ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) ক্রিকেটের প্রথম যুগের শেষ ও দ্বিতীয় যুগের শুরুটা একই বিন্দুতে মিলিয়ে রাখল টুর্নামেন্টের ইতিহাসের সফলতম দল মুম্বাই ইন্ডিয়ানস।

২০১৯ সালে পূরণ হয়েছে আইপিএলের এক যুগ, সেবার চ্যাম্পিয়ন ছিল মুম্বাই। আর এবার নতুন যুগের প্রথম এবং সবমিলিয়ে ১৩তম আসরেও শিরোপা জিতে নিয়েছে রোহিত শর্মার দল।

একদিকে ছিল আইপিএলের বর্তমান ও সবমিলিয়ে চারবারের চ্যাম্পিয়ন মুম্বাই ইন্ডিয়ানস, অন্যদিকে এবারই প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা দিল্লি ক্যাপিট্যালস। দুই দলের মধ্যে যে ব্যবধানটা কত বড়, সেটা ফাইনালে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে মুম্বাই। ট্রেন্ট বোল্ট, রোহিত শর্মাদের সামনে পাত্তাই পায়নি শিখর ধাওয়ান, কাগিসো রাবাদাদের দিল্লি।

দুবাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ফাইনাল ম্যাচটি হয়েছে পুরোপুরি একপেশে। প্রথম ইনিংসে মুম্বাইয়ের কিউই পেসার বোল্টের আগুনে বোলিং আর দ্বিতীয় ইনিংসে অধিনায়ক রোহিতের উত্তাল উইলোবাজিই বড় বিজ্ঞাপন হয়ে রইল করোনাকালীন আইপিএলের ফাইনালের।

ম্যাচটিতে আগে ব্যাট করে অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার ও উইকেটরক্ষক রিশাভ পান্তের ফিফটির পরেও ১৫৬ রানের বেশি করতে পারেনি দিল্লি। জবাবে মাত্র ৫ উইকেট হারিয়ে ৮ বল হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে গেছে মুম্বাই, পেয়ে গেছে পঞ্চম শিরোপার স্বাদ।

উদবোধনি জুটিতে মাত্র ২৫ বলে ৪৫ রান যোগ করেন রোহিত ও কক। ইনিংসের পঞ্চম ওভারের প্রথম বলে আউট হওয়ার আগে ৩ চার ও ১ ছয়ের মারে ১২ বলে ২০ রান করেন কক।

তবু দমে যাননি রোহিত। তিনে নামা সূর্যকুমারকে নিয়ে চালিয়ে যান আক্রমণ। প্রথম পাওয়ার প্লেতে ১ উইকেটে ৬১ রান করে মুম্বাই। যা কি না আইপিএলের ফাইনালে পাওয়ার প্লেতে করা সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। রোহিতের এক ভুল কলে ইনিংস বড় করতে পারেননি সূর্য। দ্বিতীয় উইকেট জুটিও যখন ঠিক ৪৫, তখন রানআউটে কাটা পড়েন সূর্য।

পুরো আসরে প্রায় দেড়শ স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করা সূর্য ফাইনালে খেলেছেন ২০ বলে ১৯ রানের স্বভাববিরুদ্ধ ইনিংস। তবে রোহিতের আক্রমণের কারণে সূর্যের মন্থর ব্যাটিংয়ের প্রভাব পড়েনি মুম্বাইয়ের ইনিংসে। ঝড়ো ব্যাটে ৩ চার ও ৪ ছয়ের মারে ৩৬ বলে ব্যক্তিগত পঞ্চাশ পূরণ করেন রোহিত।

চার নম্বরে নামা ইশান কিশানকে নিয়ে জয়ের বন্দরে প্রায় পৌঁছেই গিয়েছিলেন মুম্বাই অধিনায়ক। কিন্তু জয় থেকে মাত্র ২০ রান দূরে থাকতে তাকে সাজঘরের টিকিট ধরিয়ে দেন এনরিচ নর্টজে। ততক্ষণে জয় প্রায় নিশ্চিত মুম্বাইয়ের। আউট হওয়ার আগে ৫১ বলে ৬৮ রান করেন রোহিত।

পরে কাইরন পোলার্ডের ব্যাটে ছিল দ্রুত ম্যাচ শেষ করার তাগাদা। উইকেটে এসেই হাঁকান জোড়া বাউন্ডারি। কিন্তু ৪ বলের বেশি খেলতে পারেননি তিনি, করেন ৯ রান।

রোহিত-পোলার্ড ফিরে গেলেও তরুণ ইশান কিশান ভুল করেননি। দলকে জিতিয়ে বিজয়ীর বেশেই মাঠ ছেড়েছেন আসরে পাঁচশর বেশি রান করা ব্যাটসম্যান। ফাইনালে তিনি খেলেন ১৯ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস।

এর আগে আইপিএলের ১৩তম আসরের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে আগে ব্যাট করে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ১৫৬ রান করে প্রথমবারের মতো ফাইনালে ওঠা দিল্লি ক্যাপিট্যালস। অধিনায়ক শ্রেয়াস আইয়ার ও উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান রিশাভ পান্তের ফিফটির পরেও দলীয় সংগ্রহ বড় হয়নি দিল্লির।

আইপিএলের ষষ্ঠ অধিনায়ক হিসেবে ফাইনালে ফিফটির দেখা পেয়েছেন শ্রেয়াস। ২০১৩ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনি (চেন্নাই), ২০১৫ সালে রোহিত শর্মা (মুম্বাই), ২০১৬ সালে ডেভিড ওয়ার্নার (হায়দরাবাদ) ও বিরাট কোহলি (ব্যাঙ্গালুরু) এবং ২০১৭ সালে স্টিভেন স্মিথের (রাইজিং পুনে) পর এ কীর্তি গড়লেন শ্রেয়াস।

তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান রিশাভ পান্ত। মাত্র ২২ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর ৬৯ বলে ৯৬ রানের জুটি গড়েন পান্ত ও আইয়ার। মূলত এ জুটির কল্যাণেই লড়াই করার মতো পুঁজি পায় দিল্লি।

ফাইনালে দিল্লির ব্যাটিং দৈন্যতার শুরুটা হয়েছে মূলত ইনিংসের একদম প্রথম বলেই। ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই দুই দলের পার্থক্যটা স্পষ্ট করে দেন মুম্বাইয়ের বাঁহাতি পেসার ট্রেন্ট বোল্ট। শুধু পার্থক্য গড়েছেন বললে ভুল হবে, রীতিমতো আইপিএল ইতিহাসেই অনন্য এক কীর্তির মালিক হয়েছেন বোল্ট।

ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলেই তিনি সাজঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন দিল্লির অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার মার্কাস স্টয়নিসকে। আইপিএল ইতিহাসে ফাইনাল ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে উইকেট পাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। বোল্ট শুধু আজকের ম্যাচেই প্রথম ওভারে উইকেট নিলেন না, চলতি আসরে দিল্লির বিপক্ষে আগের তিন ম্যাচেও প্রথম ওভারে আঘাত হেনেছিলেন এ কিউই পেসার।

পরে বোল্টের আগুন থেকে রক্ষা পাননি তিন নম্বরে নামা আজিঙ্কা রাহানেও। ইনিংসের তৃতীয় ওভারে স্টয়নিসের মতোই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরের পথ ধরেছেন ৪ বলে ২ রান করা রাহানে। পাওয়ার প্লে’র মধ্যে বাঁহাতি ওপেনার শিখর ধাওয়ানের উইকেটও হারিয়েছে দিল্লি। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ধাওয়ান ১৩ বলে ১৫ রান করে আউট হয়েছেন চতুর্থ ওভারে।

চতুর্থ উইকেটে শক্ত প্রতিরোধ গড়েন শ্রেয়াস ও আইয়ার। পুরো আসরে ব্যাট হাতে অফফর্মে থাকা রিশাভ পান্টই মূলত শুরু করেন পাল্টা আক্রমণ। ক্রুনাল পান্ডিয়ার এক ওভারে হাঁকান জোড়া ছক্কা। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। ইনিংসের ১৫তম ওভারে কাউল্টার নাইলের ওভারে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৩৫ বলে ফিফটি পূরণ করেন পান্ত।

তবে নিজের ইনিংস বড় করতে পারেননি, ফিফটি করার পর আর একটি মাত্র চার মেরে সেই ওভারেই ফাইন লেগে হার্দিক পান্ডিয়ার হাতে ধরা পড়েন তিনি। আউট হওয়ার আগে ৪ চার ও ২ ছয়ের মারে ৩৮ বলে ৫৬ রান করেন পান্ত। তখন দিল্লির দলীয় সংগ্রহ ১৫ ওভার শেষে ৪ উইকেটে ১১৮ রান।

পান্ত আউট হলেও উইকেটে ছিলেন অধিনায়ক শ্রেয়াস। তবু শেষের পাঁচ ওভারে ঠিক প্রত্যাশামাফিক রান তুলতে পারেনি দিল্লি, এ সময়ে ৩ উইকেট হারিয়ে মাত্র ৩৮ রান করতে পেরেছে তারা। আইপিএল ইতিহাসের ষষ্ঠ ক্যাপ্টেন হিসেবে ফাইনালে ফিফটি করে ৬৫ রানে অপরাজিত থাকেন আইয়ার। পঞ্চাশ বলের ইনিংসটিকে ৬ চার ও ২ চারের মারে সাজান দিল্লি অধিনায়ক।

মুম্বাইয়ের পক্ষে বল হাতে সর্বোচ্চ ৩ উইকেট নেন ট্রেন্ট বোল্ট। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর পার্পল ক্যাপের সন্ধানে থাকা বুমরাহ থাকেন উইকেটশূন্য। এছাড়া কাউল্টার নাইল ২ ও জয়ন্ত যাদবের শিকার ১ উইকেট।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে