ক্রীড়া ডেস্ক:
বিশ্বকাপের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে সেরা ফাইনাল। গোটা ম্যাচজুড়ে বার বার বদলালো খেলার রঙ।
প্রথমার্ধে লিওনেল মেসি ও ডি মারিয়ার গোলে এগিয়ে গেল আর্জেন্টিনা। শেষ দিকে জোড়া গোল করলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
অতিরিক্ত সময়ে নিজের দ্বিতীয় গোল করলেন মেসি। খেলা শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে হ্যাটট্রিক পূর্ণ করলেন এমবাপ্পে। শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে হলো খেলার ফয়সালা।
যেখানে ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতলো মেসিরা। ৩৬ বছরের খরা কাটালো আর্জেন্টিনা।
ম্যাচের দুই অর্ধে দেখা গেল দুই রকম চিত্র। প্রথমার্ধ যদি হয় লিওনেল মেসির, তা হলে দ্বিতীয়ার্ধের ৭৮ থেকে ৮৫ মিনিটের মধ্যে খেলার চিত্র বদলে দিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।
দু’দলের দুই সেরা ফুটবলারের লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসলেন মেসিই।
প্রথমার্ধে মেসি একটি গোল করলেন তো এমবাপ্পে জোড়া গোল করে ফ্রান্সকে লড়াইয়ে রাখলেন। প্রথম ৭০ মিনিট খেলায় দাপট দেখালো আর্জেন্টিনা। কিন্তু তার পরে ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশমের দুটো পরিবর্তন খেলার রঙ-ই বদলে দিল।
কোম্যান ও কামাভিঙ্গা নামার পরে এমবাপে সেই খেলাটাই খেললেন, যেটা তিনি খেলতে পারেননি প্রথমার্ধে। ৯০ মিনিটের খেলা শেষ হয় ২-২। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে আবার গোল করলেন মেসি। কিন্তু তাতেও জয় আসেনি। তিন মিনিট বাকি থাকতে নিজের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন এমবাপ্পে। শেষ পর্যন্ত খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে বাজিমাত করলেন মেসি-মার্টিনেজ-মন্টিয়েলরা।
খেলাটা হওয়ার কথা ছিল মেসি বনাম এমবাপ্পের। দুই দলের দুই ১০ নম্বর জার্সিধারিদ্বয়ের। সেখানে প্রথমার্ধে যুবরাজকে প্রতি পদে টেক্কা দিলেন বৃদ্ধ রাজা। বয়স হয়তো হয়েছে, কিন্তু ধার কমেনি। গতি হয়তো কিছুটা কমেছে, কিন্তু রক্ষণ চেরা পাস কমেনি।
প্রথমার্ধজুড়েই দেখা গেল তার ঝলক। নিজের শেষ বিশ্বকাপ স্মরণীয় করে রাখতে মরিয়া হয়ে খেলছিলেন মেসি। আর তাকে বিশ্বকাপ দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে খেলছিলেন আর্জেন্টিনার বাকি ১০ ফুটবলার। রক্ষণ, মাঝমাঠ থেকে আক্রমণ, কোথাও ফ্রান্সকে একটু জায়গা দিলেন না আর্জেন্টিনার ফুটবলাররা। আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণেও নামতে দেখা গেল মেসিকে। যথার্থ নেতার মতো খেললেন তিনি।
প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার দুরন্ত ফুটবলের পিছনে কোচ স্কালোনির মস্তিষ্কের প্রশংসা করতে হয়। তিনি জানতেন, ফ্রান্সের সেরা দুই ফুটবলার এমবাপ্পে ও গ্রিজম্যান। এমবাপ্পে খেলেন প্রান্ত ধরে। গ্রিজম্যান খেলেন মাঝখান থেকে। অনেকটা মেসির মতো। এমবাপ্পের দৌড় বন্ধ করার জন্য মলিনা ও ম্যাক অ্যালিস্টারকে রেখেছিলেন স্কালোনি। পালা করে এমবাপ্পেকে নজরে রাখলেন তারা। এক বারের জন্যও ফাঁকা পেলেন না এমবাপ্পে। প্রথমার্ধে একবার ছাড়া আর্জেন্টিনার বক্সে ঢুকতে পারেননি কিলিয়ান।
প্রথমার্ধে জোড়া গোল খাওয়ার পর বাধ্য হয়ে দেম্বেলে ও অলিভিয়ের জিরুদ তুলে নেন ফ্রান্সের কোচ দেশম। এমবাপ্পেকে প্রধান স্ট্রাইকার করে দেওয়া হয়। তাতেই তার কার্যকারিতা আরও কমে যায়। দেখাই যাচ্ছিল না এমবাপ্পেকে।
প্রথমার্ধে মেসি ছাড়া আর্জেন্টিনার আরও এক জনের নাম করতেই হয়। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। চোটের কারণে নকআউটের কোনও ম্যাচে খেলেননি। ফাইনালের জন্য তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কোচ লিওনেল স্কালোনি। কেন রেখেছিলেন, সেটাও বোঝা গেল।
আর্জেন্টিনার প্রায় সব আক্রমণই হলো প্রান্ত ধরে। ডি মারিয়া না থাকায় আগের তিন ম্যাচে যেটা দেখা যায়নি। প্রথম গোলের পেছনেও ছিলেন ডি মারিয়া। বক্সের মধ্যে তাকে ফাউল করেন ওসমান দেম্বেলে। পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা।
স্পটে বল বসালেন মেসি। এক বার চোখ বন্ধ করলেন। একটু সময় নিলেন। তার পরে হুগো লরিসকে ভুল দিকে ফেলে গোল করলেন। ফাইনালে গোল করে মেসির উচ্ছ্বাস প্রকাশেও দেখা গেল নতুনত্ব। গোল লাইনের বাইরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন সতীর্থরা।
আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোল এলো সেই ডি মারিয়ার পা থেকেই। প্রতি আক্রমণে নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে বাঁ পায়ের আউট সাইড দিয়ে রদ্রিগো ডি পলকে পাস দেন মেসি। পলের পা থেকে বল পান আলভারেজ। বাঁ দিক দিয়ে অরক্ষিত উঠছিলেন ডি মারিয়া। আলভারেজের থেকে বল পেয়ে এগিয়ে আসা লরিসের উপর দিয়ে গোল করতে ভুল করেননি জুভ তারকা।
কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেলা যত গড়ালো ততোই ম্যাচে দাপট দেখাতে শুরু করলেন এমবাপ্পে। বয়সের ছাপটা হয়তো দেখা গেল মেসির খেলায়। বল ধরছিলেন। কিন্তু সেভাবে আক্রমণ তৈরি করতে পারছিলেন না।
অন্যদিকে এমবাপ্পে নিজের পছন্দের জায়গায় খেলা শুরু করতেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। বক্সের মধ্যে ওটামেন্ডি ফাউল করায় পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। গোল করেন এমবাপ্পে। দু’মিনিট পরেই বক্সের মধ্যে থেকে ডান পায়ের দুরন্ত শটে ফ্রান্সের হয়ে দ্বিতীয় গোল করেন ফরাসি তারকা।
নির্ধারিত সময়ের শেষ ১০ মিনিটে এগিয়েও যেতে পারত ফ্রান্স। এমবাপ্পের জোরালো শট একটুর জন্য বাইরে বেরিয়ে যায়। খেলার সংযুক্ত সময়ে আবার ফ্রান্সের গোল লক্ষ্য করে শট মেরেছিলেন মেসি। নিজেকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে সেই বল বাঁচান লরিস।
অতিরিক্ত সময়েও আক্রমণ- প্রতি আক্রমণের খেলা চলতে থাকে। প্রথমার্ধে বেশি সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। সুযোগ নষ্ট করেন আরভারেজ। দ্বিতীয়ার্ধে গোল করেন মেসি। লাউতারো মার্টিনেজের শট লরিস আটকে দিলেও ফিরতি বলে গোল করেন মেসি।
দেখে মনে হচ্ছিলো আর্জেন্টিনা জিতে যাবে। কিন্তু খেলা শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে মন্টিয়েল বক্সের মধ্যে হ্যান্ডবল করায় পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। নিজের তিন নম্বর গোল করেন এমবাপ্পে। শেষ দিকে ম্যাচ জেতার সহজ সুযোগ পেয়েছিলেন কোলো মুয়ানি। কিন্তু তার শট দারুণভাবে বাঁচান এমি মার্টিনেজ। খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে।
যেখানে নায়ক বনে যান এমি। একটি সেভ করেন আরেকটা যায় বাইরে দিয়ে। অন্যদিকে চারটিতেই গোল করে ৪-২ ব্যবধানে জিতে বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে আর্জেন্টিনা। বিশ্বসেরা তারকা বনে যান লিওনেল মেসি।