‘সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি:
বিশ্ব আদিবাসী দিবস একটি বর্ণময় পবিত্র দিবস। এক মহান আত্মত্যাগের ও আত্মমর্যাদা রক্ষার দিন। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে একটি স্মরণীয় দিন। দক্ষিণ বাঁকুড়ার( ৮টি ব্লক) জঙ্গলমহল জুড়ে পালিত হল এই পবিত্র ও তাৎপর্যময় দিবস।এই দিবসের পিছনে আছে একটি গর্বিত অধ্যায়।
আজ ২৬ তম বিশ্ব আদিবাসী দিবস । এক সময়ে সারা বিশ্বের আনুমানিক ৯০ টি দেশের ৩৭ কোটির আদিবাসী মানুষেরও বেশি নানাভাবে বঞ্চিত , নিপীড়িত ও অবহেলিত ছিল । বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ আজ এই দিনটিতে নিজেদের আত্মমর্যাদা ও অস্তিত্ব সারা বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালন করে আসছে ।ডিসেম্বর ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিশ্ব আদিবাসী দিবসটি পালনের ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। আন্তর্জাতিক দিবসটি বিশ্বের ৯০ টি দেশে ৩৭০ বিলিয়ন ১৯৯৪ সাল থেকে এই ৯ আগস্ট দিন টিকে প্রথম বিশ্ব আদিবাসী দিবস উপলক্ষে পালন করা হলেও ১৯৯৫ সালের ৯ আগস্ট দিনটিকে বিশ্ব আদিবাসী দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয় । বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতেই গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয় এই আন্তর্জাতিক দিবসটি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ গুলোকে অনেক লড়াই করতে হয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য । সংখ্যাতীত বীর সন্তানকে আত্মবলিদান দিতে হয়েছে সেই লড়াইয়ে । তাঁরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ বাহিনীর বন্দুকের সামনে নতজানু হয় নি, বীরত্বের সঙ্গে শহীদ হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হল। স্বাধীনতা লাভের পরও জাতিভেদ প্রথা আজও রয়ে গেছে। সমাজে সেই প্রথার বিরুদ্ধেও তাঁদের কে লড়াই করতে হচ্ছে আজও । স্বাধীনতার লাভের পূর্বে ইংরেজ সরকার ও বাহিনীর সীমাহীন অত্যাচারের মধ্যে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে করে গেছে,আজও শোষণ থেকে মুক্তি পুরোপুরি মুক্ত লাভ করতে পারে নি । তাঁরা নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে ও নিজেদের মতো করে বাঁচার জন্য বনভূমিকেই বেছে নিয়েছিলেন। বনভূমি হল তাদের লালন–পালন ভূমি। তাদের সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর। তারা নিজের মতো করে সবুজ বনভূমিকে তৈরি করেছেন এবং এই কাজ আবহমান কাল ধরে বিশ্বের সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন আজও করে আসছে। সেই কারণেই তারা প্রকৃতি সুরক্ষার কারিগর। মাটির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসে। সহজ,সরল। জীবনের চাহিদা খুবই কম। তবু মুখে অমলিন হাসি । বিশ্বের মানব ইতিহাসে এই দিনটি আলাদা তাৎপর্য বহন করে আনে।
অন্যান্য জেলার মতো বাঁকুড়া জেলা জুড়ে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় পালিত হল এই আন্তর্জাতিক দিবসটি। বিশেষ করে দক্ষিণ বাঁকুড়ার রাইপুর, সারেঙ্গা,হীড়বাধ, রাণীবাঁধ,ইন্দপুর।খাতড়া, সিমলাপাল, তালডাংরা ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় পালিত হয়েছে মহাধুমধামের সঙ্গে। করোনা বিধি মেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে সমগ্র অনুষ্ঠান। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের গোষ্ঠী নিজের মত করে পালন করেছেন । সেই সঙ্গে সরকারি উদ্যোগ এবং সহযোগিতায় বেশ কয়েকটি বড় ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন স্থানে।
আদিবাসী দিবস উদযাপিত হল সারেঙ্গা ব্লকের বাগজাতা মোড়ে। উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রায়পুর বিধানসভার প্রাক্তন বিধায়ক বীরেন্দ্রনাথ টুডু মহাশয় উপস্থিত ছিলেন সারেঙ্গা ব্লকের বিশিষ্ট সমাজসেবী সুব্রত মিত্র মহাশয় উপস্থিত ছিলেন কল্যাণ প্রসাদ মিশ্র মহাশয় উপস্থিত ছিলেন জঙ্গলমহল মুলনিবাসী মঞ্চের রাজ্য সভাপতি প্রসেনজিৎ মন্ডল মহাশয়। বাঁকুড়া জেলার অন্যতম সীমান্ত জেলা ঝাড়গ্রাম। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা ঝাড়গ্রাম থেকে বিশ্ব আদিবাসী দিবসের শুভ সূচনায় আদিবাসী নাচের তালে পা মেলালেন রাজ্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।তিনি এই সম্প্রদায়ের কাজের ও কাছের মানুষ।
তিনি বলেন, “আদিবাসীদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে তাঁর সরকার যথাযোগ্য চেষ্টা করেছে ও করবে। ঝাড়গ্রামকে স্বতন্ত্র জেলা তৈরির পাশাপাশি এখানে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ও বেশ কয়েকটি কলেজ, স্পোর্টস কমপ্লেক্স হয়েছে । এছাড়া নানান জনকল্যাণমূলক কাজ হয়েছে। ভালো মানের রাস্তা হয়েছে, সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সাঁওতালি ভাষায় পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে, অলচিকি ভাষায় ৫০০ স্কুল তৈরি করা হয়েছে। এক সময়ে যারা পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের জন্য নানান কর্মসূচি চলেছে। এদিন তিনি এই অঞ্চলের মানুষকে ধন্যবাদ জানান, তাঁদের পাশে থাকার জন্য। তাঁর আশা আদিবাসী সমাজের সকলে আরও এগিয়ে যাবেন।”
এছাড়া খাতড়া মহকুমা শহরের প্রাণকেন্দ্র এসডিও অফিসের মোড়ে পালিত হলো বিশ্ব আদিবাসী দিবস। সিধু- কানহু চকে। আয়োজনে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ, খাতড়া ইউনিট। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রতি মন্ত্রী মাননীয়া জ্যোৎস্না মাণ্ডি মহাশয়, বীরবাহা হাঁসদা ( রাজ্য বন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী ), সন্ধ্যা রানী টুডু( রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ),জেলাসভাধিপতি মাননীয় মৃত্যুঞ্জয় মুর্মু সহ বিশিষ্ট মন্ত্রী এবং বিধায়কেরা। নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে বীর সিধু- কানহুর মূর্তি উন্মোচন করা হয়।
সরকারি উদ্যোগে বড় ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে রাইপুর ব্লকে। অন্যতম কর্মসূচি ছিল বৃক্ষরোপণ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বগণ।নানা ধরনের অনুষ্ঠান হয়েছে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে। সমগ্র জেলা জুড়ে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ছিল মানুষের মধ্যে, মানুষের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন খুব খুশি হয়েছে বলে মনে হয়।