কোরবানির ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, চট্টগ্রাম নগরীর কামারপাড়ায় ব্যস্ততা তত বাড়ছে। হাতুড়ি পেটানোর টুং-টাং শব্দে তৈরি হচ্ছে দা, বটি, ছুরি-চাপাতিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। কামারদের অনেকে এখন ব্যস্ত পুরোনো দা, ছুরি, বটিতে শান দেওয়ার কাজে। কেউবা ব্যস্ত নতুন নতুন দা-ছুরি তৈরিতে।
সারা বছর অনেকটা অলস সময় পার করা কামারদের ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছে যে এখন অতিরিক্ত দরদাম করে সময় নষ্ট করতেও আগ্রহী নন তারা।
নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, আন্দরকিল্লা বকশির হাট, জেল রোড, ফকিরহাট, বহদ্দারহাট, আকবর শাহ ও একে খান এলাকায় কামারের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে প্রচণ্ড ভিড়। দোকানগুলোতে লোহার মানভেদে স্প্রিং লোহা ৩০০ টাকা, নরমাল ১২০ টাকা, পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ৫০ থেকে ১৫০, দা ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, পশু জবাইয়ের ছুরি ৩০০ টাকা থেকে শুরু, বটি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, চাপাতি ৫০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
নগরীর জিইসি মোড় এলাকা থেকে রিয়াজউদ্দিন বাজারে ছুরি ও দা বানাতে এসেছেন মো. সাদেক হোসেন। তিনি বলেন, কোরবানির জন্য নতুন দা-বটির প্রয়োজন। দেড় হাজার টাকায় দুটি বড় দা বানালাম। ছোট ছুরিও নিয়েছি কয়েকটা। গতবারের চেয়ে এবার দাম অনেক বেশি বলেই জানালেন তিনি।
জানা গেছে, এবার করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সরকারি নানা বিধিনিষেধের কারণে দেশজুড়ে কর্মক্ষেত্রে স্থবিরতা নেমে আসে। তবে এখন বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হওয়াতে কামারপাড়ায় পুরোদমে চলছে কাজ। তবে গত বছরের তুলনায় এবার কাজ অনেকটা কম বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে দয়াল কর নামে এক কামার বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে গত বছরের তুলনায় এবার কাজ কম। মানুষ পুরোনো জিনিস খুব কম সংস্কার করছেন। গতবছর যেখানে দৈনিক ৪-৫ হাজার টাকা আয় হতো, সেখানে এ বছর আয় হচ্ছে দৈনিক ১-২ হাজার টাকা।
রঘু দাস নামে আরেক কামার জানান, বছরের বাকি সময়টার বেশিরভাগই হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হয়। কোরবানির সময় এলেই বেচা-কেনা ও লোকজনের পুরোনো দা, বটি, ছুরি শান দেওয়ার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। প্রায় একই কথা বলেন অন্য কামাররাও।
কয়েকজন কামারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্প্রিং লোহা ও কাঁচা লোহা, সাধারণত এ দুই ধরনের লোহা ব্যবহার করে এসব উপকরণ তৈরি করা হয়। স্প্রিং লোহা দিয়ে তৈরি উপকরণের মান ভালো, দামও বেশি। আর কাঁচা লোহার তৈরি উপকরণগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন কামারের কারখানা ঘুরে দেখা গেছে এসব তৈরিতে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া এখনো লাগেনি। পুরানো নিয়মেই চলছে সকল কাজ। কামাররা কয়লার দগদগে আগুনে লোহাকে পুড়িয়ে পিটিয়ে তৈরি করছেন দা, ছুরি বটি, কোপাসহ মাংস কাটার কাজে ব্যবহৃত সামগ্রী।
বহদ্দারহাটের এক কর্মকার অভিযোগ করে বলেন, তাদের পরিশ্রমের তুলনায় মজুরি অনেক কম। সারা দিন আগুনের পাশে বসে থাকতে হয়। ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। তাদের আয়ের সাথে ব্যয়ের কোন মিল নেই। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে যা কামাই করি তা দিয়ে সংসার চলে না। সরকার এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে বিশেষ সুযোগ সুবিধা চালু করতে হবে। সারা বছরই শত শত কামার সম্প্রদায়ের লোক এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
বহদ্দারহাট কর্মকার সমিতির সভাপতি বলেন, প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ পাশাপাশি বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় লাভ আগের চেয়ে কম।এ পেশায় অধিক শ্রম দিতে হয়। জীবিকা নির্বাহে কষ্ট হলেও শুধু পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এ পেশাকে তারা এখনো আঁকড়ে ধরে আছেন। আর বছরে একবারই চাপাতি, ছুরি, বটির চাহিদা বেশি থাকে। তাই সরকার যদি এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয় তাহলে এই শিল্প টিকে থাকবে বলে আশা রাখি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আগামী ১ আগস্ট পালিত হবে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। এদিন মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সামর্থ্যবান ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন।