আজকাল মেয়েরা কথায় কথায় বলে যে তাঁরা পুরুষের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আসলে একথা বলে মেয়েরা নিজেরাই প্রমাণ করে যে তাঁরা পুরুষের সমকক্ষ নয়।

প্রকৃত অর্থে লিঙ্গ ভেদে অধিকারে বৈষম্য থাকা বাঞ্ছনীয় নয়, তাই ওসব কথা বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক। নারী শক্তি নাকি পুরুষ শক্তি, কে কার থেকে এগিয়ে, কে পিছিয়ে, সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে ; কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় সেটা বিবেচ্য বিষয়ই নয়। লিঙ্গ ভেদে যেমন অধিকারে বৈষম্য বাঞ্ছনীয় নয় ,তেমনি ক্ষমতার বৈরিপ্তও শোভনীয় নয়। অথচ হিন্দুশাস্ত্র মতে, আমাদের সমাজে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে দেবতা অপেক্ষা দেবীর পূজণই বেশি হয়ে থাকে। যদিও পুরুষ সমাজে এর অন্য একাধিক ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু সমাজে বাস্তবিক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রতিনিয়ত যে সমস্ত নারীকে অবহেলা ,লাঞ্ছনা ,গঞ্জনা ও উৎপীড়ন সহ্য করতে হয়(যদিও আজকাল আখছার এর উল্টো ঘটনাও ঘটছে) । এক্ষেত্রেও তাই বর্তমান সমাজে পুরুষদের ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে।

এবার সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের দিকে আলোকপাত করা যাক। আমাদের সমাজে এমন কিছু অনুষ্ঠান পালন করা হয় যা আসলে নারী কেন্দ্রিক ।কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে সেই অনুষ্ঠানের ভরকেন্দ্রেও পুরুষই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন জামাইষষ্ঠী তার মধ্যে অন্যতম। পুরাণ মতে, স্কন্ধ ষষ্ঠী পুজো অনুষ্ঠানে বাবা মা মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আমন্ত্রণ করেন যাতে সে মা ষষ্ঠীর কৃপায় সন্তান লাভ করতে পারে। অনুষ্ঠানের নাম ষষ্ঠী পুজো। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে যে ষষ্ঠী অনুষ্ঠান নিজের মেয়ের মঙ্গলার্থে আয়োজিত, সেখানে ষষ্ঠীর আগে জামাই শব্দটি ঢুকে গিয়ে অনুষ্ঠানের পালের হাওয়া সম্পূর্ণ জামাইয়ের দিকে ঝুঁকে গেছে। পরবর্তীতে বাঙালির ঘরে ঘরে সেই অনুষ্ঠানে জামাইকে রাজকীয় যত্ন-আত্তি করার অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে।সেটা আসলে জামাইয়ের নতুন বস্ত্র ও পঞ্চ ব্যঞ্জনে ভুরিভোজের অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

বর্তমানের অধিকার সচেতন শিক্ষিত অত্যাধুনিক বঙ্গললনা এখানেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসেছে। বাবা মায়ের পরম আদরের মেয়েকে সারা জীবনের জন্য যার হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাকে খাইয়ে-দাইয়ে নতুন বস্ত্রে সন্তুষ্ট করা-ই যদি জামাইষষ্ঠীর মূল উদ্দেশ্য হয়; তাহলে যে মেয়েটি জন্ম থেকে বাবা মায়ের কোলে পিঠে মানুষ হয়ে পরিণত বয়সে পিত্রালয় ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন এক অচেনা অজানা পরিবেশে শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজেকে মানিয়ে নিয়ে সকলকে সুখী করার আপ্রাণ ব্যর্থ চেষ্টা করে যায়, তবে তার ক্ষেত্রে বৌমাষষ্ঠী পালিত হলে ক্ষতি কিসের? আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিপুষ্ট বাঙালি হিন্দু সমাজের আনাচে-কানাচে তাই তো বৌমাষষ্ঠী পালনের তীব্র দাবি উঠে আসছে। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়িতে জামাইবাবাজি যে আদর আপ্যায়ন পায় ,অনুরূপ একটি বিশেষ দিন বৌমাদের শ্বশুরবাড়িতে বরাদ্দ হোক। তাঁদেরও তো ইচ্ছে করে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাঁদের একটু আদর আপ্যায়ন করুক। সারাবছর না হোক অন্তত একটি দিন তো তাঁরা প্রত্যাশা করতেই পারে। অধিকাংশ বৌমারা সারা বছরই তো শ্বশুরবাড়িতে বৌমা-কাম কাজের মাসীর ভূমিকা পালন করে দিন যাপন করে থাকেন। বছরে একটি দিন না হয় তাঁদের রাজকীয় খাতির করা হল।

এটা ভেবে সমস্ত বাঙালি বৌমারা খুশি হবে যে ,বৌমাষষ্ঠীর দিনে ভোরবেলা তাঁর শ্বশুর মশাই থলে হাতে বাজারের দিকে ছুটছেন। বৌমার পছন্দের ইলিশ ,কচি পাঁঠার মাংস কিংবা মুড়িঘন্টের জন্য বাজারের সবচেয়ে বড় কাতলা মাছের মাথাটা কেনার জন্য মুখে রুমাল গুঁজে প্যাঁচপ্যাঁচে মাছের বাজারে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। বাড়ি ফেরার পথে মোড়ের মাথায় ফটিকের মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি ও এক হাঁড়ি দই হাতে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দরজার বেল বাজাচ্ছেন। সেই সাধের বাজারের ব্যাগ নিয়ে শাশুড়ি মা হন্তদন্ত হয়ে হেঁসেলে প্রবেশের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তিনি কয়েক ঘণ্টা ধরে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পঞ্চ ব্যঞ্জন রান্না করে বৌমার সামনে সাজিয়ে দিচ্ছেন। বৌমা সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে রাজকন্যার বেশে বড় এক কাঁসার থালায় বাসমতী চালের ভাত ও থালার চারপাশে থরে থরে বিভিন্ন পদে সাজানো বাটি নিয়ে খেতে বসেছে। বৌমার এক পাশে শাশুড়ি বসে বৌমার খাওয়া-দাওয়া তদারকি করছেন এবং সামনে বসে শ্বশুরমশাই তালপাতার পাখা দিয়ে বৌমাকে হাওয়া দিচ্ছেন। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের প্রশ্নে জামাইষষ্ঠীর পরিপূরক বৌমাষষ্ঠীর প্রতিচ্ছবি তো এমনই হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আধুনিকতার মোড়কে বাঙালি মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট সাবলিল। তাই তাঁদের শক্তিশালী যুক্তি ,—তাঁরা জামাইষষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়; কিন্তু পাশাপাশি বৌমাষষ্ঠীও থাকতে হবে। এখনকার মেয়েরা ঘরে-বাইরে পুরুষের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছেন। ঘরে এসে দুহাতে যেমন সংসার সামলাচ্ছেন ,তেমনি ঘরের বাইরে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে অফিসও সামলাচ্ছেন। তাহলে পারিবারিক কোনো এক নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে কেবলমাত্র পুরুষের আধিপত্য থাকবে কেন? এখন বাঙালি শিক্ষিত পরিবারে পুত্র সন্তান বা কন্যা সন্তান বলে কোনো ভেদাভেদ নেই। তাই তো বৌমাষষ্ঠী নিয়ে নারীবাদীরা সরব হবেন সেটাই স্বাভাবিক। তেমনি তাঁদের এই দাবি বা অধিকার যাই বলা হোক না কেন ,সেটা আদায় করতে সমস্ত বৌমারা যে এক ছাতার তলায় আসবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। তবে পুরুষ শাসিত সমাজে এ লড়াইয়ে বৌমাদের যে কঠিন পিচে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাটিং করতে হবে,
সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।

আসলে বৌমাষষ্ঠী পালন শুরু হলে আরো অনেক গুলো ঘটনা তাদের পেছনে পেছনে চলে আসবে।যেমন বর্তমানের সোশ্যাল নেটওয়ার্কের যুগে ঐদিন ফেসবুক, টুইটার ও হোয়াটসআপ-এ বৌমাদের ছবিতে ছয়লাপ হয়ে থাকবে। ফেসবুকে বড় বড় করে লেখা থাকবে ‘বৌমা-শাশুড়ি বেস্ট ফ্রেন্ড’ কিংবা ‘বৌমা-শাশুড়ি ঝগড়া’। বাজারের খ্যাতনামা মিষ্টির দোকানে বৌমা লেখা মিষ্টি থরেথরে সাজানো থাকবে। যে সমস্ত শ্বশুর-শাশুড়ি সারা বছর বৌমাকে বাক্যবাণে বা অন্যান্য অপ্রিয় আচরণে বিদ্ধ করে অভ্যস্ত (যদিও আধুনিক স্বাধীনচেতা অসংখ্য বৌমা একই কাজ করে থাকেন); তাঁরা লোকলজ্জার ভয়ে ঐদিন অন্তত বিরত থাকবেন। ঐদিন বিভিন্ন দোকান, শপিং মল ও জুয়েলারী সপে নিশ্চিত “বৌমাষষ্ঠী স্পেশাল ছাড়” ঘোষিত হবে। হয়তো পাড়ার ক্লাবগুলো ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ‘বেস্ট বৌমা- শাশুড়ি’ ও ‘ বৌমা-শাশুড়ি ঝগড়া’ নামে বিভিন্ন রকম প্রতিযোগিতা মূলক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। এতে করে বৌমাদের গুরুত্ব ও আভিজাত্য দুটোই বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বৌমাষষ্ঠীর দিনে শাশুড়ি মায়ের হাত থেকে নতুন বস্ত্র বা শাড়ি প্রাপ্তি বৌমাদের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। এসব টুকরো টুকরো ঘটনার সাক্ষী থাকতে পেরে বৌমারা যদি একটু আহলাদিত হন, তাহলে অসুবিধা কোথায়?

বৌমাষষ্ঠীর দিনক্ষণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বৌমারাই একটা বিষয়ে একমত যে ,জামাইষষ্ঠীর দিনে কিছুতেই বৌমাষষ্ঠী হবে না; কারণ ঐদিন তাঁদের স্বামীর সঙ্গে বাবার বাড়ি যেতে হয়। সেই কারণে কিছুতেই তাঁরা বৌমাষষ্ঠীর আনন্দ কাটছাট করতে রাজি নয়।বৌমাষষ্ঠী হতে হবে জামাইষষ্ঠীর আগে। এক্ষেত্রে তাঁদের অকাট্য যুক্তি হল –বৌমাষষ্ঠীর রাজকীয়তার উপরই নির্ভর করবে জামাইষষ্ঠীর রাজকীয়তা।তাই বৈশাখ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে বৌমাষষ্ঠীর মোক্ষম দিন হতে পারে। জামাইষষ্ঠীতে শাশুড়ি-জামাইয়ের আহ্লাদেপনার পাশাপাশি বৌমাষষ্ঠীতে শাশুড়ি-বৌমার আহ্লাদেপনার মুহূর্ত সৃষ্টি হলে ক্ষতি কিসের? এমন করে বাঙালিরা যদি স্বরচিত গণ্ডির বাইরে এসে একটি দিন অতিবাহিত করেন ,তাহলে প্রতিটি পরিবারের লাভ বৈকি ক্ষতি অন্তত হবে না।এতে যদি বৌমা মেয়ের মত এবং শ্বাশুড়ি মায়ের মত হওয়ার দৌড়ে একধাপ এগোয় তাতে ক্ষতি কি ?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে