ডঃসুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি :

লাল মাটিতে ফলছে আম। ফলছে স্বপ্ন। মালদা-মু‍র্শিদাবাদের আমকে টক্কর দিচ্ছে বাঁকুড়ার আম। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে হাসি চওড়া আম চাষিদের।

বিদেশের বাজারেও নাম কিনছে বাঁকুড়ার আম।আম আদমির আম প্রীতির তালিকায় এবার আরও একটা জেলার নামের সংযোজন। মালদহ-মুর্শিদাবাদের আমের পাল্লা আগেই ভারী ছিল। সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে বাঁকুড়ার আম। আম্রপালি, মল্লিকা, ল্যাংড়া, আলফ্রানসোর মুকুল ধরেছে লাল রুখা মাটিতেই। আম চাষের  শুভ সূচনা হয়  ২০০২ সালে। বাঁকুড়ার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা আম চাষ শুরু করেছিলেন। নতুন সরকারের আমলে একক মালিকানায় শুরু হয়েছে আম চাষ। আরও বেশি জমিতে। বেশি পরিমাণে। চাষিদের উৎসাহী করেছে উদ্যান পালন দফতর।আম চাষিদের গাছের চারা বিতরণ করা হয়, সেই  সঙ্গেই পরিচর্যার  আধুনিক  প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।কীটনাশক নিয়ে  সচেতনতার মেধাবী পাঠে চাষিদের সমৃদ্ধ করে তোলা  একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস করে চলেছে জেলার উদ্যান পালন দপ্তরের তত্ত্বাবধানে। এটা চাষিদের কাছে বড় প্রাপ্তি বলে মনে হয়েছে।  সমগ্র জেলায় আনুমানিক  ৪ হাজার হেক্টর জমিতে ব্যাপক আম চাষ করা হয়েছে এ-বছরে। প্রতি  হেক্টর জমিতে লাগান হয়েছে ৪৫০টি করে গাছ। বাঁকুড়া সদর ও খাতড়া মহকুমায় সবথেকে বেশি আমের চাষ হচ্ছে। মজবুত হচ্ছে জেলার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো। চলতি মরশুমে জেলায় আমের ফলন হয়েেছ ১৬০০ মেট্রিক টন ।চাষের সঙ্গেই বিপণনেও সাহায্য করছে রাজ্য। কলকাতা-দিল্লিতে বাজার পেয়েছে বাঁকুড়ার আম। পাড়ি দিয়েছে বিদেশেও। চাষিরা বলছেন, ভাল আছি  আমের আমি,  আমের তুমি।’ কিন্তু আম দিয়ে কি চেনা যায়? নাহ.. আলাদা করে না বলে দিলে লাল মাটির আম চেনার জো নেই। স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে সেরার সেরা।

কিন্তু আমে স্বাদ নেই। বাজার ছেয়ে আছে পানসে চালানি আমে। তার দামও যেন পারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ছে। কোথাও চল্লিশ টাকা কেজি তো কোথাও পঞ্চাশ টাকা। অবশেষে জেলাবাসীকে কিছুটা স্বস্তি দিতে আসরে হাজির হচ্ছে  বাঁকুুুড়ার উদ্যানপালন দফতর।

গতকাল সোমবার  থেকে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনিক ভবন চত্বর ও তালড্যাংরা ফার্ম হাউসের সামনে আম বিক্রির স্টল চালু করতে চলেছে উদ্যানপালন দফতর। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার আম্রপালি, আলফানসো, সফদার পসন্দ, কোহিতুর, গুলাবখাসের মতো বেশ কিছু মিষ্টি জাতের আম মিলবে ওই স্টলগুলিতে। সমস্ত আমই উদ্যানপালন দফতরের তালড্যাংরার ফার্ম হাউসে চাষ করা হয়েছে। জেলার উদ্যানপালন দফতরের ফিল্ড অফিসার সঞ্জয় সেনগুপ্ত জানান, স্টলে আম্রপালি, মল্লিকা, ল্যাংড়া-র মতো বিভিন্ন প্রজাতির আম চল্লিশ টাকা কেজি দরে ও আলফানসো ষাট টাকা কেজি দরে বিক্রি হবে। স্টল থেকে আমের পাশাপাশি জেলার সবেদা, পেয়ারা ও মুসাম্বিও মিলবে।

২০১৪ সালে রাজ্য আম মেলায়, স্বাদের বিচারে মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার আমকে টপকে কদর পেয়েছিল বাঁকুড়ার রুক্ষ মাটির আলফানসো। ওই বছর দিল্লির জাতীয় আম মেলাতেও নজর কাড়ে বাঁকুড়ার আম। তখন থেকেই জেলার বাজারেও ব্যপক চাহিদা বাড়ে আমের। মূলত  ২০০২   থেকে  শুরু হলেও  সাফল্য আসে ২০১৪  সালে। এরপর শুধুমাত্র  ইতিহাস  সৃষ্টি করে চলেছে  লাল মাটির মানুষের দেশ বাঁকুড়া।জেলা বাসীর কাছে এটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এক সময়  লাল তরমুজের দেশ বলা হতো  দক্ষিণ বাঁকুড়াকে। তরমুজ আর আম চাষের সাফল্যে এখানকার  গ্রামীন  অর্থনীতির ভিত  বেশ কিছু  বছর  মজবুত  হয়ে উঠেছে। চাষিদের মুখে  হাসি ফোটাতে  সরকারের ইতিবাচক সহযোগিতা ও  উদ্যোগ প্রশংসনীয়।      আলফানসো ওই (২০১৪)বছর দিল্লির জাতীয় আম মেলাতেও নজর কাড়ে।  কলকাতার  আম প্রেমিক  মানুষের  ডাইনিং টেবিলে  পৌঁছে যায়  বাঁকুড়ার  লাল মাটির আম্রপালী আর আলফানসো।   তখন থেকেই জেলার বাজারেও ব্যপক চাহিদা বাড়ে আমের।। অন্য বছর ওই আম নিলামে ডাক করে ব্যবসায়ীদের বিক্রি করত দফতর। তবে এ বার সরাসরি ক্রেতাদের বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেলা উদ্যালন পালন দফতরের উপ-অধিকর্তা মিলনচন্দ্র বেসরা বলেন, “জেলার ক্রেতারা যাতে ন্যায্য দামে গাছ পাকা সুস্বাদু আম পান সেই কথা ভেবেই এ বার স্টল গড়ে আম বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।” রাজ্য এগ্রো ইন্ডাস্টিজ কর্পোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশিস বটব্যাল জানান, গত বছর জেলার আম দুবাই-এর বাজারে ভাল সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু মিলনবাবুর কথায়, ‘‘এত দিন নিলাম করা হতো বলে বাঁকুড়ার বাজারেই তালড্যাংরা ফার্ম হাউসের আম বিশেষ পাওয়া যেত না। এ বার স্টল থেকে বাঁকুড়াবাসী জেলার আম খুচরো দরে কিনতে পারবেন।’’

শুভাশিসবাবু জানান, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জেলায় এই বছর প্রায় ৫০ হাজার টন আমের ফলন হয়েছে, যা গতবারের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আম চাষে লাভ দেখে জেলার অনেকেই ব্যবসায়িক ভাবে আম চাষে উদ্যোগী হয়েছেন। এ বার ইতালির ব্যবসায়ীরাও বাঁকুড়ার আম নিয়ে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছেন। উদ্যানপালন দফতরের মধ্যস্থতায় জেলার আম চাষিদের সঙ্গে ইতালির ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাঁর কথায়, “বাঁকুড়ায় সুস্বাদু আম চাষ যে সম্ভব, সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। বিদেশে চড়াদামে আম রফতানি করা হচ্ছে।” তাঁর মতে, আগামী কয়েক বছরে জেলায় আম চাষ আরও কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। করোনার ভয়াবহ আবহে এ বছর  বিদেশে আম রফতানি অনেক খানি  বন্ধ  ফলে জেলা বাসীর কাছে   সুবর্ণ সুযোগ  এসেছে। নিজের পছন্দ মত আম খাওয়ার সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করতে  চাইছে না।

নিজের  জেলার  আমের স্বাদ যাতে তাঁরা চাখতে পারেন তালড্যাংরা ফার্ম হাউসের ৩৫ বিঘা জমিতে কমবেশি ষাট টন আমের ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন  ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক  বেসরা সাহেব।  দক্ষিণ বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আম্রপালী জুড়ি মেলা ভার। আম্রপালীর আঁতুড়ঘর হলো  খাতড়া মহকুমার, খাতড়ার মুকুটমণিপুর, খড়িডুংরি , বারঘুটু, শিবরামপুর, গোড়াবাড়ি  দহলা, আড়কামা,সুপুর,ভারত সবাশ্রম ,রানিবাঁধের জঙ্গল মহলের ঝিলিমিলি, বারিকুল , অম্বিকানগর,  সিমলাপালের লক্ষীসাগর,  পুকুরিয়া,   ইন্দপুর, হীড়বাধের, ঝড়িয়াকোচা বিরাডি,  রাঙামাটি, হাতিরামপুর,মলিয়ান ,রাইপুর, সারেঙ্গার বিস্তীর্ণ এলাকা।

আলফানসোর আঁতুড়ঘর  হলো তালডাংরার  হাড়মাসড়া, ভ্যালাইডিহা, সাবড়াকোন সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। এক সময়  বি,ডিও হিসাবে এই অঞ্চলে আসেন কৃষিবিজ্ঞানী  ডঃ বাবুলাল মাহাত। পরে মহকুমা আধিকারিক  হিসাবে দীর্ঘ সময় থাকেন এই জেলায়।ওনার  হাত ধরে  এই সাফল্য অর্জন করেছে অনেকটাই  দক্ষিণ  বাঁকুড়া  ।আম্রপালী আমের  সবুজ উপত্যকা তৈরি হয়েছিল  সেই সময়ে। বহু  বাগানের পরিকল্পনা  তার মস্তিষ্ক প্রসূত। ডঃবাবু লাল মাহাত মহাশয় পুরুলিয়ার  একজন কৃতি ভূমিপুত্র। এই এলাকার মানুষের কাছে গর্বের মানুষ। ওনার অবদান ভোলার নয়। আগামী শিক্ষিত  প্রজন্মকে  আম চাষের  সর্ব আধুনিক   শিক্ষায় শিক্ষিত করে  আম্রপালী আমের চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পারলে বহু  শিক্ষিত তরুণদের কাছে  বিকল্প  আয়ের  পথ  সুগম হতে পারে  বলে আমার মনে হয়।

ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি জায়গায়  উচ্চ  শিক্ষিত যুবক  আম্রপালী আর আলফানসোর বাগান থেকে  ভালো আয় করছে। এ বিষয়ে কথা বলেছি বাঁকুড়া ‘- পুরুলিয়ার  সীমান্তে গনেশ বাউরি  মহাশয়ের  সঙ্গে। উনি  পেশায় শিক্ষক কিন্তু  নেশায় এক সফল বড় ধরনের চাষি।আধুনিক  প্রযুক্তির ব্যবহার করে  সবজি চাষে  বিপ্লব  ঘটিয়েছেন।  বিশ্বের আম চাষের  অনুকূল পরিবেশ এখানে রয়েছে। দরকার আরও  সরকারের উদ্যোগ।  খাতড়া  পঞ্চায়েত সমিতির  কৃষি কর্মাধ্যক্ষ  শ্রী  সুব্রত  মহাপাত্র  জানালেন  এ ব্যাপারে  বড় পাইলট  প্রজেক্ট গ্রহণ করতে  চলেছে মহকুমা প্রশাসক। এছাড়া ব্যক্তিগত  উদ্যেগে  চলেছে  আম্রপালী বাগান। খাতড়া মহকুমা শহর জুড়ে বহু মানুষ আম্রপালী আর আলফানসোর গাছ লাগিয়েছেন।ফলন অসাধারণ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে