন। এবার বাড়ি বাড়ি ব্যাপারীও দেখা যায়নি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে