সারাবিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে এমন অবস্থায় সবার মনে প্রশ্ন একটাই। কবে নাগাদ এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বাজারে আসবে।
কিন্তু যেকোনো রোগের প্রতিষেধক বাজারে ছাড়ার আগে সেটা মানবদেহে প্রয়োগ সম্পূর্ণ নিরাপদ কিনা সেটা কয়েক ধাপের পরীক্ষায় নিশ্চিত করা হয়। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা টিকাটি যে দেশ আবিষ্কার করেছে তাদের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান মানবদেহে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়ে থাকে। খবর বিবিসি’র।
টিকা আবিষ্কার, এরপর সেটা অনুমোদন নিয়ে বাজারে আসা পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট সময় লাগে এটা নিশ্চিত হতে যে এর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আবার রোগের বৈশিষ্ট্যের ওপরেও নির্ভর করে যে এর ভ্যাকসিন প্রস্তুত হতে কতো সময় লাগবে। এর আগেও যতো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়েছে সেগুলো বাজারে আসতে ৫ থেকে ২৫ বছর কিংবা তার চাইতেও বেশি সময় নিয়েছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে গুটি বসন্ত, র্যাবিস, প্লেগ, কলেরা, টাইফয়েডের মতো বেশ কয়েকটি জটিল রোগের প্রতিষেধক বাজারে এসেছিল। তবে সেই সময় এই প্রতিষেধকের মান পরীক্ষা ও উৎপাদনের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি কমিটি আন্তর্জাতিকভাবে ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়ে থাকে। আবার অনেক দেশের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দিলে তারা তাদের দেশে প্রতিষেধক প্রয়োগ করতে পারে। আশার কথা হল বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রায় ১৮০টি টিকা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। তবে কোনটিই এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করতে পারেনি। এর মধ্যে কোন প্রতিষেধক আদৌ সফল হবে কিনা এবং কবে নাগাদ বাজারে আসবে, সেটা এখনও বলা যাচ্ছে না। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশা করছে দেড় বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২১ সালের মাঝামাঝি একটি ভ্যাকসিন বাজারে আসতে পারে।
প্রতিষেধক কী?
প্রতিষেধক বা টিকা তৈরি করা হয় রোগের দুর্বল কিংবা মৃত অণুজীব থেকে। সেটা ইনজেকশনের মাধ্যমে রোগীর দেহে ঢোকানো হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই বহিরাগত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে। ফলে ঐ ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীর ভেতরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এর কারণে ঐ ভাইরাসটি পুনরায় শরীরে আক্রমণ করলে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। এই প্রতিষেধক ত্বকে সুচ ফুটিয়ে বা খাবার ড্রপের মতো দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এবং যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী একটি প্রতিষেধক বাজারে আসার আগে চারটি ধাপে এর মান পরীক্ষা করা হয়।
সেই ধাপগুলো হল:
১. অনুসন্ধান ও গবেষণা।
২. প্রাক-ক্লিনিকাল পর্যায়।
৩. ক্লিনিকাল ডেভেলপমেন্ট।
৪. অনুমোদন ও উৎপাদন।
অনুসন্ধান ও গবেষণা:
এই গবেষণা সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষাগারে পরিচালিত হয়। বিজ্ঞানীরা এই পর্যায়ে মূলত ভাইরাসের জেনেটিক গঠনসহ অন্যান্য তথ্য বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেন। এ কারণে তারা পরীক্ষাগারে ভাইরাস বা সংক্রমিত কোষগুলির পৃষ্ঠ থেকে প্রোটিন এবং চিনি শনাক্ত করেন, তারপর গবেষণা করেন যে এই প্রোটিনগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে কিনা।
সেই সঙ্গে তারা ভাইরাসটি থেকে প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম অ্যান্টিজেন শনাক্তের চেষ্টা করেন, যার মাধ্যমে ওই ভাইরাস প্রতিরোধ বা রোগের চিকিৎসায় তা কাজে আসবে। এই অ্যান্টিজেনে, ভাইরাসের কণা, দুর্বল ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া, দুর্বল ব্যাকটেরিয়া টক্সিন বা রোগজীবাণু থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য পদার্থ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সেই সঙ্গে তারা বোঝার চেষ্টা করেন ভাইরাস প্রতিরোধে কত ডোজ প্রতিষেধকের প্রয়োজন হবে। এর জন্য দুই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
প্রাক-ক্লিনিকাল পর্যায়:
গবেষণার মাধ্যমে পাওয়া সেই প্রতিষেধকটি মানবদেহে পরীক্ষার আগে সেটা পরীক্ষাগারে থাকা ইঁদুর, খরগোশ, ভেড়া কিংবা বানরের শরীরে প্রয়োগ করা হয় এর প্রতিক্রিয়া দেখতে। কারণ নিশ্চিত না হয়ে মানুষের শরীরে এই প্রতিষেধক দেয়া হলে জীবন হুমকির মুখে ফেলতে পারে। এছাড়া এই পর্যায়ে ভাইরাসের টিস্যু কালচার ও কোষ কালচার নিয়েও পরীক্ষা করা হয়। এই ধাপ সম্পন্ন হতে সাধারণত এক থেকে দুই বছর সময় লাগে।
ক্লিনিকাল পরীক্ষা:
এই ক্লিনিকাল ট্রায়ালটি সম্পন্ন হয় ৪টি ধাপে।
প্রথমে ধাপে, স্বল্প সংখ্যক প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মানুষের ওপর এই প্রতিষেধক বিভিন্ন মাত্রায় দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ২০ থেকে ৮০ জন মানুষের ওপর চালানো এই পরীক্ষায় তিন মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে দেখা হয় কারও মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না। সাধারণত গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও গবেষকরা তাদের শরীরে এই ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের পরীক্ষা করে থাকেন। এমনকী শিশুদের জন্য তৈরি প্রতিষেধকও আগে প্রাপ্তবয়স্কদের শরীরে প্রয়োগ করে পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষায় যারা অংশ নেন তাদেরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে বিভিন্ন বয়স, স্বাস্থ্য ভেদে র্যান্ডম বা এলোপাতাড়ি কয়েকশ মানুষের ওপর নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হয়। তবে এই পরীক্ষা চালানো হয় ভাইরাসে আক্রান্ত অসুস্থ মানুষের ওপরে। এর জন্য আট মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
তৃতীয় ধাপে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লাখ অসুস্থ মানুষের ওপর ভ্যাকসিন দিয়ে এর কার্যকারিতা ও সুরক্ষা পরীক্ষা করা হয়। এর জন্য সময় লাগে দুই থেকে দশ বছর।
এরপর প্রতিষেধকটি কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হলে সেটিকে উৎপাদনের অনুমোদন দেয়া হয়। এই অনুমোদন পেতেও সময় লাগে কয়েক মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত। লাইসেন্স পাওয়ার পর চতুর্থ ধাপে চলে প্রতিষেধকের আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা।
অনুমোদন ও উৎপাদন:
সব ধাপে প্রতিষেধকটি নিরাপদ প্রমাণিত হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা যে কোন দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার থেকে এর লাইসেন্স বা অনুমোদন নিতে হয়। এরপর এই ভ্যাকসিন বিপুল সংখ্যায় উৎপাদন করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এই পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং মান নিয়ন্ত্রণ তদারকি করে থাকে এফডিএ। এর মধ্যে কোন একটি ধাপে প্রতিষেধকটি অনিরাপদ প্রমাণিত হলে এটি সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাবে।
প্রতিষেধক আগে যাদের দেয়া হবে:
করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক যদি সফল প্রমাণিত হয় তাহলে শুরুর দিকে সেটা দেয়া হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের যারা কোভিড-১৯ এর রোগীদের সংস্পর্শে আসবেন। এরপরে এটি দেয়া হবে বয়স্কদের যেহেতু তাদের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। তবে প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত সতর্ক হয়ে চলার ওপরই জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।