Dhaka ০৬:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ২৫ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পদ্মাপারের রবি – লালন তীর্থে : ড. সুবীর মণ্ডল

  • Reporter Name
  • Update Time : ০৮:৫২:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মে ২০২১
  • ৩৪৬ Time View

ভ্রমণ কাহিনী  :

মাত্র কয়েক ঘণ্টার স্বপ্নমেদুর পথ। সীমান্ত রেখার অতিক্রম করলেই হাতের মুঠোয় ও ঘরের কাছেই বিদেশ। আট থেকে আশির স্বপ্নপূরণের এক আদর্শ ঠিকানা। সেখানে পরতে পরতে আছে শিকড়ের গন্ধ। বাংলার মাটির টান।এ-এক অন্যভুবন। নদ-নদীর বর্ণিল মনোমুগ্ধকর শোভা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরান সম্ভার। সেই দেশটা বাংলাদেশ। কোলকাতা থেকেই সড়ক কিংবা ট্রেনে মাত্র কয়েক ঘন্টার মায়াবী পথ। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করলেই চলে যাওয়া যাবে রূপসী বাংলার দেশ, বাংলাদেশে। সেখানে ভাষাও আমাদের প্রাণের, বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য তাজা ভাষাপ্রেমিক তরুন-তরুনী।’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’। খাওয়ারে রয়েছে ষোলোআনা বাঙালিয়ানা। আভিজাত্য আর ঐতিহ্য আজো পরম্পরায় বজায় রয়েছে। সঙ্গে বাড়তি পাওয়া যায় অতুলনীয় আতিথেয়তা। এখনো এপার বাংলার বহু মানুষেরই নাড়ির টান রয়েছে সে-দেশের সঙ্গে। এ-এক অমোঘ আকর্ষণ। অনেকেই সুযোগ পেলেই ছুটে যান  বাংলাদেশের পূর্ব-পুরুষের ভিটে দেখতে। কাটিয়ে আসেন পূর্ব-পুরুষদের শহরে। বেশ কয়েক বছর আগে আমরা কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ঘরের কাছে  রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত  কুষ্টিয়া হোক বড়দিন উদযাপনের স্হল। ২৪শে ডিসেম্বর এক শীতের সকালে বারাসাত থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে পৌঁছলাম হরিদাসপুর সীমান্তে। সরকারি ভাষায়  যেটাকে আমরা পেট্রোপোল বলে থাকি। বারাসাত থেকে বনগাঁ দূরত্ব মাত্র ৭০কিমি‌। ঘন্টা দুয়েক লাগলো। স্টেশন থেকে টোটোয় পৌঁছলাম সীমান্তে। বনগাঁর, বন্ধু বিধান বিশ্বাসের দায়িত্ব ছিল সীমান্তের প্রশাসনিক সমস্ত দায়িত্ব সামলানো।ও কলেজে পড়ায়। সীমান্ত এলাকায় বাড়ি।ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা কাগজ পত্র দেখিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের ছাড়পত্র পেয়ে যাই, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্হান করছি। কয়েক ফুট দূরে বাংলাদেশের বেনোপোল   চেকপোস্ট । ওপারে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পরিবহনের বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের গন্তব্যস্হল কুষ্টিয়া। কিন্তু যেতে হবে যশোর জেলার উপর দিয়েই। যশোরে বহুবার গিয়েছি।ফলে কোন অসুবিধা নেই। জাতীয় সড়ক  বহু পুরানো বনগাঁ-যশোররোড ধরেই চলেছে গাড়ি। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই রাস্তা।এক ঘন্টার মধ্যেই যশোর জেলা শহর ছুঁয়ে এবার কিছুটা বাঁক নিয়ে চলেছি কুষ্টিয়ার দিকে। পথের দুপাশে পেলাম অসাধারণ সবুজের সমারোহ। শীতের সকালে প্রকৃতি রঙের খেলায় মেতেছে। বনগাঁ  থেকে যশোর  ৪৮কিমি। গাড়ি চলছে, মনজুড়ে শুধুই কুষ্টিয়া। নানা ধরনের ভাবনায় আমি মশগুল। কুষ্টিয়ার এক বন্ধুর কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। কুষ্টিয়ার ভূগোল ও ইতিহাস এবং প্রশাসনিক বিন্যাস নিয়ে ভাবছি। কুষ্টিয়া বাংলাদেশের সংস্কৃতির রাজধানী। ফকির লালন সাঁই আর কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত জেলা। বঙ্গসংস্কৃতির একসময়ের পীঠস্থান। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে কুষ্টিয়া জেলার ভাষার মিষ্টতা সর্বাধিক। বহু দর্শনীয় স্থান আছে গোটা জেলা জুড়ে। এই সব ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম কুষ্টিয়া মজমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি জায়গায়। যশোর জেলা শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৯৭কিমি।সময় লাগলো প্রায় ৩ঘন্টা।আগে থেকে থাকার জন্য বিধান, কুষ্টিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্টহাউসে ব্যবস্হা করে রেখেছিলো। আমাদের নিজস্ব ব্যাগপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে নিলাম, তারপর  বেরিয়ে পড়লাম দর্শনীয় স্থান গুলো দেখতে। কুষ্টিয়া জেলা শহর সাজানো গোছানো সুন্দর শহর।পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। পুরসভার কাছ থেকেই বেবিট্যাক্সি নিয়ে রেনউইক বাঁধ যাওয়ার পথের দৃশ্য অতুলনীয়।ঘুরে ফিরে এলাম মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে-,এখান থেকে চললাম ঘোড়ারহাট নামে একটি জায়গায়। ঘোড়ার হাট গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ও হাট।ট্রলারে নদী পেরিয়ে এলাম অপর পাড়ে।জনপ্রতি ১০টাকা ভাড়া।গড়াই নদী আপনমনেই বয়ে চলেছে। নদী প্রকৃতির অনন্য রূপ  ও চারপাশের জনজীবন হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এবার গন্তব্যস্হল বহু আকাঙ্ক্ষিত শিলাইদহ- কুঠিবাড়ি। একটি ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে যাত্রা শুরু করলাম। জনপ্রতি ২৫টাকা ভাড়া।রূপসী বাংলার রুপ উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম। জনপ্রতি টিকিট ২৫টাকা, কয়েক ঘণ্টা ধরে পুরো এলাকা ঘুরলাম,দেহ-মন ভরে গেল। বাংলাদেশের সরকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশেষ যত্নবান।এই কুঠিবাড়ির আয়তন ছোট হলেও সুসংরক্ষিত। পরতে পরতে একটা যত্নের ছাপ পরিলক্ষিত হলো। দোতলা ওঠবার সিঁড়িটি আগের দিনের লোহার ঘোরানো সিঁড়ি।একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া পাওয়া গেল। কাঠের তৈরি সিড়িটি নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক জায়গার একটা বিষয় আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে, সেটা সংগ্রহশালা নির্মাণ করা ও তাকে সুন্দর করে সংরক্ষণ করা। আসলে বাংলাদেশে সংগ্রহশালা করার একটা চল রয়েছে। এই ছোট্ট কুঠিবাড়িটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কবিগুরুর ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিসপত্র দিয়ে ছোট প্রদর্শনশালাটি তৈরি হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো। পর্যটকদের মন্তব্য লেখার খাতা একটি  দেখলাম। এরপরে আমাদের গন্তব্যস্হল কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায় মীর মোশাররফ হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত বসতবাড়ি ও সংগ্রহশালা।  কুষ্টিয়া লালনময়,পথে পড়লো লালন-সেতু আর কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল-এর নামানুসারে মিলরোড। একেবারে মসৃন রাস্তা। কুষ্টিয়া সদর শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৩১কিমি, এই সেতুর আগে নাম ছিল হার্ডঞ্জব্রিজ। ব্রিটিশ আমলে কোলকাতার সঙ্গে কুষ্টিয়ার রেল যোগাযোগের একমাত্র রেলসেতু।আজ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।১৯০৯ সালে পদ্মানদীর উপর এই সেতুর কাজ শুরু হয়,শেষ হয়১৯১৫ সালে। তৎকালীন গভর্নর লর্ড হার্ডঞ্জ-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার নামকরণ করেন লালন সেতু। সেতুর দৈর্ঘ্য ১-৮কিমি,চওড়া ১৮মিটার।১৯৭১-এর যুদ্ধে  পাকবাহিনীর বোমার আঘাতে দু’টি স্পান নষ্ট হয়ে যায়।১৯৭৪সালে মেরামত করা হয়। পাবনা-কুষ্ঠিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগের ঠিকানা এই সেতু। সেতু অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম।পায়ে হেঁটে ঢুকলাম। অসাধারণ একটি গ্রাম। দুইধারে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত চোখ জুড়িয়ে গেল। কোথাও সোনালী খড়ের ছাওয়া গোলা, কোথাও বা বোরখার আড়ালে চকিত চাহনি যেন শিল্পীর আঁকা নিসর্গ ছবি। অনেকের কাছে জেনেছিলাম কুষ্টিয়ার জনপ্রিয়তার পিছনে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পদ্মার ঢেউয়ের কলতান, সবুজঢাকা বাংলার রূপ ও উত্তাল মনমাতাল করা হাওয়ার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য আমরা কুষ্টিয়ার প্রেমে মজে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের অতিথি হয়েও। মীর মোশাররফ হোসেন তাঁর  অমর সাহিত্য-সৃষ্টির জন্যে খ্যাত। এখানে মাতুলালয়ে ১৮৪৭ সালে তাঁর জন্ম, মৃত্যু ১৯১১ সালে।  তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম’ বিষাদ-সিন্ধু’১৮৮৫ থেকে  ১৮৯১-সালের  মধ্যে লেখা। এখানকার স্মৃতি সংগ্রহশালায় দেখলাম পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র,ব্যবহৃত জিনিসপত্র প্রভৃতি। একটি প্রকাশনা বিভাগ ও আছে। অসাধারণ এক পরিবেশে মুগ্ধ হলাম সবাই। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় হলো, তাদের আন্তরিকতা সত্যিই মনে রাখার মতো। এবারের গন্তব্য লানন শাহের আখড়া। ভ্যানে চললাম।   দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম রাস্তার পাশে একটা হোটেলে। কুলফি মালাই  খেলাম। এটি এখানকার জনপ্রিয় আইসক্রিম। মিনিট পনেরো লাগলো পৌঁছতে। লালন ফকিরের  সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সত্যিই কোনদিনও মুখোমুখি দেখাদেখি হয়েছিল কিনা তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও লালনের গান যে কবিকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই বলে আমার বিশ্বাস।”

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” গানদিয়ে শুরু হয়েছে’গোরা’উপন্যাস, বাঙালি পাঠকমহলে তা  অজানা নয়। লালন ফকিরের মাজার ঘিরে বিশালসৌধ, রয়েছে  লালন আকাদেমিও। ছোট্ট সংগ্রহশালা জুড়ে অসাধারণ সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা আছে। এগুলো দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য জীবনের বড় প্রাপ্তি।লালন ফকিরের ব্যবহৃত একতারাটা দেখলাম ‌,সঙ্গে অবনীদ্রনাথের আঁকা লালন ফকিরের ছবি।এটি ছাড়া আর কোনও প্রতিকৃতি দেখতে পাই নি। চত্বরে সুন্দর বাঁধানো মণ্ডপে দিনভর গান গেয়ে চলেছেন একদল বাউল-ফকিরেরা। একটু পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম ক্ষীনধারা এক নদীর কাছে।  জনশ্রুতি,এই নদীতেই ভেসে এসেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী লালন, তাঁকে তুলে এনে পরম মমতায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এক মুসলমান দম্পতি। এবার শিলাইদহের দিকে আমাদের যাত্রা। শিলাইদহ জায়গাটি অমর হয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনন্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম গাড়িতে,কখন পৌঁছব  সেই স্বপ্নের  কুঠিবাড়িতে। পথের শেষ হলো, পৌঁছলাম সেই পদ্মা-বোট আর ‘ছিন্নপত্রেরদেশে’ । পদ্মা আর গড়াই নদীর ত্রিকোণ কুলে শিলাইদহ। এখন অবশ্য  গড়াই নদী সরে গেছে অনেক দূরে। পদ্মা কোনো কালেই কুঠিবাড়ির গা দিয়ে বইত না। পালকি চড়ে জমিদারবাবু যেতেন পদ্মাতীরে। বজরা বা বোটে চেপে ভেসে বেড়াতেন ধু ধু জলরাশির মাঝখানে। সেখানে তাঁর একমাত্র সঙ্গী কেবল কবিতার খাতা।এক সময়ে এই কুঠিবাড়িতে বহু গুণীজনের আগমন ঘটেছিল–জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,প্রমথ চৌধুরী থেকে মোহিতলাল মজুমদার। মাঝে মধ্যে স্বজন-বন্ধুদের সমাগমে একটা  প্রমোদভ্রমণের মেজাজ আসতো। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি দর্শনার্থীদের জন্য সযত্নে সংরক্ষিত। লালবাড়িটির উপরদিকটাএকটু প্যাগোডা ধাঁচের।রঙ-বেরঙের ফুলের বাগান। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। টিকিটের কোন ব্যাপার নেই। এখানকার মিউজিয়াম অসাধারণ।দুতলা জুড়ে মিউজিয়াম। কবির সেই সময়ের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, বাসনকোসন সযত্নে সাজানো গোছানো আছে। অজস্র ফটোগ্রাফে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শশালাটি। ভারতের রাষ্ট্রপতির দেওয়া কয়েকটি অদেখা ছবিও দেখার সুযোগ হলো। কবি জমিদারির পাশে পাশে কতই না মহান সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন —– ভেবেই রোমাঞ্চিত হলাম ! মাটির গন্ধ বুকে নিয়ে আত্মস্হ হয়ে আকাশ ছুঁয়েছিলেন। শীতকালে পদ্মার চরে দল বেঁধে পয়সায় একটি ইলিশমাছ কিনে  হইচই বাঁধিয়ে দিতেন কবি। জগদীশ চন্দ্র শিলাইদহ গেলে একবারে শিশুটি হয়ে যেতেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে পদ্মার চরে কচ্ছপের ডিম খোঁজার চেষ্টা করতেন। শিলাইদহের আদিনাম খোরশেদপুর। এক সময়ে সেখানে ছিল নীলকুঠির। শেলিনামে এক সাহেব থাকতেন সেখানে।পদ্মা আর গড়াইয়ের সঙ্গমে যে দহ  সৃষ্টি হয়েছিল,নীলকর সাহেবের  নামের সঙ্গে জুড়ে তা দাঁড়ালো শেলিদহ বা শিলাইদহ। ঠাকুর পরিবার গ্রামটি কিনে নেওয়ার পরও সেই কুঠিবাড়ি ছিল।পরে পদ্মার গর্ভে তলিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় নতুন কুঠিবাড়ি তৈরি করা হয় ‌। প্রায় ১৩ বিঘা  জমির ওপর আম-কাঁঠাল-ঝাউ-ফুল-সবজির খেতসমেত তিনতলা বাড়ি। সার্ধশতবর্ষে বাংলাদেশ সরকার বাড়িটিকে ঝকঝকে সাদা রঙে সাজিয়েছেন সুন্দর করে। পুকুরঘাটে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বকুলতলা আজো আছে। এখানে বসেই কোন এক বিষন্ন গোধূলিতে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান–“তখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”।এই পুকুরপাড়ে সারাদিন রবীন্দ্রনাথের গানের অর্ঘ্য সাজিয়ে অখ্যাত গ্রাম্য গায়কেরা গান পরিবেশন করে চলেছেন। পরিশীলিত রাবীন্দ্রিক গায়কি হয়তো পাওয়া যাবে না এঁদের গানে, কিন্তু আন্তরিক নিবেদনের ভঙ্গিটুকু হৃদয় ছুঁয়ে যাবেই নিশ্চিত।ঢাকার কারিগর দিয়ে তৈরি ‘পদ্মা’ বোটটি আর নেই,তবে দোতলার বারান্দায় রাখা রয়েছে,’চপলা’ বোটটি আর বজরায় ওঠা কাঠের সিঁড়িটি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে লুটপাট হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের স্মতিধন্য বহু জিনিসপত্র। শুধু পদ্মা নয়, পাবনা-রাজশাহি অঞ্চলের চলনবিলে নৌকা ভাসানোর নেশা রবীন্দ্রনাথকে করে তুলেছিল অন্যরকম মানুষ। এককুঠি বাড়ি থেকে অন্য কাছারিবাড়িতে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল জলপথ।আর জলপথে চলতে চলতে ভরিয়ে তুলতেন কবিতার খাতা।এ-অনন্য ভুবন। আশ্বিনের ঝড়ে যখন বজরা টলোমলো, মাঝিরা ঈশ্বরের নাম জপছে,আশ্চর্যরকম প্রশান্ত রবীন্দ্রনাথ তখন লিখছেন–‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ শান্ত সুদূর, আমার সাধের সাধনা’ কিংবা’আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা’র মতো পুরোপুরি প্রেমের কবিতা। শুনেছিলাম,’ছিন্নপত্রের দেশে’তথ্যচিত্রটি করার সময় পরিচালক এখানে এসে খুঁজে খুঁজে ঠাকুর পরিবারের প্রজাদের বংশধরদের বের করে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এখানেই মৃণালিনী দেবী সন্তান–সন্ততি নিয়ে বেশ কিছু দিন গুছিয়ে সংসার করেছিলেন। সারাদিনের পর কুষ্টিয়া শহরে ফিরে আসলাম। কুষ্টিয়া শহরে টেগোর লজ দেখলাম।পুরসভার যত্নে চমৎকার সাজানো গোছানো সুন্দর। পিছনের বারান্দা মনে করিয়ে দেয় জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দারকথা।আর একতলায় গেটের কাছে পাতকুয়োটি এখন মজে গেলেও এক সময় নাকি এর জলেই পরম শান্তিতে স্নান সারতেন পথক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ। এছাড়াও একেএকে দেখলাম ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক মঞ্চ পরিমল থিয়েটার, যেখানে অভিনয় করেছেন শিশির ভাদুড়ী থেকে আঙুর বালা-ইন্দুবালা দেবী। একটু রাতে গেলাম লালন ফকিরের মাজারে তথা সমাধিস্থলে। এক অনন্য সাধারণ পরিবেশ। পথ এক সময় ফুরোয়, চোখের সামনে দেখলাম আলোর মালায় সুসজ্জিত লালন ফকিরের সমাধি। জাত-পাতহীন লালন শাহের সহজ,সরল জীবন দর্শনের স্পর্শে আমাদের প্রত্যেকের মনে যেন ভাবুকতা এসে গেলো। মঞ্চবেঁধে লালন ভক্তরা সারারাত ধরে উদাত্ত কণ্ঠে লালনগীতিতে ওখানকার আকাশ-বাতাস ভরে উঠতে থাকলো। মঞ্চের উপর  ব্যানারের একপাশে একটি ছবি দেখলাম সেটি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা। এ যেন যথার্থই ‘গানের ভিতর দিয়েই’ ভুবন দেখা। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। রাতের পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো। এবার ফেরার পালা । প্রথম দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে গেস্টহাউসে পৌঁছলাম, রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং ব্যালকনি থেকে রাতের অপরূপ কুষ্টিয়া  শহর দেখলাম দু’চোখ ভরে।রাত বাড়ছে ক্রমশ। আগামীকাল অন্য ভাবে অন্য দিকে  বেরিয়ে পড়বো,এইসব ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিনে খুব সকালে  মাইক্রো বাসে চেপে বসলাম সকলে। গন্তব্যস্হল  সিরাজগঞ্জের  সাজাদপুর। দূরত্ব ৬০-৬৫কিমি কুষ্টিয়া সদর শহর থেকে। সিরাজগঞ্জকে রবীন্দ্রনাথ কবিতায় অমর করে গিয়েছেন।’ সিরাজগঞ্জে বিরাট মিটিং তুলো বের করা বালিশ/ বংশ ফকির ভাঙা চৌকির পায়াতে লাগায় পালিশ।’ অন্যান্য কুঠিবাড়ি গুলির মতো শাহাজাদপুর কুঠিটিও ভালোভাবে সংরক্ষিত।একটি নান্দনিক সৌন্দর্যের আধুনিক বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহশালা অবস্হিত। ওখানে একটি অত্যাধুনিক সভাকক্ষও আছে। আমরা টিকিট কাটলাম। এখানে দেখলাম বিচিত্র ধরনের পালকি ,কোনটি ষোলো বেহারার,কোনটি আট বেহারার আবার চার বেহারার। রবীন্দ্রনাথের মতো বোটে চেপে কাচারিবাড়ির সামনে নামার উপায় নেই । করতোয়া নদী যে এখন পিচরাস্তা।নদী বুজে গেছে। করতোয়া এখন মরানদী। সেই রূপ আর নেই। তবে মরা একটি খাত দেখলাম কাছারিবাড়ির বাগানের পাশে। পাবনা জেলার সাহাজাদপুর বিখ্যাত দুধ-ঘিয়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথের সময়েও বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল আজকের এই ছোট্ট শহরটি।’ছিন্নপত্রে’উল্লেখ রয়েছে এই জায়গার। অজস্র ছোট-বড় দুধ আর মিষ্টির দোকান , সারিসারি তাঁতের শাড়ির দোকান দেখলাম।কাছারিবাড়ির দোতলা থেকে এই গুলো সুন্দর দেখা যায়। দোতলা ঘরে জানালার ধারটিতে দাঁড়ালে রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগবেই।এর সামনে রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল।এই টেবিলে বসে লেখেন ছোটগল্প-‘পোস্টমাস্টার’। রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরে আম জনতার কাছাকাছি এসেছিলেন। বাংলাদেশের দুপুরের অতিলৌকিক সৌন্দর্য সাজাদপুরেই উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই এখানকার মধ্যাহ্নকে তিনি বলেছেন’গল্পের দুপুর বেলা’ ,যা তাঁর মনে আরব্য উপন্যাসের মায়া বিস্তার করতো। সাজাদপুরে লেখা হয় ‘ ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মতো গল্প।দোতলার বৈঠক খানার শোভা গোল শ্বেতপাথরের টেবিলটি ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। এখানে বসেই তিনি অনূদিত করেছিলেন’গীতাঞ্জলি’র বেশিভাগ গান। এক সময়ে প্রিয় কাছারি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়‌ তাঁকে। সেই বেদনা থেকে প্রকাশিত হলো—‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।’নারী নয়,এই ব্যাকুলতা ছিল বাড়িটির জন্য। বেশ দুপুর হলো, তখন বেলা বারোটা। দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম এবং বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।মূল লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে যাওয়া। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ও সাজাদপুর থেকে রবীন্দ্রনাথ আসতেন সেই সময়ে জলপথে ।এটা ছিল আমাদের প্রত্যেকের অধরা স্বপ্ন। বর্তমানে জলেপথে যাওয়ার সুযোগ নেই।কারণ সাজাদপুরের করতোয়া নদীর মতো পতিসরের নাগর নদী একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায় নি।পড়ে আছে মজে যাওয়া খাত।এই নাগর নদীকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন—-‘আমাদের ছোট  নদী চলে আঁকেবাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’ বগুড়া থেকে বাসে যাওয়া সহজ এইখানে। পুরোটা বাস চলেনা।১৩কিমি আমরা পঞ্চপান্ডব চলেছি ভ্যানরিক্সায়।এ-এক অন্য জীবনে পদচারণা। বাংলাদেশের গ্রামে এই ধরনের  যানের বহুল ব্যবহার  চোখে পড়লো, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে এর প্রচলন রয়েছে। সেই  সময় রবীন্দ্রনাথ এতকষ্ট করতেন না। নাগর নদীর ঘাট থেকে কাছারিবাড়ি পর্যন্ত পাতা থাকতো লাল কার্পেট।সে সব আজ অতীতের কথকতা। ভিতরের  বিভিন্ন অংশ ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। সাদামাটা গ্রামের বাড়ির মতোই এখানকার কাছারির অন্দরমহল’। উঠোনে অবস্হিত রবীন্দ্রনাথের মূর্তিখানা খুব নান্দনিক সৌন্দর্যের নয়। জমিদারির হাঁকডাকের জায়গা নয় পতিসর। শিলাইদহ-সাজাদপুরের সম্ভ্রম জাগানো কোন আভিজাত্যের ছোঁয়া পাওয়া গেল না। একদমই সাদামাটা ভাবেই জীবন কাটাতেন কবি এখানে। রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতের  লেখা জমিদারির হিসাবের খাতা দেখার সুযোগ হলো। এখানকার চলনবিল ধরে পতিসর আসার সময় বেশ কিছু গান লিখেছিলেন।’যদি বারণ কর  গাইব না।’ আমাদের পরিকল্পনা ছিল রাত্রে এই জায়গাটাতে থেকে ফেরারপথে সকালে পাবনায় সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বসতবাড়ি দর্শন করে ফিরে যাব নিজেদের শহরে। সন্ধ্যায় চলে  আসলাম নাগর নদীর তীরে। জীর্ণদশা দেখে মন খারাপ হলো। এই নদীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী কবিতার গভীর সম্পর্ক অন্বষণের একটা চেষ্টা করলাম। বেশ কিছু সময় কাটানোর জন্য একটু তীর বরাবরই হাঁটলাম। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হলাম। মানুষের সহযোগিতা ভুলবো না। রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং একটু  ঘোরাঘুরি করলাম, গ্রামীণ মানুষের আন্তরিকতায় হৃদয় ছুঁয়ে গেল।রাত বাড়ছে ক্রমশ, ফিরে এলাম একটি সাধারণ হোটেলে। পরের দিন সকালে গেলাম রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্টিত প্রাইমারি স্কুলে। রবীন্দ্র সান্নিধ্যের মায়া ত্যাগ করে চললাম মেঠোপথে। পৌঁছেগেলাম কালীগ্রাম রবীন্দ্রনাথ ইনষ্টিটিউটশন স্কুলে। কবির নিজের হাতের তৈরি করা স্কুল আজও চলছে রমরমিয়ে।আসলে পতিসরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য মেজাজের মানুষ,সমাজ সেবায় ছিল অসীম মমত্ববোধ ও আগ্রহ।প্রিয়  প্রজাদের জন্য এখানে তৈরি করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক। নোবেল পুরস্কারের  টাকার একটা বড় অংশ ব্যয় করেছিলেন পতিসরের  উন্নয়নে। কৃষি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নীরিক্ষার সূচনাও এই পতিসরেই। শুনলাম  বা়ংলাদেশ সরকার এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করবে। সেই পরম্পরা শান্তিনিকেতনে বজায় রেখেছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে  বাজপড়া এক তালগাছ।শোনা যায় ,একে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—‘ তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,সব গাছ ছাড়িয়ে’। তালগাছের মতোই আকাশ-ছোঁয়া তাঁর মাথার নাগাল পায়  না আজো আম-বাঙালি। আমাদের মাথা নত  হলো তাঁর চরণধূলার তলে ।সকালের রবীন্দ্রনাথের  স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফেরার পথে পাড়ি জমালাম,পথে পড়লো পাবনা জেলা।পথে এক জায়গায় গাড়ি হঠাৎ করেই থামলো, বেবিট্যাক্সির তরুণ ড্রাইভার  রাসেল আহমেদ আঙুল দিয়ে দেখালেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের বাবার বসতবাড়ি।আজ সবই অতীতের কথকতা, শুধুমাত্র স্মৃতি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’গানটি শুনতে শুনতে যশোর জেলা ছুঁয়ে  প্রত্যাবর্তন সীমান্তের দিকে। নানান ধরনের স্মৃতি বুকে নিয়ে রাতের বনগাঁ লোকাল ধরে পৌঁছলাম  বিরাটিতে। পথনির্দেশ: শিয়ালদহ থেকে দূরত্ব বনগাঁ মাত্র৭৫কিমি, তারপর যশোর ছুঁয়ে কুষ্টিয়া , দূরত্ব মাত্র ১৫০কিমি। ভালো থাকার জন্য আছে লজ, গেস্টহাউস ও হোটেল। পরিচয়পত্র,ভিসাসহ পাসপোর্ট  সঙ্গে রাখতে হবে।সমস্যা হলে স্হানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা পাবেন সব সময়।
লেখক –  ডঃ সুবীর মণ্ডল, লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।
Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Raj Kalam

Popular Post

পদ্মাপারের রবি – লালন তীর্থে : ড. সুবীর মণ্ডল

Update Time : ০৮:৫২:১৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ মে ২০২১

ভ্রমণ কাহিনী  :

মাত্র কয়েক ঘণ্টার স্বপ্নমেদুর পথ। সীমান্ত রেখার অতিক্রম করলেই হাতের মুঠোয় ও ঘরের কাছেই বিদেশ। আট থেকে আশির স্বপ্নপূরণের এক আদর্শ ঠিকানা। সেখানে পরতে পরতে আছে শিকড়ের গন্ধ। বাংলার মাটির টান।এ-এক অন্যভুবন। নদ-নদীর বর্ণিল মনোমুগ্ধকর শোভা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অফুরান সম্ভার। সেই দেশটা বাংলাদেশ। কোলকাতা থেকেই সড়ক কিংবা ট্রেনে মাত্র কয়েক ঘন্টার মায়াবী পথ। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করলেই চলে যাওয়া যাবে রূপসী বাংলার দেশ, বাংলাদেশে। সেখানে ভাষাও আমাদের প্রাণের, বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য তাজা ভাষাপ্রেমিক তরুন-তরুনী।’আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’। খাওয়ারে রয়েছে ষোলোআনা বাঙালিয়ানা। আভিজাত্য আর ঐতিহ্য আজো পরম্পরায় বজায় রয়েছে। সঙ্গে বাড়তি পাওয়া যায় অতুলনীয় আতিথেয়তা। এখনো এপার বাংলার বহু মানুষেরই নাড়ির টান রয়েছে সে-দেশের সঙ্গে। এ-এক অমোঘ আকর্ষণ। অনেকেই সুযোগ পেলেই ছুটে যান  বাংলাদেশের পূর্ব-পুরুষের ভিটে দেখতে। কাটিয়ে আসেন পূর্ব-পুরুষদের শহরে। বেশ কয়েক বছর আগে আমরা কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম ঘরের কাছে  রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত  কুষ্টিয়া হোক বড়দিন উদযাপনের স্হল। ২৪শে ডিসেম্বর এক শীতের সকালে বারাসাত থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে পৌঁছলাম হরিদাসপুর সীমান্তে। সরকারি ভাষায়  যেটাকে আমরা পেট্রোপোল বলে থাকি। বারাসাত থেকে বনগাঁ দূরত্ব মাত্র ৭০কিমি‌। ঘন্টা দুয়েক লাগলো। স্টেশন থেকে টোটোয় পৌঁছলাম সীমান্তে। বনগাঁর, বন্ধু বিধান বিশ্বাসের দায়িত্ব ছিল সীমান্তের প্রশাসনিক সমস্ত দায়িত্ব সামলানো।ও কলেজে পড়ায়। সীমান্ত এলাকায় বাড়ি।ফলে খুব কম সময়ের মধ্যে আমরা কাগজ পত্র দেখিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের ছাড়পত্র পেয়ে যাই, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্হান করছি। কয়েক ফুট দূরে বাংলাদেশের বেনোপোল   চেকপোস্ট । ওপারে গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পরিবহনের বাসে উঠে পড়লাম। আমাদের গন্তব্যস্হল কুষ্টিয়া। কিন্তু যেতে হবে যশোর জেলার উপর দিয়েই। যশোরে বহুবার গিয়েছি।ফলে কোন অসুবিধা নেই। জাতীয় সড়ক  বহু পুরানো বনগাঁ-যশোররোড ধরেই চলেছে গাড়ি। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই রাস্তা।এক ঘন্টার মধ্যেই যশোর জেলা শহর ছুঁয়ে এবার কিছুটা বাঁক নিয়ে চলেছি কুষ্টিয়ার দিকে। পথের দুপাশে পেলাম অসাধারণ সবুজের সমারোহ। শীতের সকালে প্রকৃতি রঙের খেলায় মেতেছে। বনগাঁ  থেকে যশোর  ৪৮কিমি। গাড়ি চলছে, মনজুড়ে শুধুই কুষ্টিয়া। নানা ধরনের ভাবনায় আমি মশগুল। কুষ্টিয়ার এক বন্ধুর কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। কুষ্টিয়ার ভূগোল ও ইতিহাস এবং প্রশাসনিক বিন্যাস নিয়ে ভাবছি। কুষ্টিয়া বাংলাদেশের সংস্কৃতির রাজধানী। ফকির লালন সাঁই আর কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত জেলা। বঙ্গসংস্কৃতির একসময়ের পীঠস্থান। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে কুষ্টিয়া জেলার ভাষার মিষ্টতা সর্বাধিক। বহু দর্শনীয় স্থান আছে গোটা জেলা জুড়ে। এই সব ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গেলাম কুষ্টিয়া মজমপুর বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন একটি জায়গায়। যশোর জেলা শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৯৭কিমি।সময় লাগলো প্রায় ৩ঘন্টা।আগে থেকে থাকার জন্য বিধান, কুষ্টিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্টহাউসে ব্যবস্হা করে রেখেছিলো। আমাদের নিজস্ব ব্যাগপত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে টিফিন করে নিলাম, তারপর  বেরিয়ে পড়লাম দর্শনীয় স্থান গুলো দেখতে। কুষ্টিয়া জেলা শহর সাজানো গোছানো সুন্দর শহর।পরতে পরতে বনেদিয়ানার ছাপ পরিলক্ষিত হলো। পুরসভার কাছ থেকেই বেবিট্যাক্সি নিয়ে রেনউইক বাঁধ যাওয়ার পথের দৃশ্য অতুলনীয়।ঘুরে ফিরে এলাম মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে-,এখান থেকে চললাম ঘোড়ারহাট নামে একটি জায়গায়। ঘোড়ার হাট গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ও হাট।ট্রলারে নদী পেরিয়ে এলাম অপর পাড়ে।জনপ্রতি ১০টাকা ভাড়া।গড়াই নদী আপনমনেই বয়ে চলেছে। নদী প্রকৃতির অনন্য রূপ  ও চারপাশের জনজীবন হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এবার গন্তব্যস্হল বহু আকাঙ্ক্ষিত শিলাইদহ- কুঠিবাড়ি। একটি ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে যাত্রা শুরু করলাম। জনপ্রতি ২৫টাকা ভাড়া।রূপসী বাংলার রুপ উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম। জনপ্রতি টিকিট ২৫টাকা, কয়েক ঘণ্টা ধরে পুরো এলাকা ঘুরলাম,দেহ-মন ভরে গেল। বাংলাদেশের সরকার ঐতিহ্য সংরক্ষণে বিশেষ যত্নবান।এই কুঠিবাড়ির আয়তন ছোট হলেও সুসংরক্ষিত। পরতে পরতে একটা যত্নের ছাপ পরিলক্ষিত হলো। দোতলা ওঠবার সিঁড়িটি আগের দিনের লোহার ঘোরানো সিঁড়ি।একটা আভিজাত্যের ছোঁয়া পাওয়া গেল। কাঠের তৈরি সিড়িটি নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক জায়গার একটা বিষয় আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে, সেটা সংগ্রহশালা নির্মাণ করা ও তাকে সুন্দর করে সংরক্ষণ করা। আসলে বাংলাদেশে সংগ্রহশালা করার একটা চল রয়েছে। এই ছোট্ট কুঠিবাড়িটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কবিগুরুর ব্যবহৃত বেশ কিছু জিনিসপত্র দিয়ে ছোট প্রদর্শনশালাটি তৈরি হয়েছে। বেশ ভালো লাগলো। পর্যটকদের মন্তব্য লেখার খাতা একটি  দেখলাম। এরপরে আমাদের গন্তব্যস্হল কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ায় মীর মোশাররফ হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত বসতবাড়ি ও সংগ্রহশালা।  কুষ্টিয়া লালনময়,পথে পড়লো লালন-সেতু আর কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল-এর নামানুসারে মিলরোড। একেবারে মসৃন রাস্তা। কুষ্টিয়া সদর শহর থেকে দূরত্ব মাত্র ৩১কিমি, এই সেতুর আগে নাম ছিল হার্ডঞ্জব্রিজ। ব্রিটিশ আমলে কোলকাতার সঙ্গে কুষ্টিয়ার রেল যোগাযোগের একমাত্র রেলসেতু।আজ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।১৯০৯ সালে পদ্মানদীর উপর এই সেতুর কাজ শুরু হয়,শেষ হয়১৯১৫ সালে। তৎকালীন গভর্নর লর্ড হার্ডঞ্জ-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ সরকার নামকরণ করেন লালন সেতু। সেতুর দৈর্ঘ্য ১-৮কিমি,চওড়া ১৮মিটার।১৯৭১-এর যুদ্ধে  পাকবাহিনীর বোমার আঘাতে দু’টি স্পান নষ্ট হয়ে যায়।১৯৭৪সালে মেরামত করা হয়। পাবনা-কুষ্ঠিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগের ঠিকানা এই সেতু। সেতু অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম।পায়ে হেঁটে ঢুকলাম। অসাধারণ একটি গ্রাম। দুইধারে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেত চোখ জুড়িয়ে গেল। কোথাও সোনালী খড়ের ছাওয়া গোলা, কোথাও বা বোরখার আড়ালে চকিত চাহনি যেন শিল্পীর আঁকা নিসর্গ ছবি। অনেকের কাছে জেনেছিলাম কুষ্টিয়ার জনপ্রিয়তার পিছনে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পদ্মার ঢেউয়ের কলতান, সবুজঢাকা বাংলার রূপ ও উত্তাল মনমাতাল করা হাওয়ার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য আমরা কুষ্টিয়ার প্রেমে মজে গিয়েছিলাম ক্ষণিকের অতিথি হয়েও। মীর মোশাররফ হোসেন তাঁর  অমর সাহিত্য-সৃষ্টির জন্যে খ্যাত। এখানে মাতুলালয়ে ১৮৪৭ সালে তাঁর জন্ম, মৃত্যু ১৯১১ সালে।  তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম’ বিষাদ-সিন্ধু’১৮৮৫ থেকে  ১৮৯১-সালের  মধ্যে লেখা। এখানকার স্মৃতি সংগ্রহশালায় দেখলাম পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র,ব্যবহৃত জিনিসপত্র প্রভৃতি। একটি প্রকাশনা বিভাগ ও আছে। অসাধারণ এক পরিবেশে মুগ্ধ হলাম সবাই। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় হলো, তাদের আন্তরিকতা সত্যিই মনে রাখার মতো। এবারের গন্তব্য লানন শাহের আখড়া। ভ্যানে চললাম।   দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম রাস্তার পাশে একটা হোটেলে। কুলফি মালাই  খেলাম। এটি এখানকার জনপ্রিয় আইসক্রিম। মিনিট পনেরো লাগলো পৌঁছতে। লালন ফকিরের  সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সত্যিই কোনদিনও মুখোমুখি দেখাদেখি হয়েছিল কিনা তা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও লালনের গান যে কবিকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিয়েছিল সে ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই বলে আমার বিশ্বাস।”

“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়” গানদিয়ে শুরু হয়েছে’গোরা’উপন্যাস, বাঙালি পাঠকমহলে তা  অজানা নয়। লালন ফকিরের মাজার ঘিরে বিশালসৌধ, রয়েছে  লালন আকাদেমিও। ছোট্ট সংগ্রহশালা জুড়ে অসাধারণ সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা আছে। এগুলো দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য জীবনের বড় প্রাপ্তি।লালন ফকিরের ব্যবহৃত একতারাটা দেখলাম ‌,সঙ্গে অবনীদ্রনাথের আঁকা লালন ফকিরের ছবি।এটি ছাড়া আর কোনও প্রতিকৃতি দেখতে পাই নি। চত্বরে সুন্দর বাঁধানো মণ্ডপে দিনভর গান গেয়ে চলেছেন একদল বাউল-ফকিরেরা। একটু পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম ক্ষীনধারা এক নদীর কাছে।  জনশ্রুতি,এই নদীতেই ভেসে এসেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী লালন, তাঁকে তুলে এনে পরম মমতায় আশ্রয় দিয়েছিলেন এক মুসলমান দম্পতি। এবার শিলাইদহের দিকে আমাদের যাত্রা। শিলাইদহ জায়গাটি অমর হয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের অনন্য সাহিত্য সৃষ্টির জন্য। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম গাড়িতে,কখন পৌঁছব  সেই স্বপ্নের  কুঠিবাড়িতে। পথের শেষ হলো, পৌঁছলাম সেই পদ্মা-বোট আর ‘ছিন্নপত্রেরদেশে’ । পদ্মা আর গড়াই নদীর ত্রিকোণ কুলে শিলাইদহ। এখন অবশ্য  গড়াই নদী সরে গেছে অনেক দূরে। পদ্মা কোনো কালেই কুঠিবাড়ির গা দিয়ে বইত না। পালকি চড়ে জমিদারবাবু যেতেন পদ্মাতীরে। বজরা বা বোটে চেপে ভেসে বেড়াতেন ধু ধু জলরাশির মাঝখানে। সেখানে তাঁর একমাত্র সঙ্গী কেবল কবিতার খাতা।এক সময়ে এই কুঠিবাড়িতে বহু গুণীজনের আগমন ঘটেছিল–জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়,প্রমথ চৌধুরী থেকে মোহিতলাল মজুমদার। মাঝে মধ্যে স্বজন-বন্ধুদের সমাগমে একটা  প্রমোদভ্রমণের মেজাজ আসতো। শিলাইদহের কুঠিবাড়ি দর্শনার্থীদের জন্য সযত্নে সংরক্ষিত। লালবাড়িটির উপরদিকটাএকটু প্যাগোডা ধাঁচের।রঙ-বেরঙের ফুলের বাগান। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। টিকিটের কোন ব্যাপার নেই। এখানকার মিউজিয়াম অসাধারণ।দুতলা জুড়ে মিউজিয়াম। কবির সেই সময়ের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, বাসনকোসন সযত্নে সাজানো গোছানো আছে। অজস্র ফটোগ্রাফে সমৃদ্ধ এই প্রদর্শশালাটি। ভারতের রাষ্ট্রপতির দেওয়া কয়েকটি অদেখা ছবিও দেখার সুযোগ হলো। কবি জমিদারির পাশে পাশে কতই না মহান সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন —– ভেবেই রোমাঞ্চিত হলাম ! মাটির গন্ধ বুকে নিয়ে আত্মস্হ হয়ে আকাশ ছুঁয়েছিলেন। শীতকালে পদ্মার চরে দল বেঁধে পয়সায় একটি ইলিশমাছ কিনে  হইচই বাঁধিয়ে দিতেন কবি। জগদীশ চন্দ্র শিলাইদহ গেলে একবারে শিশুটি হয়ে যেতেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে পদ্মার চরে কচ্ছপের ডিম খোঁজার চেষ্টা করতেন। শিলাইদহের আদিনাম খোরশেদপুর। এক সময়ে সেখানে ছিল নীলকুঠির। শেলিনামে এক সাহেব থাকতেন সেখানে।পদ্মা আর গড়াইয়ের সঙ্গমে যে দহ  সৃষ্টি হয়েছিল,নীলকর সাহেবের  নামের সঙ্গে জুড়ে তা দাঁড়ালো শেলিদহ বা শিলাইদহ। ঠাকুর পরিবার গ্রামটি কিনে নেওয়ার পরও সেই কুঠিবাড়ি ছিল।পরে পদ্মার গর্ভে তলিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় নতুন কুঠিবাড়ি তৈরি করা হয় ‌। প্রায় ১৩ বিঘা  জমির ওপর আম-কাঁঠাল-ঝাউ-ফুল-সবজির খেতসমেত তিনতলা বাড়ি। সার্ধশতবর্ষে বাংলাদেশ সরকার বাড়িটিকে ঝকঝকে সাদা রঙে সাজিয়েছেন সুন্দর করে। পুকুরঘাটে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বকুলতলা আজো আছে। এখানে বসেই কোন এক বিষন্ন গোধূলিতে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান–“তখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”।এই পুকুরপাড়ে সারাদিন রবীন্দ্রনাথের গানের অর্ঘ্য সাজিয়ে অখ্যাত গ্রাম্য গায়কেরা গান পরিবেশন করে চলেছেন। পরিশীলিত রাবীন্দ্রিক গায়কি হয়তো পাওয়া যাবে না এঁদের গানে, কিন্তু আন্তরিক নিবেদনের ভঙ্গিটুকু হৃদয় ছুঁয়ে যাবেই নিশ্চিত।ঢাকার কারিগর দিয়ে তৈরি ‘পদ্মা’ বোটটি আর নেই,তবে দোতলার বারান্দায় রাখা রয়েছে,’চপলা’ বোটটি আর বজরায় ওঠা কাঠের সিঁড়িটি। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে লুটপাট হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের স্মতিধন্য বহু জিনিসপত্র। শুধু পদ্মা নয়, পাবনা-রাজশাহি অঞ্চলের চলনবিলে নৌকা ভাসানোর নেশা রবীন্দ্রনাথকে করে তুলেছিল অন্যরকম মানুষ। এককুঠি বাড়ি থেকে অন্য কাছারিবাড়িতে যাতায়াতের মাধ্যম ছিল জলপথ।আর জলপথে চলতে চলতে ভরিয়ে তুলতেন কবিতার খাতা।এ-অনন্য ভুবন। আশ্বিনের ঝড়ে যখন বজরা টলোমলো, মাঝিরা ঈশ্বরের নাম জপছে,আশ্চর্যরকম প্রশান্ত রবীন্দ্রনাথ তখন লিখছেন–‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ শান্ত সুদূর, আমার সাধের সাধনা’ কিংবা’আমি চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা’র মতো পুরোপুরি প্রেমের কবিতা। শুনেছিলাম,’ছিন্নপত্রের দেশে’তথ্যচিত্রটি করার সময় পরিচালক এখানে এসে খুঁজে খুঁজে ঠাকুর পরিবারের প্রজাদের বংশধরদের বের করে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এখানেই মৃণালিনী দেবী সন্তান–সন্ততি নিয়ে বেশ কিছু দিন গুছিয়ে সংসার করেছিলেন। সারাদিনের পর কুষ্টিয়া শহরে ফিরে আসলাম। কুষ্টিয়া শহরে টেগোর লজ দেখলাম।পুরসভার যত্নে চমৎকার সাজানো গোছানো সুন্দর। পিছনের বারান্দা মনে করিয়ে দেয় জোড়াসাঁকোর দক্ষিণের বারান্দারকথা।আর একতলায় গেটের কাছে পাতকুয়োটি এখন মজে গেলেও এক সময় নাকি এর জলেই পরম শান্তিতে স্নান সারতেন পথক্লান্ত রবীন্দ্রনাথ। এছাড়াও একেএকে দেখলাম ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক মঞ্চ পরিমল থিয়েটার, যেখানে অভিনয় করেছেন শিশির ভাদুড়ী থেকে আঙুর বালা-ইন্দুবালা দেবী। একটু রাতে গেলাম লালন ফকিরের মাজারে তথা সমাধিস্থলে। এক অনন্য সাধারণ পরিবেশ। পথ এক সময় ফুরোয়, চোখের সামনে দেখলাম আলোর মালায় সুসজ্জিত লালন ফকিরের সমাধি। জাত-পাতহীন লালন শাহের সহজ,সরল জীবন দর্শনের স্পর্শে আমাদের প্রত্যেকের মনে যেন ভাবুকতা এসে গেলো। মঞ্চবেঁধে লালন ভক্তরা সারারাত ধরে উদাত্ত কণ্ঠে লালনগীতিতে ওখানকার আকাশ-বাতাস ভরে উঠতে থাকলো। মঞ্চের উপর  ব্যানারের একপাশে একটি ছবি দেখলাম সেটি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা। এ যেন যথার্থই ‘গানের ভিতর দিয়েই’ ভুবন দেখা। মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লাম। রাতের পদ্মার অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলো। এবার ফেরার পালা । প্রথম দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে গেস্টহাউসে পৌঁছলাম, রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং ব্যালকনি থেকে রাতের অপরূপ কুষ্টিয়া  শহর দেখলাম দু’চোখ ভরে।রাত বাড়ছে ক্রমশ। আগামীকাল অন্য ভাবে অন্য দিকে  বেরিয়ে পড়বো,এইসব ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিনে খুব সকালে  মাইক্রো বাসে চেপে বসলাম সকলে। গন্তব্যস্হল  সিরাজগঞ্জের  সাজাদপুর। দূরত্ব ৬০-৬৫কিমি কুষ্টিয়া সদর শহর থেকে। সিরাজগঞ্জকে রবীন্দ্রনাথ কবিতায় অমর করে গিয়েছেন।’ সিরাজগঞ্জে বিরাট মিটিং তুলো বের করা বালিশ/ বংশ ফকির ভাঙা চৌকির পায়াতে লাগায় পালিশ।’ অন্যান্য কুঠিবাড়ি গুলির মতো শাহাজাদপুর কুঠিটিও ভালোভাবে সংরক্ষিত।একটি নান্দনিক সৌন্দর্যের আধুনিক বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহশালা অবস্হিত। ওখানে একটি অত্যাধুনিক সভাকক্ষও আছে। আমরা টিকিট কাটলাম। এখানে দেখলাম বিচিত্র ধরনের পালকি ,কোনটি ষোলো বেহারার,কোনটি আট বেহারার আবার চার বেহারার। রবীন্দ্রনাথের মতো বোটে চেপে কাচারিবাড়ির সামনে নামার উপায় নেই । করতোয়া নদী যে এখন পিচরাস্তা।নদী বুজে গেছে। করতোয়া এখন মরানদী। সেই রূপ আর নেই। তবে মরা একটি খাত দেখলাম কাছারিবাড়ির বাগানের পাশে। পাবনা জেলার সাহাজাদপুর বিখ্যাত দুধ-ঘিয়ের জন্য। রবীন্দ্রনাথের সময়েও বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল আজকের এই ছোট্ট শহরটি।’ছিন্নপত্রে’উল্লেখ রয়েছে এই জায়গার। অজস্র ছোট-বড় দুধ আর মিষ্টির দোকান , সারিসারি তাঁতের শাড়ির দোকান দেখলাম।কাছারিবাড়ির দোতলা থেকে এই গুলো সুন্দর দেখা যায়। দোতলা ঘরে জানালার ধারটিতে দাঁড়ালে রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগবেই।এর সামনে রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল।এই টেবিলে বসে লেখেন ছোটগল্প-‘পোস্টমাস্টার’। রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরে আম জনতার কাছাকাছি এসেছিলেন। বাংলাদেশের দুপুরের অতিলৌকিক সৌন্দর্য সাজাদপুরেই উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই এখানকার মধ্যাহ্নকে তিনি বলেছেন’গল্পের দুপুর বেলা’ ,যা তাঁর মনে আরব্য উপন্যাসের মায়া বিস্তার করতো। সাজাদপুরে লেখা হয় ‘ ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মতো গল্প।দোতলার বৈঠক খানার শোভা গোল শ্বেতপাথরের টেবিলটি ছুঁয়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। এখানে বসেই তিনি অনূদিত করেছিলেন’গীতাঞ্জলি’র বেশিভাগ গান। এক সময়ে প্রিয় কাছারি বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়‌ তাঁকে। সেই বেদনা থেকে প্রকাশিত হলো—‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে।’নারী নয়,এই ব্যাকুলতা ছিল বাড়িটির জন্য। বেশ দুপুর হলো, তখন বেলা বারোটা। দুপুরের খাওয়া পর্ব সারলাম এবং বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।মূল লক্ষ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসরে যাওয়া। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ও সাজাদপুর থেকে রবীন্দ্রনাথ আসতেন সেই সময়ে জলপথে ।এটা ছিল আমাদের প্রত্যেকের অধরা স্বপ্ন। বর্তমানে জলেপথে যাওয়ার সুযোগ নেই।কারণ সাজাদপুরের করতোয়া নদীর মতো পতিসরের নাগর নদী একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায় নি।পড়ে আছে মজে যাওয়া খাত।এই নাগর নদীকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন—-‘আমাদের ছোট  নদী চলে আঁকেবাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’ বগুড়া থেকে বাসে যাওয়া সহজ এইখানে। পুরোটা বাস চলেনা।১৩কিমি আমরা পঞ্চপান্ডব চলেছি ভ্যানরিক্সায়।এ-এক অন্য জীবনে পদচারণা। বাংলাদেশের গ্রামে এই ধরনের  যানের বহুল ব্যবহার  চোখে পড়লো, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে এর প্রচলন রয়েছে। সেই  সময় রবীন্দ্রনাথ এতকষ্ট করতেন না। নাগর নদীর ঘাট থেকে কাছারিবাড়ি পর্যন্ত পাতা থাকতো লাল কার্পেট।সে সব আজ অতীতের কথকতা। ভিতরের  বিভিন্ন অংশ ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। সাদামাটা গ্রামের বাড়ির মতোই এখানকার কাছারির অন্দরমহল’। উঠোনে অবস্হিত রবীন্দ্রনাথের মূর্তিখানা খুব নান্দনিক সৌন্দর্যের নয়। জমিদারির হাঁকডাকের জায়গা নয় পতিসর। শিলাইদহ-সাজাদপুরের সম্ভ্রম জাগানো কোন আভিজাত্যের ছোঁয়া পাওয়া গেল না। একদমই সাদামাটা ভাবেই জীবন কাটাতেন কবি এখানে। রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতের  লেখা জমিদারির হিসাবের খাতা দেখার সুযোগ হলো। এখানকার চলনবিল ধরে পতিসর আসার সময় বেশ কিছু গান লিখেছিলেন।’যদি বারণ কর  গাইব না।’ আমাদের পরিকল্পনা ছিল রাত্রে এই জায়গাটাতে থেকে ফেরারপথে সকালে পাবনায় সুচিত্রা সেনের পৈতৃক বসতবাড়ি দর্শন করে ফিরে যাব নিজেদের শহরে। সন্ধ্যায় চলে  আসলাম নাগর নদীর তীরে। জীর্ণদশা দেখে মন খারাপ হলো। এই নদীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী কবিতার গভীর সম্পর্ক অন্বষণের একটা চেষ্টা করলাম। বেশ কিছু সময় কাটানোর জন্য একটু তীর বরাবরই হাঁটলাম। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে তৃপ্ত হলাম। মানুষের সহযোগিতা ভুলবো না। রাতের খাবার পর্ব সারলাম এবং একটু  ঘোরাঘুরি করলাম, গ্রামীণ মানুষের আন্তরিকতায় হৃদয় ছুঁয়ে গেল।রাত বাড়ছে ক্রমশ, ফিরে এলাম একটি সাধারণ হোটেলে। পরের দিন সকালে গেলাম রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্টিত প্রাইমারি স্কুলে। রবীন্দ্র সান্নিধ্যের মায়া ত্যাগ করে চললাম মেঠোপথে। পৌঁছেগেলাম কালীগ্রাম রবীন্দ্রনাথ ইনষ্টিটিউটশন স্কুলে। কবির নিজের হাতের তৈরি করা স্কুল আজও চলছে রমরমিয়ে।আসলে পতিসরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য মেজাজের মানুষ,সমাজ সেবায় ছিল অসীম মমত্ববোধ ও আগ্রহ।প্রিয়  প্রজাদের জন্য এখানে তৈরি করেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক। নোবেল পুরস্কারের  টাকার একটা বড় অংশ ব্যয় করেছিলেন পতিসরের  উন্নয়নে। কৃষি নিয়ে নানান পরীক্ষা-নীরিক্ষার সূচনাও এই পতিসরেই। শুনলাম  বা়ংলাদেশ সরকার এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করবে। সেই পরম্পরা শান্তিনিকেতনে বজায় রেখেছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। পাঁচিলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে  বাজপড়া এক তালগাছ।শোনা যায় ,একে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—‘ তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে,সব গাছ ছাড়িয়ে’। তালগাছের মতোই আকাশ-ছোঁয়া তাঁর মাথার নাগাল পায়  না আজো আম-বাঙালি। আমাদের মাথা নত  হলো তাঁর চরণধূলার তলে ।সকালের রবীন্দ্রনাথের  স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ফেরার পথে পাড়ি জমালাম,পথে পড়লো পাবনা জেলা।পথে এক জায়গায় গাড়ি হঠাৎ করেই থামলো, বেবিট্যাক্সির তরুণ ড্রাইভার  রাসেল আহমেদ আঙুল দিয়ে দেখালেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের বাবার বসতবাড়ি।আজ সবই অতীতের কথকতা, শুধুমাত্র স্মৃতি। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’গানটি শুনতে শুনতে যশোর জেলা ছুঁয়ে  প্রত্যাবর্তন সীমান্তের দিকে। নানান ধরনের স্মৃতি বুকে নিয়ে রাতের বনগাঁ লোকাল ধরে পৌঁছলাম  বিরাটিতে। পথনির্দেশ: শিয়ালদহ থেকে দূরত্ব বনগাঁ মাত্র৭৫কিমি, তারপর যশোর ছুঁয়ে কুষ্টিয়া , দূরত্ব মাত্র ১৫০কিমি। ভালো থাকার জন্য আছে লজ, গেস্টহাউস ও হোটেল। পরিচয়পত্র,ভিসাসহ পাসপোর্ট  সঙ্গে রাখতে হবে।সমস্যা হলে স্হানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা পাবেন সব সময়।
লেখক –  ডঃ সুবীর মণ্ডল, লোকগবেষক ও প্রাবন্ধিক, বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।