বাঙালির অন্যতম প্রাচীন কৃষি সমাজের ঐতিহ্য ‘পান্তা ভাত’। এক সময় গ্রাম বাংলার সর্বস্তরে প্রতিদিনের খাবার তালিকায় স্থান ছিল পান্তার। বর্তমানে খাদ্যাভাসে খাবারটি কম রাখা হলেও পহেলা বৈশাখে বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে এই খাবার জায়গা পেয়েছে।
এখনও পান্তা ভাত খেয়েই দিন-রাত কাজ করেন সমাজের কর্মজীবী ও খেটে খাওয়া বহু মানুষ। প্রাচীনকাল থেকেই পান্তার গুণ নিয়ে মানুষের মাঝে ইতিবাচক ধারণা ছিল। তবে আসলেই সাধারণ মানুষের বড় অংশের প্রাত্যহিক এই খাবারটিতে কোনো গুণ আছে কিনা তা খুঁজেছেন যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক। নতুন গুণের সন্ধানও পেয়েছেন তারা।
পান্তা ভাত মূলত রান্না করা চালে পানি দিয়ে কিছুসময় রেখে তৈরি এক ধরনের খাবার। সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে ও ভারতে এই খাবার খাওয়া হয়। খাবারটির গবেষণার লক্ষ্য ছিল পুষ্টি এবং লড়াইয়ের জন্য একটি সাশ্রয়ী মূল্যের খাদ্য হিসাবে এর সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন করা।
গবেষণায় দেখা গেছে, পান্তা ভাতে অনেক উপকারী অণুজীব আছে। আবার এখানে নতুন কিছু অণুপুষ্টি উপাদানও পাওয়া গেছে। গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পান্তা খেলে রক্তে স্বাভাবিকের চেয়ে কম হারে বাড়ে শর্করার মাত্রা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী ফুড অ্যান্ড হিউম্যানিটি–তে পান্তাভাত নিয়ে নতুন এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে। যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুরস ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ফার্মাসি অ্যান্ড বায়োমলিকুলার সায়েন্সেসের অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন সরকারের নেতৃত্বে গবেষণা দলে যুক্ত ছিলেন যুক্তরাজ্যের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও আট শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
গবেষণায় যা পাওয়া গেছে
গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে সাদা বাসমতী চাল। রান্না করার পর এই চালে নিমজ্জিত না হওয়া পর্যন্ত পাত্রে পানি যোগ করা হয়েছিল। এরপর ঢাকনা দিয়ে ঢেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়।
রান্না করা চাল রাতারাতি ভিজিয়ে রাখলে শুরু হয় হালকা গাঁজন। পরবর্তীতে ব্যাসিলোটা ফাইলাম থেকে উপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোর ধারাবাহিক বৃদ্ধি পেতে থাকে।
নতুন এ গবেষণায় পান্তায় প্রোবায়োটিক-সমৃদ্ধ ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে পারে। সাধারণ ভাতের চেয়ে পান্তায় ১০ গুণ বা তারও বেশি উপকারী অণুজীব তৈরি হতেও দেখা গেছে।
এ গবেষণার অন্যতম বড় দিক হলো পান্তায় একাধিক অণুপুষ্টির সন্ধান। এর মধ্যে আছে লৌহ, জিংক, কপার, ক্যালসিয়াম, ম্যাংগানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, বোরন ও পটাশিয়াম, যা সাধারণ ভাতের তুলনায় অনেক বেশি ছিল।
যেখানে প্রতি আড়াই গ্রাম সাধারণ ভাতে শূন্য দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম লৌহ থাকে, সেখানে একই পরিমাণ পান্তায় পাওয়া যায় প্রায় ১ মাইক্রোগ্রাম। ক্যালসিয়ামের মাত্রা সাধারণ ভাতে শূন্য দশমিক ১০ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া গেলেও পান্তায় তা শূন্য দশমিক ৪০ মাইক্রোগ্রামের বেশি পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্যের টিস ভ্যালিতে বসবাসরত ১৩ জন বাংলাদেশি সদস্যের ওপর এই গবেষণা চালানো হয়। পরীক্ষাটি অংশগ্রহণকারীদের একটি বাড়িতে পরিচালিত হয়েছিল। বাড়ির মালিক নির্দেশনা অনুসারে খাবার তৈরি করেছিলেন এবং পরীক্ষাগুলি দুটি পৃথক দিনে পরিচালিত হয়েছিল।