গোমস্ততাপুর,চাঁপাই প্রতিনিধি:
করোনাকালীন নানা অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগ উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করোনাকালে সিএইচসিপি ও স্বাস্থ্য সহকারিদের বরাদ্দের সুরক্ষা সামগ্রী লোপাট এবং করোনা রোগী ভর্তি না করেও; হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়েছেন।
শুধু সুরক্ষা সামগ্রীই নয়, ভেষজ বাগান কেটে ফুলের বাগান তৈরি, এসি মেরামতের নামে কোটেশন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, জঙ্গি মামলার আসামী ও নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্তকৃত দুই উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারকে নিয়ম উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে স্বপদে বহাল, সরকারি গাড়ির অপব্যবহার, ষ্টাফদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ ও বদলী, টেন্ডার ছাড়াই আম ফল বিক্রিসহ নানা অনিয়ম ও দূনীর্তির অভিযোগও উঠেছে।
শুধু তাই নয়, সরকারিভাবে নিজ অফিস কক্ষ ও বাসভবনে এসি ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও; অভিযোগ হাসপাতালের ওটি, এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুম থেকে ৫ টি এসি খুলে নিজ অফিস কক্ষ, বাসভবন, ডাক্তারদের রেস্টরুম ও আরএমও’র রুমে এসব এসি প্রতিস্থাপন করেন ডা. মোহা. সারওয়ার জাহান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সারওয়ার জাহান গত ফেব্রুয়ারি মাসে যোগদানের পর থেকেই নিজের স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে; নিজেকে জড়িয়েছেন একের পর এক অনিয়ম ও দূর্নীতিতে।
আর এসব অনিয়ম ও দূর্নীতির তদন্ত চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন বঞ্চিত সিএইচসিপি, স্বাস্থ্য সহকারি, হাসপাতালের আরএমও এবং এলাকাবাসী। এসব অনিয়ম-দূর্নীতির সত্যতাও মেলে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে। যদিও; এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তা ডা. সারওয়ার জাহান। উল্টো তিনি দায় চাপিয়েছেন সিভিল সার্জনের উপর। আর সিভিল সার্জন জানিয়েছেন শীঘ্রই সকল অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করা হবে।
সরেজমিন চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর বাজারের ইউনুস আলী মাষ্টার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় কোন সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের টিকা প্রদান করছেন স্বাস্থ্য সহকারিরা। একই চিত্র কাজীহাটাসহ উপজেলার ৩৩টি কমিউনিটি ক্লিনিকের। যেখানে সংক্রমনের ঝুঁকি নিয়েই সেবা দিচ্ছেন সিএইচসিপি ও স্বাস্থ্য সহকারিরা।
এ সময় কাজীহাটা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি সদস্য হাবিবা সুলতনা ও পীরপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি সদস্য রাকিব হোসেন জানান,‘ করোনাকালে সরকারের দেওয়া স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী (বরাদ্দকৃত ৫ টি পিপিই, ১০ টি মাস্ক, ২০ টি গ্লাাভস, হ্যান্ড স্যানিটাইজার)) বার বার চাওয়া হলেও; তা দেননি ডা. সারওয়ার জাহান। উল্টো বলেন তাদের নামে কোনো সুরক্ষা সামগ্রী বরাদ্দ হয়নি। তাদের অভিযোগ পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি বরাদ্দকৃত এসব সুরক্ষা সামগ্রী হাসপাতালের ষ্টোররুমে না রেখে, সরকারি বাসভবনে রেখে লোপাট করেছেন তিনি।’
এদিকে, এসব অনিয়ম-দূর্ণীতির তদন্তের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ হেলথ এ্যাসিসটেন্ট ও উপজেলা সিএইচসিপি এ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। উপজেলা সিএইচসিপি এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহম্মেদ রুশদি জানান,‘ করোনাকালে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছি। অথচ অন্যান্য উপজেলা বরাদ্দকৃত সুরক্ষা সামগ্রী পেলেও; আমরা কেন পেলাম না? এ বিষয়ে আমরা বার বার ইউএইচএফপিও কর্মকর্তা ডা. সারওয়ার জাহান, সিভিল সার্জন, স্থথানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবহিত করলেও; এখন পর্যন্ত তা পাইনি। আমরা চাই এ ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত। তাহলেই বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।’
বাংলাদেশ হেলথ এ্যাসিসটেন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি নিয়ামতুল্লাহ জানান,‘সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই বাচ্চা ও মহিলাদের সংস্পর্ষে এসে টিকা প্রদান করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় আমাদের বরাদ্দকৃত সুরক্ষা সামগ্রীর জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বার বার জানার পরও; তা দেননি। অথচ আমরা জানতে পেরেছি আমাদের নামে ঠিকই বরাদ্দ এসেছে। তাহলে এগুলো কি হলো?
অনুসন্ধানে জানা যায়, মার্চ-এপ্রিল মাসে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ৬/৭ টি সেকশন, কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি এবং অনুদানকৃত পিপিই মিলিয়ে ৬০০’র অধিক পিপিই তিনি লোপাট করেছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ওই সময় বাজারে পিপিই সরবরাহ কম এবং চাহিদা বেশি থাকায় প্রতিটি পিপিই’র মূল্য নূন্যতম ২০০০হাজার টাকা করে ধরলেও; তিনি ৬০০ পিপিইর দরুন ১২ লাখ টাকা এবং অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী থেকে আরও প্রায় ৫ লাখ টাকা তিনি পকেটে পুরেছেন।
তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, হোম কোয়ারেন্টিনে সুস্থ হওয়া করোনা রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়েছেন। এই সুযোগে আত্মসাৎ করেছেন থোক বরাদ্দের ৩ লাখ টাকা। এর সত্যতাও নিশ্চিত করেছেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক। আর এ ধরনের ঘটনায় বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন রোগীরা।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সালাহ উদদীন আহম্মেদ জানান,‘উর্দ্বতন কতৃপক্ষের কাছে নিজের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে, হোম কোয়ারেন্টিনে সুস্থ হওয়া করোনা আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়ে বরাদ্দকৃত ৩ লক্ষ টাকা আত্মসাৎই ছিলো তার উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই তিনি তাদের হাসপাতালে ভর্তি দেখিয়েছেন। কাগজে কলমে হাসপাতালে রোগী ভর্তি দেখানো হলেও; বাস্তবে কোনো করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলোনা।’
আর ভর্তি দেখানো করোনা রোগী শহিদুল, আনাম, আমিরুল, রবিউল ও হাসপাতালের ষ্টাফ আরিফের সাথে কথা বললে তারা জানান,‘ তারা হোম কোয়ারেন্টিনে সুস্থ হয়েছেন। কখনোই তারা হাসপাতালে ভর্তি হননি এবং কোনো ধরনের সেবা নেননি। ডা. সারওয়ার জাহানের এমন কান্ডে প্রশ্ন তুলেছেন তারাও। তারা বলছেন, কিভাবে হাসপাতালের অফিস প্রধান করোনা পজেটিভ রোগীকে নিয়ে এ ধরনের মিথ্যা, জালিয়াতি রির্পোট প্রদান করেন। এই অনিয়ম-দূর্নীতির আমরা বিচার চাই।
শুধু সুরক্ষা সামগ্রীই নয় ডা. সারওয়ারের স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দূর্নীতির প্রমান মেলে ফুলের বাগান গড়তে ধ্বংস করেছেন হাসপাতালের সরকারি ভেষজ বাগানও। যেখানে ছিলো, মূল্যবান হরতকি, শতমূলী, বহেড়া, আসামলতা, নাগফনীসহ প্রায় ৫০ জাতের ওষুধী গাছ। অভিযোগ ক্ষমতার অপব্যবহার করে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই সেসব গাছ কেটে ধ্বংস করেন তিনি।
বাগানের দায়িত্বে থাকা হারবাল এ্যাসিসটেন্ট তরিকুল ইসলাম জানান,‘১৭ বছর ধরে গড়ে তোলা ভেষজ বাগানটি অসৎ উদ্দেশ্যে একক ক্ষমতাবলে ধ্বংস করেন তিনি। তরিকুল ইসলাম আরও বলেন, এ বিষয়ে তিনি আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অলটারনেটিভ মেডিকেলে কেয়ারকে (এএমসি) অবগত না করেই ভেষজ বাগানটি কেটে ধ্বংস করেন এবং সেখানে ফুলের বাগান গড়ে তুলেন। উল্টো তিনি আমাকে বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে দিয়ে বলবে,‘ আম্পান ঝড়ে ভেষজ বাগান ভেঙ্গে গেছে। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কোনো উপজেলায় আম্পান ঝড়ে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। পরবর্তীতে কোনো উপায় না পেয়ে আমি আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এএমসিকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি এ ঘটনার সুষ্ঠ তদেন্ত।
আর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সালাহ উদদীন আহম্মেদ জানান,‘ হাসপাতালের বাউন্ডারির ভেতর চমৎকার একটি ভেষজ বাগান ছিলো। অথচ ফুলের বাগান গড়তে কাউকে না জানিয়ে সরকারি ভেষজ বাগানটি ধ্বংস করেন ইউএইচএফপিও। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কৃর্তপক্ষের অনুমোদন ছাড়া তিনি এটি করতে পারেন না। তিনি বলেন,‘ভেষজ বাগানটি ধ্বংস না করে অন্য জায়গায় ফুলের বাগান তৈরি করা যেত। ভেষজ বাগানটি রক্ষা করা বেশি প্রয়োজনীয় ছিলো ফুলের বাগানের চাইতে।’
এছাড়া, সরকারিভাবে নিজ অফিস কক্ষ ও বাসভবনে এসি ব্যবহারের অনুমতি না থাকলেও; অভিযোগ হাসপাতালের ওটি, এক্সরে ও আল্ট্রাসনোগ্রাফি রুম থেকে ৫ টি এসি খুলে নিজ অফিস কক্ষ, বাসভবন, ডাক্তারদের রেস্টরুম ও আরএমও’র রুমে এসব এসি প্রতিস্থাপন করেন ডা. সারওয়ার জাহান। এতে ব্যক্তিগত ব্যবহারের কারণে বিদ্যুৎতের অপচয় ও সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এসব এসি মেরামতের নামে কোটেশন দেখিয়ে লোপাট করেছেন ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকাও। আর এই কোটেশন বিলে সাক্ষর করতে আপত্তি জানিয়েছেন খোদ কোটেশন কমিটির সদস্য হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সালাহ উদদীন আহম্মেদ।
এ বিষয়ে ডা. সালাহ উদদীন আহম্মেদ জানান,‘ ডেল্টাল চেয়ার, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, এসি প্রভৃতি মেডিকেল যন্ত্রপাতি মেরামত করার জন্য ‘নিমিউ’ এবং‘ গণপূর্ত’ নামক সরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। তারাই নিধার্রণ করবে কোন যন্ত্রটি নষ্ট এবং কোনটি ঠিক আছে। এক্ষেত্রে তিনি সরকারি আদেশ অগ্রাহ্য করে নিজেই অর্থ আত্মসাৎতের জন্য অবাস্তব এই কোটেশন করেন এবং বিল ভাউচারে আমাকে সাক্ষর করতে বললে আমি তা করিনি। পরবর্তীতে তিনি আমাকে কোটেশন কমিটি থেকে বাদ দিয়ে তার পছন্দের লোককে কমিটির সদস্য বানিয়ে ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।’
শুধু অনিয়ম-দূর্নীতিই নয়; অভিযোগ উঠেছে জঙ্গি মামলার আসামী ফারিকুল ইসলাম (জঙ্গিবাহিনী আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। ফোজদারি মামলা চলমান এবং দুই দফায় জেলও খেটেছেন) ও নির্বাচনে অনিয়মের দায়ে আব্দুস সামাদ নামে সাময়িক বরখাস্তকৃত দুই উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসাকে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে টাকার বিনিময়ে স্বপদে বহাল করেছেন ডা. সারওয়ার জাহান। তবে কাজে যোগদানের বিষয়ে কোনো লিখিত আদেশ দেখাতে না পারলেও; ফারিকুল ও আব্দুস সামাদ জানান তাদের কাজে যোগদানের বিষয়টি সিভিল সার্জন ও ডা সারওয়ারের মৌখিক নির্দেশেই হয়েছে।
তবে অভিযুক্ত ডা. সরওয়ার জাহান তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করলেও; দায় চাপিয়েছেন সিভিল সার্জনের উপর। তিনি বলেন,‘ সকল কার্যক্রমই সিভিল সার্জনকে মোখিকভাবে জানানো হয়েছে এবং তার মোখিক নির্দেশেই আমি এ সকল কাজ করেছি। পাশাপাশি তিনি এও বলেন, যেহেতু আমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ হয়েছে; সেহেতু আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। এর বেশি আমি আপনাদের আর কিছু বলতে চাইনা।’
আর দায় চাপানোর বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী কোনো সদুত্তর না দিলেও; তিনি জানান খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে এসব অনিয়ম-দূর্নীতির তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।