সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি :
এই মূহুর্তে জঙ্গলমহলের আকাশ ঝলমলে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে অনেক খানি।দুদিনের ইয়াসের তাণ্ডবলীলায় বিধ্বস্ত বাঁকুুুড়া- পুরুলিয়ার সাধারণ মানুষ মন থেকে দুর্যোগের কালো মেঘ সরিয়ে মেতে উঠেছে রোহিণী উৎসবে।
রোহিণী কৃষিভিত্তিক একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত লোক উৎসব। জঙ্গলমহলের মানুষের বিশ্বাস, এই দিন চাষের জমিতে বীজ ফেললে ফসলে পোকা লাগে না। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, ‘এই এলাকার মানুষের বিশ্বাস, জ্যৈষ্ঠ মাসের তেরো তারিখ চাষের জমিতে বীজ ফেললে ফসল ভাল হয়। তাই এই দিনটি রোহিন বা রোহিনী পরব নামে পরিচিত।
এই অঞ্চলে জৈষ্ঠ মাসের তেরো তারিখে বীচ পুহ্না বা বীজ বপন উপলক্ষে রহিন উৎসব উদযাপন করা হয়। কৃষকদের বিশ্বাস, রোহিনী নক্ষত্র সেই দিন পৃথিবীর নিকটবর্তী এসে পড়ায় ঐ দিন বীজ বপন করলে শস্য উৎপাদনে কোন বাঁধা থাকে না। ভোর বেলায় মহিলারা গোবর দিয়ে উঠোন নিকিয়ে রাখেন এবং গোবর গোলা জলে লতাপাতা ডুবিয়ে আলপনা আঁকেন।
এরপর স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে মাঠ থেকে রহিন মাটি এনে ঘরের চারকোণে ও তুলসী মঞ্চে জড়ো করে রাখা হয়। পুরুষেরা রোহিন ফল বা কেলেকড়া সংগ্রহ করে আনেন। যে বাড়িতে আয় বেশি এবং খরচ কম, সেই বাড়ির সদস্যকে দিয়ে বীজ বপন করাতে হয়। এরপর ছোট ছেলে মেয়েরা রঙ কালি মেখে বানর, ভালুক প্রভৃতি জন্তু জানোয়ার সেজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা ও খাবার সংগ্রহ করে আনে।
জঙ্গলমহলের কৃষিজীবী মানুষজনেরা রোহিনী পরবের মধ্যে দিয়ে জমিতে বীজতলা রোপণ করে। এই সময় বৃষ্টির দেবতার পুজো-অর্চনা করা হয়। যাতে আগামী দিনে বর্ষার মরশুমে বৃষ্টির কোন খামতি না হয়, সেই লক্ষে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়।
সেই কারণেই জঙ্গল মহলের অত্যন্ত জনপ্রিয় লোক উৎসব রোহিণীকে ঘিরে উৎসবের মেজাজ তৈরি হয়েছে। স্হান ভেদে এই লোক উৎসবটি হল রহিন, রোহিনী, রহনি, রহইন। এটি আঞ্চলিক ভাষা তাই স্হান হিসাবে উচ্চারণের তারতম্য রয়েছে কিন্তু এর মূল কথাটি হল রোহিণী যা একটি নক্ষত্ররে নাম। তিথির প্রভাব রয়েছে বলে এই অঞ্চলের মানুষের গভীর বিশ্বাস।
এই দিনটিকে অত্যন্ত শুভ, পবিত্র বলে মনে করেন এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ। এর আগে যারা বীজ ছড়াতে পারেননি জমিতে, তারা এই দিনটিতে বীজ বপনের কাজ সেরে ফেলেন। বাঁকুুুড়া – পুরুলিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় পরব রোহিণী। বাড়ির মালিক খালি পেটে আষাড়ি ফল খান। বাড়ির মেয়েরা স্হান করে ভিজে কাপড়ে বাঁশের তৈরি একটি পাত্রে জমি থেকে মাটি তুলে আনে। একে বলে রোহিণ মাটি। তুুুুসলি মঞ্চে রেখে দেয়। বাড়ির প্রত্যেকটি দরজায় এই মাটি দেওয়ার চল লক্ষ করা যায় । মাটি আনার সময় কথা বলা নিষেধ।
এই লোক উৎসবে পায়রা, মোরগ, ভেড়া বলি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। দুপুর বেলায় প্রত্যেকটি বাড়িতে মাংস হবেই। এটা রীতি। এই লোক উৎসবের আনন্দময় দিক হল ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের নানান ধরনের মজাদার খেলা, সঙ্গে মজার নাচ। এই নাচের নাম রোহিণ নাচ। পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতির গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায় অভিমত ব্যক্ত করেন –” রোহিণ পরব মূলত জঙ্গলমহলের কৃষিজীবী মাহাত সম্প্রদায়ের মানুষজন পালন করে আসছে।
রোহিণী একটি নক্ষত্র। এর প্রভাবে বৃষ্টি হয়, ভালো ফসল ও কৃষিকর্ম ভালো হয় বলে বিশ্বাস করে।” আদিবাসী কুড়মি সম্প্ররদায়ে মানুষ আনন্দ মাহাত ও বলরাম মাহাত বললেন–” আমরা এই দিনটিকে অত্যন্ত পবিত্র মনে করি। বৃষ্টি দেবতার আরাধনা করা হয়। বীজতলা লাগানো হয়। কত শতাব্দী ধরে এই ঐতিহ্য চলে আসছে, তা বলা কঠিন। তবে যুগ যুগ ধরে আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষজন রোহিণী পরব পালন করে আসছে”।