সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি:
জঙ্গলমহল বহু কৃতি মানুষের জন্ম দিয়েছে। সাফল্যের শীর্ষে উঠে কৃতি মানুষ গুলোর মধ্যে অনেকেই ভুলে যান নিজের শিকড়কে। আবার কেউ কেউ শিকড়ের সন্ধানে ফিরে আসেন নিজের স্বভূমিতে, অমল ভালোবাসা আর নাড়ির টানে। জেলা জুড়ে বেশ কিছু গুণী মানুষরা জেলার উন্নয়নের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন, তেমন একজন হলেন দেবেন মাহাত, যার নামে পুরুলিয়া মেডিকেল কলেজ। মানুষ বেঁচে থাকে শুধুমাত্র বর্ণময় কর্ম কৃতিত্বের জন্য। জন্ম তাঁর কোথায় হয়েছে সেটা বড় হয়ে দাঁড়ায় না। কর্মজীবনে মানুষের জন্য কি করে গেছেন, সেটাই বড় কথা। এই রুখা- সুখা জেলার স্বপ্নবিলাসী ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্নপূরণের লক্ষে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন,এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত খুবই কম । তবু সমাজ জীবনে চারধারে এমন কিছু কিছু মানুষ আছেন,যারা চিরকাল সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দেন ।জঙ্গলমহলের ভূমিপুত্র প্রাক্তন নাসার বিজ্ঞানী সর্বজন শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রফুল্ল মাহাত তেমনিই একজন ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব । মার্কিন মুলুকে দীর্ঘ কর্মজীবন শেষ করে শিকড়ের সন্ধানে ফিরে আসেন একরাশ স্বপ্ন নিয়ে। অবসর জীবনে একটাই উদ্দেশ্য নিজের জন্মভূমির জন্য কিছু করা। এ যেন শিকড়ে ফেরা , পঞ্চাশ বছর বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে ঘরের ছেলের ঘরে ফিরে আসা।কিছু দিন আগে দেশে ফিরেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট হলেন। এ এক অসাধারণ মানবিক ভাবনা ।যা আগামী প্রজন্মকে গভীরভাবে অনুপ্রেরণা জোগাবে নিশ্চিত ভাবে । নানান ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তার শৈশব কেটেছে। পুরুলিয়ার ঝালদা ব্লকের প্রত্যন্ত বানসারি গ্রামে তার জন্ম। সীমাহীন অভাব ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই। কখনো ভেঙে পড়েননি। পুরুলিয়া জেলা স্কুল থেকে খড়্গপুর আই,আই,টি ক্যাম্পাসে, তারপর শুধু শীর্ষে ওঠার বর্ণিল ইতিহাস।খড়্গপুর আই,আই,টি থেকে আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটি, অবশেষে নাসার বিজ্ঞানী। শুধু মেধার ভিত্তিতে অভাবকে জয় করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছেন। এটা ইতিহাস। জীবনের অপরাহ্ন বেলায় নিজের জেলার ছাত্র’ছাত্রীদের জন্য কিছু করতে পেরে তিনি কিছুটা হলেও তৃপ্ত। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের প্রবাস জীবন কাটালেও কোন দিন, তিনি লালমাটির দেশ পুরুলিয়াকে ভুলে যাননি। মন জুড়ে পিছিয়ে পড়া নিজের জেলার ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা ছিল। শৈশবের বিবর্ণ স্মৃতি তাকে তাড়িত করতো। যে জীবন থেকে উঠে এসেছিলেন একক চেষ্টায়, তা স্মৃতিতে আজও অমলিন। তিনি জঙ্গলমহলের মাটির মানুষ, মাটিকে,তার মানুষকে গভীর ভাবে ভালোবাসেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, জঙ্গলমহলে মেধার অভাব নেই, অভাব যোগ্য পরিকল্পনা ও পরিকাঠামোর। সেই পরিকাঠামোর অভাব দূরীকরণে এক সাহসী ভূমিকা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তাই সদ্য দেশে ফিরেই কর্মযজ্ঞ শুরু করলেন। এ এক অনন্য নজির জঙ্গলমহলের ইতিহাসে। তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য আমাদের প্রাণিত করে, ” জঙ্গলমহল তথা মানভূমের ভূমিপুত্রদের মেধার অভাব নেই, অভাব পরিকাঠামোর। ‘ নিজের পরিশ্রমলব্ধ ৩০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করলেন আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর লাইব্রেরি। হাতে-হাতে বই থেকে ডিজিটাল লাইব্রেরি, সবই থাকছে এক ছাদের নীচে। শিক্ষার্থীদের কাছে এ যেন রূপকথার স্বপ্নপুরী। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পুরুলিয়া রোটারি ক্লাবের ভূমিকা ভুলে যাওয়ার নয়। অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার সব উপকরণে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি। বিপুল সংখ্যক বইয়ের সমাবেশ, শিশুদের জন্য স্টাডি রুম আছে। এ -এক অন্যভুবন। জঙ্গলমহল বহু কৃতি মানুষের আঁতুড়ঘর। অনেক গুণী মানুষরা বিদেশে গিয়ে ভুলে যান নিজের শিকড়কে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী- ইঞ্জিনিয়ার প্রফুল্ল মাহাত ব্যতিক্রমী মানুষ। পুরুলিয়া শহরে অত্যাধুনিক গ্রন্থাগার নাসার দাপুটে ইঞ্জিনিয়ারের হাত ধরেই স্বপ্নপূরণ জঙ্গলমহলের লাল মটির পুরুলিয়ার ছাত্রছাত্রীদের। জঙ্গলমহল তথা মানভূমের ভুমিপুত্রদের দীর্ঘ দিনের একটি চাহিদা পূরণ করলেন তিনি। প্রফুল্ল বাবু আরও বলেন, ‘জেলার মানুষের কথা ভেবে ,সমগ্র জেলা জুড়ে এরকম আরও চারটি লাইব্রেরি হবে বিভিন্ন জায়গায়। ‘ এছাড়াও ভাবনা আছে উচ্চ মানের কোচিং সেন্টার তৈরি করা । একটি রুখা মাটির ইতিহাসে ওনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আরো অনেক প্রফুল্ল মাহাতোর মতো মানব দরদী মানুষের জন্ম হোক জঙ্গলমহলে। পুরুলিয়ার আপামর জনসাধারণ তার এই মহৎ কর্মসূচিকে চিরকাল মনে রাখবে।দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রম করবে আর একটি মাস বাদে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় জঙ্গলমহলের মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে বঞ্চিত শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও শিল্প থেকে। শুধু মেধা সম্বল করেই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে চলেছে। সময়ের হাত ধরে হয়তো আরও অনেক প্রফুল্ল মাহাতোর মতো মানুষের হাত ধরে জঙ্গলমহলে ছাত্রছাত্রীরা মেতে উঠবে স্বপ্নপূরণের নেশায়। জেলাবাসীর ঐকান্তিক ইচ্ছা আরও প্রফুল্ল মাহাত বাবুর মতো নিজের জেলার ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে এগিয়ে আসুক অন্যরা ।