রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল ও ড্রেন কেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে যেতে পারছে না সেবা সংস্থাগুলো। এ কারণেই জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে মুক্তি মিলছে না নগরবাসীর। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে বছর বছর খাল ও ড্রেনের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, বরং এই দুর্ভোগ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এ অবস্থায় নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল ও ড্রেন ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড শোষণ ব্যবস্থা আর জলাশয়কে বাদ দিয়ে পরিকল্পনা করলে সুফল পাওয়া যাবে না। ড্রেন ও খালের পাশাপাশি উন্মুক্ত জলাধার ও খোলা জায়গা (কংক্রিট ঢালাইয়ে আচ্ছাদিত নয়) নিশ্চিত করতে পারলেই ঢাকায় জলাবদ্ধতা দূর করা যাবে।
জলাবদ্ধতার মূল কারণ নিয়ে ২০১৭ সালে একটি সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তাতে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় ৪৩টি খাল ছিল। এসব খালের মধ্যে ২৬টি ঢাকা ওয়াসা ও আটটি ঢাকা জেলা প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আর নয়টি খাল বক্স-কালভার্ট, রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনে পরিণত করা হয়েছে। বাকিগুলো বিলীন হয়ে গেছে। এসব খালে নেই পানিপ্রবাহ। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তবে সিটি করপোরেশনের এই প্রতিবেদনের খালের হিসাবের সঙ্গে একমত নন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা জানিয়েছেন খালের সংখ্যা ছিল ৫২টি। বাকি খালগুলোর এখন অস্তিত্ব নেই।
ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হয়ডিএনসিসির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদ্যমান খালগুলোর মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬০ ফুট, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩০ ফুট, প্যারিস খাল ২০ ফুটের জায়গায় ১০-১২ ফুট, বাইশটেকি খাল ৩০ ফুটের জায়গায় ১৮-২০ ফুট, বাউনিয়া খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩৫-৪০ ফুট, দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের জায়গায় ১৭০ ফুট, আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের জায়গায় স্থানভেদে ৬০ থেকে ৭০ ফুট, কল্যাণপুর ‘ক’ খালের বিশাল অংশে এখন সরু ড্রেন, রূপনগর খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ২৫ থেকে ৩০ ফুট, কাটাসুর খাল ২০ মিটারের জায়গায় ১৪ মিটার, ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেত সংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের জায়গায় ১৮ ফুট রয়েছে।
এসব খালের অধিকাংশ স্থানে প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ময়লা-অবর্জনা ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিলীন হয়ে গেছে অস্তিত্ব। এতগুলো খাল থাকার পরেও রাজধানীর জলাবদ্ধতার কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দখল-দূষণের পরেও যে পরিমাণ খাল রয়েছে সেটাও যদি সচল রাখা যেতো তাহলে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় এতো দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।
এসব খাল ও ড্রেন সচল করার জন্য প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এ বছর সড়ক, ফুটপাত ও সারফেস ড্রেন নির্মাণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ছিল ৬৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ব্যয় করা হয়েছে ৫৯৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে ৭১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এই খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭২ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২৪ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসাও তাদের নিজস্ব ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যয় করে বড় অঙ্কের টাকা।
জলাবদ্ধতার জন্য এত টাকা ব্যয় করা হলেও এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাচ্ছে না নগরবাসী। উপরন্তু প্রতি বছরই জলাবদ্ধতার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। তবে দুই একটি প্রকল্পের কারণে এলাকাভিত্তিক কিছুটা মুক্তি মিললেও তার প্রভাব গিয়ে অন্য এলাকায় পড়ে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আদর্শ শহরে ২৫ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা ও ১৫ ভাগ জলাধার থাকবে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় উন্মুক্ত এলাকা নেই বললেই চলে। শহরের সিংহভাগই কংক্রিটের ঢালাইয়ে আবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও বাড়ছে না। আর এই খালি জায়গাগুলোতেও বৃষ্টি পানি যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনের পর দিন কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯-এ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ ভাগে। একই অবস্থা জলজ ভূমিরও। গত বছর এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ ভাগ। এভাবে দিন দিন জলজ ভূমি ও খালি জায়গাগুলো কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘যতদিন খাল ও ড্রেন কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে বের করে আনা যাবে না, ততদিন ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর খাল ও ড্রেন কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার কারণেই আজ বৃষ্টি হলে ঢাকা ডুবে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসন করতে হলে খাল ও ড্রেনের পাশাপাশি উন্মুক্ত জায়গা ও জলাশয় রক্ষা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটি আদর্শ বা বাসযোগ্য শহরে কমপক্ষে ৪০ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা থাকা অবশ্যক। কিন্তু গত বছর পর্যন্ত আমাদের তা ছিল মাত্র ১৮ ভাগ। এর মধ্যে মূল শহরে এ জায়গার পরিমাণ ১০ ভাগেরও কম। আজ যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে সেসব এলাকায় উন্মুক্ত জায়গা বা মাটির অস্তিত্ব নেই। সে কারণেই আবদ্ধ পানি মাটির শোষণ করে নিতে পারছে না। ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। যদি কিছু পানি মাটি শোষণের সক্ষমতার পাশাপাশি খাল ও ড্রেনগুলো সচল থাকতো তাহলে এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা যেতো না।’
এই পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘এখনও যেসব এলাকা উন্মুক্ত রয়েছে তা রক্ষা করতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। রাজউক যদি ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় সেখানে কী পরিমাণ জায়গা খালি রাখতে হবে সেটা চিহ্নিত করে দেয় এবং নিয়মিত তদারকি করে তাহলে জলাবদ্ধতার সমস্যা সামাধানের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও আরও বাড়বে।’
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা নেই বললেই চলে। যে কারণে বৃষ্টি হলেই সেই পানি বাসাবাড়ির ছাদ হয়ে রাস্তায় চলে আসে। এই পানিগুলো আবদ্ধ করে রাখার মতো কোনও উন্মুক্ত জায়গা নেই। যদি থাকতো তাহলে কিছু পানি ভূগর্ভে চলে যেতো। বাকি পানি ড্রেন ও নালা দিয়ে খাল হয়ে আশপাশের নদীতে চলে যেতো। তখন জলাবদ্ধতা হতো না। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে কৃত্রিমভাবে ড্রেন নির্মাণ করে সেগুলো সচল রাখতে হচ্ছে।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘আমরা ঢাকা শহরকে নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি একটি মাস্টার প্ল্যান করছি। যেখানে সবকিছু থাকবে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করলে শহরের জলাবদ্ধতাসহ অধিকাংশ সমস্যা দূর হয়ে যাবে।’
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতার মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু তারা সেই কাজ করছে না। তারা খাল ও ড্রেন নিয়ে বসে আসে। আমরা খালগুলোকে আমাদের আন্ডারে দেওয়ার জন্য দাবি করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে মিরপুরের সাংবাদিক খালের সমস্যা অনেকাংশে দূর করেছি। বিমান বন্দর থেকে কাওনা পর্যন্ত এলাকার খাল পুনঃ উদ্ধার করে সেই এলাকার সমস্যা দূর করেছি।’