রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে প্রখ্যাত সাংবাদিক, গবেষক ও কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।

এর আগে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মরদেহ কিছু সময় জাতীয় প্রেসক্লাব ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। দুপুরে তার কফিন স্কয়ার হাসপাতাল থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে নেয়া হয়। সেখানে নামাজে জানাজায় অনুষ্ঠিত হয়, পরে সাংবাদিকরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

এরপর আবুল মকসুদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সর্বস্তরের নাগরিকদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তার আরেক দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় আজিমপুর কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

জাতীয় প্রেসক্লাবে সৈয়দ আবুল মকসুদের জানাজায় উপস্থিত ছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন ও সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খানসহ সর্বস্তরের সাংবাদিকরা।

জানাজা শেষে তার শেষ কর্মস্থল বাসস’র ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে সংস্থার সাংবাদিকরা মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়, এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং পিআইডি’র পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

এরপর সৈয়দ আবুল মকসুদের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান কৃষিমন্ত্রী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান ও আওয়ামী লীগ নেতা অসীম কুমার উকিল এমপি।

পরে একে একে শ্রদ্ধা জানায় দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক সমকাল, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আদিবাসী ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে স্কয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদের পুত্রবধু মুনমুন ফারজানা মঙ্গলবার সন্ধায় জানান, তার শ্বশুর বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়ার পর দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রথম জীবনে সরকারের তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন, পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) বার্তা বিভাগে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন।

বামপন্থী আবুল মকসুদ ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতিবাদে সন্যাসীর মতো সাদা পোষাক পড়তে শুরু করেন। ২০০৪ সালে বাসস-এর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে একাধিক গবেষণা কাজ করেছেন এবং মহাত্মা গান্ধী এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কে তার বিস্তৃত গবেষণার জন্য খ্যাতিমান ছিলেন।

চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি। সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ঋষিজ পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার এলাচিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ আবুল মাহমুদ ও মা সালেহা বেগম। তার জন্মের দুই বছর পর ১৯৪৮ সালের ২০ নভেম্বর তার মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মায়ের মৃত্যুর পর তার বিমাতা বেগম রোকেয়া আখতার তাকে সন্তান স্নেহে লালন-পালন করেন। তিনিও ১৯৮০ সালে মারা যান। তার বাবা কাব্য-চর্চা করতেন। তাই শৈশব থেকেই তিনি দেশি বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকা পড়ার সুযোগ পান। তার বাবা বাড়িতে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা, দ্য স্টেটসম্যান ও ইত্তেহাদ এবং পরে ঢাকার দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা রাখতেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে নানা বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। পাশাপাশি কাব্যচর্চাও করেছেন। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা চল্লিশের ওপর। বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

আবুল মকসুদের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ-এ। তাদের দুই সন্তান। মেয়ে জিহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং মাস্টার্স করে ব্যাংকে চাকরি করছেন। ছেলে সৈয়দ নাসিফ মাকসুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স এবং মাস্টার্স করে দুই বছর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- কবিতা: বিকেলবেলা, দারা শিকোহ ও অন্যান্য কবিতা; প্রবন্ধ: যুদ্ধ ও মানুষের মূর্খতা, বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন, ঢাকায় বুদ্ধদেব বসু প্রভৃতি; জীবনী: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গোবিন্দচন্দ্র দাসের ঘর-গেরস্থালি; ভ্রমণকাহিনী : জার্মানির জার্নাল, পারস্যের পত্রাবলী।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে