যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সমাজসংস্কারকগণ এসেছেন, নারী অধিকারের কথা বলে গেছেন, নারী মুক্তির আন্দোলন করেছেন। সমাজের কুসংস্কার থেকে নারীদের রক্ষার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। সমাজকে সচেতন করতে উদ্যোগী হয়েছেন। এ ভূখণ্ডে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু কথা ও লেখনী দ্বারা নয়, বাস্তব জীবনে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন। স্বাধীন দেশের সকল নাগরিকের সম-অধিকারের কথাও তিনি বলেছেন। ‘এই ঘুণে ধরা সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ আমরা গড়ব’—এটা ছিল তার আন্তরিক প্রত্যয়। তাই তিনি সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যার সুফল আজ বাংলাদেশের নারীসমাজ পাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নারীগণ আজ নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দেবে অধিকার?/ হে বিধাতা’… বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ আকুতি করে গেছেন। কারণ, তিনি নারী অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার আধুনিক চিন্তা ও ভাবধারায় সমৃদ্ধ ছিল। সমাজকে এগিয়ে নিতে এই পরিবারের অনেক অবদান রয়েছে। শিক্ষাদীক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক চর্চা এবং কুসংস্কার দূর করার ক্ষেত্রেও সে সময় তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন—‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী/ অর্ধেক তার নর।’ সমাজে নারীর যে অবদান রয়েছে সে কথাই তিনি তুলে ধরেছেন তার কবিতায়। নারীকে তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন কবি নজরুল ইসলাম এই লেখার মধ্য দিয়ে। এ বার্তাই পৌঁছে দিয়েছেন যে, নারীকে অবহেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষের যে কোনো অর্জনের পেছনে নারীর অবদান রয়েছে। তাদের ত্যাগ-প্রেরণা-উত্সাহ পুরুষকে শক্তি ও সাহস জোগায়। সে অবদান ভুলে যাওয়া ঠিক নয়। কবি নজরুল আধুনিক চিন্তা-চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারায় বিশ্বাস করতেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মা ছেলেকে, বোন ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন। প্রেরণা দিয়েছেন। ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্গী হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে মা-বোনদের অবদান অপরিসীম।
যুদ্ধে বিজয়ের পর জাতির পিতা শেখ মুজিব প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে নারীর সম-অধিকার বিষয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭, ১৯, ২৮, ২৯-সহ বিভিন্ন ধারায় নারীর শিক্ষা, চাকরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ সৃষ্টির বাধ্যবধকতা সন্নিবেশ করে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করেছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামাচা’ এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন’—বইগুলোতে তিনি নারী অধিকারের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তাদের সমস্যা, দুঃখ-কষ্ট সমাধানের কথাও তিনি বলেছেন।
১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চীন গিয়েছিলেন শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে। যাওয়ার পথে বার্মা (মিয়ানমার) এবং হংকং হয়ে যেতে হয়েছিল। সেখানে যাত্রাবিরতির সময় তিনি শুধু নতুন জায়গা দেখেননি, সামাজের অবস্থা, সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক বিষয়গুলোও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বিশেষ করে নারীদের অর্থনৈতিক দৈন্যের বিষয়গুলো তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছেন। সামাজিক বিষয়ে নিজের চিন্তাভাবনার কথা উল্লেখ করে সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন তার বইগুলোতে।
সমাজে নারীর ওপর যে বৈষম্য ও নির্যাতন চলে, সে বিষয়ে নয়াচীন যাওয়ার পথে হংকংয়ে যাত্রাবিরতির সময় সেখানকার সমাজব্যবস্থা বিষয়ে যা দেখেছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :‘এই মেয়েদের দোষ দিয়ে লাভ কি? এই সমাজব্যবস্থায় বাঁচবার জন্য এরা সংগ্রাম করছে, ইজ্জত দিয়ে পেটের ভাত জোগাড় করছে। হায়রে মানুষ! রাস্তায় রাস্তায় বহু মেয়েকে এইভাবে হংকং শহরে ঘুরতে দেখা যায়।…দেশের মালিক ইংরেজ, জনগণ না।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ৯৯)
তাঁর হৃদয় ব্যথিত হয়েছে নারীদের এই দুর্দশা দেখে। হংকং তখন ইংরেজদের কলোনি ছিল। জনগণের হাতে ক্ষমতা ছিল না। সেখানকার জনগণ অবর্ণনীয় শোষণ-বঞ্চনার শিকার ছিল। আর তাই সরকারের যে দায়িত্ব রয়েছে—মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার—সে কথাই তিনি বারবার উল্লেখ করেছেন। সমাজের দায়বদ্ধতার কথা বলেছেন।
চীনে শান্তি সম্মেলনের সময় তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়ে তিনি লিখেছেন—‘আজ নয়াচীনে সমস্ত চাকুরিতে মেয়েরা ঢুকে পড়ছে। পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। প্রমাণ করে দিয়েছে পুরুষ ও মেয়েদের খোদা সমান শক্তি দিয়েই সৃষ্টি করেছে। সুযোগ পেলে তারাও বৈজ্ঞানিক, ঐতিহাসিক, ডাক্তার, যোদ্ধা সকল কিছুই হতে পারে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ৯৯)
ধর্মের নামে মেয়েদের ঘরে বন্দি করে রাখতে চায় একদল। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব উল্লেখ করেছেন—‘মুসলিম দেশ তুরস্ক নারীর স্বাধীনতা স্বীকার করেছে। নারীরা সে দেশে যথেষ্ট অগ্রসর হয়েছে। তুরস্কে অনেক মেয়ে পাইলট আছেন, যাঁরা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ পাইলটদের মধ্যে অন্যতম।…আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত লোকের মনে এই ধারণা যে পুরুষের পায়ের নিচে মেয়েদের বেহেস্ত। পুরুষ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মেয়েদের নীরবে সব অন্যায় সহ্য করতে হবে বেহেশতের আশায়। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে মেয়েদের নির্ভর করতে হয় পুরুষদের অর্থের উপর।’
ইসলাম ধর্ম নারীদের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। মেয়েরা যে শুধু ঘরে আটকে থাকবে, বাইরে যাবে না, পরনির্ভরশীল বা পুরুষদের উপার্জনের ওপরই কেবল নির্ভরশীল থাকবে, তা কিন্তু নয়। বরং নবিজির যুগেও মেয়েদের যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল।
পুরুষদের পাশাপাশি থেকে দায়িত্ব পালন করতেন, এমনকি রণাঙ্গনেও তাদের ভূমিকা ছিল। এ কথাও তিনি লিখেছেন :‘…কিন্তু ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, মুসলমান মেয়েরা পুরুষদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যেত, অস্ত্র এগিয়ে দিত। আহতদের সেবা-শুশ্রূুষা করতো। হযরত রসুলে করিম (স.)-এর স্ত্রী হযরত আয়েশা নিজে বক্তৃতা করতেন। দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়াছে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ১০০)
নারী নেতৃত্ব যাতে গড়ে ওঠে সেজন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের সংবিধানে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রাখেন। ১৯৭২ সালে মাত্র নয় মাসের মধ্যে এই সংবিধান অর্থাত্ শাসনতন্ত্র তিনি রচনা করেন। নারীর অধিকার নিশ্চিত করার এক বিরল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনী গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই তারা করেনি। আমাদের দেশের মেয়েদের ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে তাদের লালসা মেটাতে তুলে দেয়। বিজয়ের পর সেই নির্যাতিত মেয়েদের উদ্ধার করে চিকিত্সার ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
সমাজে এই নারীরা যেন মাথা উঁচু করে চলতে পারে এজন্য তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের এই আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখান। অনেকের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তাদের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করেন। যখন বিয়ের ব্যবস্থা হয়, অনেক পিতা সন্তানের পরিচয় দিতে সমাজের ভয়ে পিছিয়ে যায়। তখন তিনি পিতার নামের স্থানে শেখ মুজিবুর রহমান আর বাড়ির ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের তার বাড়ির ঠিকানা লিখে দিতে বলেন। এই পরিচয়ে মেয়েদের বিয়ে হয়। এই ঘোষণার পর আর কোনো দ্বিধা কারো মনে ছিল না। বঙ্গমাতা নিজে বিয়ের সব ব্যবস্থা করেন।
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করেন, যেখানে নির্যাতিতা নারীদের অগ্রাধিকার ছিল। এ সবই ছিল যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
পাকিস্তানি শাসনামলে জুডিশিয়াল সার্ভিসে নারীদের অংশগ্রহণ আইন করে বন্ধ ছিল। মেয়েরা কখনো জজ হতে পারতেন না। স্বাধীনতার পর সে আইন পরিবর্তন করে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। চাকরির ক্ষেত্রে সর্বত্র মেয়েদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন। পুলিশ বাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ দেন। এর কারণ হলো, তিনি বিশ্বাস করতেন অর্থনৈতিকভাবে একজন নারী যদি স্বাবলম্বী হয়, তাহলে সংসার ও সমাজে তার অবস্থান শক্ত হবে। সংসারে তার মতামত দেওয়ার সুযোগ থাকবে।
তিনি বলেছেন, ‘একজন নারী যদি নিজে উপার্জন করে ১০টা টাকাও কামাই করে তার আঁচলের খুঁটে বেঁধে আনে, তবে সংসারে তার গুরুত্ব বাড়ে।’ এ কথাটা আমি আমার বাবার মুখে বারবার শুনেছি। এ কথার অর্থ হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। আমাদের সমাজে একজন পুরুষ মানুষ অর্থ উপার্জন করে আর পুরো পরিবার তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মুখাপেক্ষী হতে হয় গোটা পরিবারকে। আর এ কারণেই আর্থিক স্বাবলম্বিতা একান্তভাবে অপরিহার্য। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সে সুযোগ করে দিতে পারে। শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য মেয়েদের শিক্ষা তিনি অবৈতনিক করে দেন। পিতা-মাতার কাঁধের বোঝা হালকা করে দেন।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭ (ক)-এ উল্লেখ করা আছে : ‘রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’
এখানে ‘বালিকাদের’ কথাটা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে মেয়েদের শিক্ষাটা নিশ্চিত হয়; গুরুত্ব পায়— সে চিন্তা থেকেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
বেগম রোকেয়া নারীদের শিক্ষা ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে তিনি লিখেছেন :‘তোমাদের কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজেরাই নিজেদের অন্ন, বস্ত্র উপার্জন করুক।’
একটি সমাজকে গড়ে তুলতে হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই প্রয়োজন। যে সমাজের অর্ধেকটা নারী, তাদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন করা যায় না। একটা দেশ, একটা সমাজ বা সংসারের সবাই যদি পণ করে, তারা সত্যিকারের উন্নতি করতে চায়, তাহলে অবশ্যই সবাইকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। মেধা মনন ও শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ (৩)-এ উল্লেখ রয়েছে :‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ সংবিধানে সব নাগরিকের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘সরকারি নিয়োগ লাভের সুযোগের সমতার’ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লিখেছেন :‘সত্য কথা বলতে গেলে একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে, তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনো দিন বড় হতে পারে না।’
৬৯ বছর পূর্বে ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এ কথা উপলব্ধি করেছিলেন; অথচ তখনকার সমাজব্যবস্থা ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এই কুসংস্কারের অচলায়তন ভেঙে সামজের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনকেই গুরুত্ব দেওয়া অপরিহার্য। তাই নারী পুরুষকে একই সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(২)-এ বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’
চীন ভ্রমণের সময় কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি লিখেছেন :‘নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলকারখানাতে, সৈন্য বাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।… যে সমস্ত ফ্যাক্টরি, কলকারখানা, সরকারি অফিসে আমি গিয়েছি, সেখানেই দেখতে পেয়েছি মেয়েরা কাজ করছে; তাঁদের সংখ্যা স্থানে স্থানে শতকরা ৪০ জনের উপরে।
‘নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও মহিলা আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে। সমানভাবে সাড়া দিয়েছে জাতিগঠনমূলক কাজে। তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ. ৯৯।)
কর্মক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে যাতে নারী ও পুরুষের সমান সুযোগ সৃষ্টি হয় যে বিষয়ে লক্ষ রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে সংবিধান ১৯৭২ সালে জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন, সেখানে সম-অধিকারের কথা উল্লেখ রয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ (১)-এ বলা হয়েছে :‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’
সমাজের শুধু নারী বা পুরুষ নয়, সমাজের সকল নাগরিক যেমন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা অনগ্রসর শ্রেণি—সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করার বিধান এই সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ বঞ্চিত না হয়। অনগ্রসর যারা তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ (৩) (ক)-তে উল্লেখ আছে :‘নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন সেই উদ্দেশ্যে তাহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
৪৯ বছর পূর্বে সংবিধানে যে ক্ষমতা নারীদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছেন তা সে সময়ের সমাজব্যবস্থায় একটা সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। সমাজে নারীদের সম্মানজনক অবস্থানের ভিত্তি তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথেই নারী ক্ষমতায়নের পদক্ষেপ আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করে। সন্তানের পরিচয়ে পিতার সঙ্গে মায়ের নাম যুক্ত করা হয়। মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাস থেকে বৃদ্ধি করে প্রথমে চার মাস এবং পরে ছয় মাস করা হয়।
উচ্চ আদালতে কোনো নারী বিচারক নিয়োগ পেতেন না। প্রথম নারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি আমরাই দিই। জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি), থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার (ওসি)সহ প্রশাসনের সর্বস্তরে মহিলাদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ এয়ারলাইনস বিমানের পাইলট, মেরিন একাডেমিতে ভর্তির ব্যবস্থাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ২ কোটি ৫৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি বা উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা-সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড তৈরি করে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ বৃত্তি দেওয়ার যে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি, সেখানে ৭০ শতাংশই নারী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার বৃত্তি পাচ্ছে। মেয়েদের জন্য উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে।
সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা, বয়স্ক নারীদের ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। মাতৃত্বকালীন ভাতার প্রচলন করা হয়েছে। মাতৃদুগ্ধদানকারী মায়েরা ভাতা পাচ্ছেন। সংসারে মেয়েদের যাতে কেউ বোঝা না মনে করে, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। চিকিত্সা সেবা, বিনা মূল্যে ওষুধ, বিনা মূল্যে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
নারী সুরক্ষার জন্য অনেক আইন পাশ করা হয়েছে। নারী ও শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করার জন্য স্বল্পসুদে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সারা বাংলাদেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানেও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্লট বরাদ্দের বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গ্রামের মেয়েরা নিজেদের উত্পাদিত পণ্য যাতে বাজারজাত করতে পারেন তার জন্য ‘জয়িতা ফাউন্ডেশন’ গঠন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ফলে মেয়েদের শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। অভিভাবকরা মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে উত্সাহিত হচ্ছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ফলে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টারে নারী উদ্যোক্তারা স্ব-কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক, তথ্য আপা, আমার বাড়ি আমার খামার-সহ বিভিন্ন কর্মমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কৃষি, শিল্প, সেবাসহ সব ক্ষেত্রে মেয়েদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীদের অসামান্য অবদান বিস্মৃত হওয়ার নয়। দেশের মোট জনসংখ্যার যেখানে অর্ধেকই নারী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চাইতেন তারা সমাজ ও দেশ গঠনে ভূমিকা রাখবেন। যাতে দেশের উন্নয়ন দ্রুততর হয়; দারিদ্র্য বিমোচন করে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করা যায়। আওয়ামী সরকার তার প্রদর্শিত পথেই দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশকে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেছিলেন। আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। শিগিগরই বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বপ্ন পূরণ হবে।
লেখক : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।