সুবীর মণ্ডল, বাঁকুড়া জেলা প্রতিনিধি:

পেশার পোশাকের বাইরে আর একটি মানুষকে ।আর এক পৃথিবীকে। একজন  মানুষের মধ্যে আসলে  লুকিয়ে থাকে অনেকগুলি টুকরো টুকরো মানুষ। একজন  প্রাজ্ঞ  শিল্পীর গভীরে থাকে একজন  বিহ্বল  শিশুসুলভ মন– আশা নৈরাশ্যের ধূপছায়ায় গড়া তাঁর  রূপ—জীবন  শিল্পী চন্দন রায়  মহাশয়ের  মধ্যে  দিনের পর দিন  সেই  বিশ্বাসকে  সত্য হতে  দেখেছি। দেখে অবাক হয়ে   গেছি। অচেনার আঙিনা  থেকে  চেনার আলোরবৃত্তে পৌঁছেও এ ধন্দ কাটেনি,কোন মানুষটা  আমাদের  জেলার  এক- আকাশ গর্ব?
একুশ শতকের বদলে যাওয়া  দুনিয়ায়  ক্ষমতা  এবং তার বিশ্বস্ত অনুচর ভোগবাদের অনন্ত ঘোড় দৌড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে  নিজেকে  বিজ্ঞাপিত  না করে  অন্য এক জীবনচর্যা বেছে নিয়েছিলেন ভাস্কর্য শিল্পী চন্দন রায়। সম্পূর্ণ দিগভ্রান্ত সময়ে  নিজের  জায়গায় সৎ,প্রত্যয়ে সুস্হির।  শিল্পী  জীবনের  সাফল্য  তৃপ্ত করলেও অহংকারী করে   তোলেনি। তিনি   আছেন   নতুন  প্রজন্মের  শিল্পীদের   প্রত্যেকের হয়ে  ওঠার  বর্ণিল  ইতিহাসে,সকল শুভ ও মানবিক  প্রচেষ্টায়  তাঁর  আগ্রহ ও ঔৎসুক্য  জেলার  তরুণ প্রজন্মের  শিল্পীদের   বারবার উজ্জীবিত করেছে।  শৈশবে অবাক বিস্ময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়  বসে থাকতেন  বাড়ির সামনের দুর্গাপুজোর  মণ্ডপে। দুচোখ ভরে  দেখতেন,  শিল্পীর হাতে মৃন্ময়ী মা  কীভাবে  চিন্ময়ী   হয়ে উঠছে । সেই  শুভ সূচনা  মাটির সাথে  দিনযাপনের। 

তিনি বাঁকুড়ার পুখুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা ।
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তৈরি করেন গ্রামের দূর্গা প্রতিমা এবং বিশ্বভারতী থেকে ফাইন আর্টস এ মাস্টার্স তিনি ।১৯৯৭ থেকে টানা ১০ বছর চন্দন নগরে দুর্গাপুজোর মণ্ডপ গড়েছেন ।২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চন্দন বাবুর তৈরি তিনটি মূর্তি উপহার দেন। ২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী লন্ডনে গেলে সেখানের বাকিংহাম প্যালেসে রেখে আসেন চন্দন বাবুর তৈরি করা ধানের  রবীন্দ্রনাথ। সাবানের তৈরি তার অনেক শিল্প  ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় সমাদৃত  হয়েছে । বিভিন্ন প্যান্ডেলের,মন্দিরের ডিজাইনের কারিগর তিনি ।  চন্দন রায়ের শিল্পীকীর্তি উপহার পেয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও । বর্তমান  সময়ে  ভাস্কর্যে  আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাঁকুড়ার ধব্জা তুলে ধরেছেন তিনি। আমরা গর্বিত তাঁর  শিল্পকর্মে ।
ভারতের  মধ্যে তিনি  প্রথম  শিল্পী যিনি  একটি  পর্যটন কেন্দ্রকে রঙ- তুলির আঁচড়ে মনোমুগ্ধকর করে তুুুুলেছিলেন। লক্ষ লক্ষ ভ্রমণ পিপাসু মানুষ  মুগ্ধ  হন। পশ্চিমবঙ্গের   জনপ্রিয়  পর্যটন কেন্দ্র মুকুটমণিপুর তাঁর  হাত ধরে  রাতারাতি যেন পাল্টে গেল  অন্দরমহলের দৃশ্যপটে। শুধু  মায়াবী মুগ্ধতার আবেশ নয়, এক বর্ণময় ইতিহাস  সৃষ্টি  করলেন তিনি ।  এ – এক স্বপ্নপূরণের  ইতিবৃত্ত, পরতে পরতে  জড়িয়ে আছে  শিল্পীর  সীমাহীন  নিষ্ঠা ও পরিশ্রম। পরিস্থিতিটা বদলে গেল রাতারাতি। সৌজন্যে মুখ্যমন্ত্রী। বেশ কিছুদিন আগে  এক সন্ধ্যায় মুকুটমণিপুরে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পৌঁছনোর পরে পায়ে হেঁটে কংসাবতীর জলাধার ঘুরে দেখতে বেরোন তিনি। তখনই চোখে পড়ে, জলাধারের রাস্তা জুড়ে আলপনা।থমকে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পী চন্দন রায়কে ডেকে কথাও বলেন। শুধু তা-ই নয়, চন্দনবাবুর এই শিল্প মুখ্যমন্ত্রীর এতটাই ভাল লেগে যায় যে কলকাতা শহরের কিছু এলাকাতেও তিনি এই আলপনা দিয়ে সাজানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেন। চন্দনবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, মেটাল প্রাইমারের উপরে সিন্থেটিক অ্যানামেল দিয়ে আলপনা আঁকা হচ্ছে। এই রঙ চট করে নষ্ট হয়ে যায় না ।সিমলাপাল থানার পুখুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা চন্দনবাবু মুখ্যমন্ত্রীর মুখে প্রশংসা শুনে আপ্লুত। এরপর থেকেই মুকুটমণিপুরে কার্যত ভিআইপি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। খাতড়া মহকুমা শাসকের অফিসে  তার  শিল্পকর্মের ছাপ আজও  সুস্পষ্ট। দেশের  বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে তার শিল্পকর্মের বৈচিত্র্যময়তা।    এখন সবাই এসে আলাপ করে যাচ্ছেন। প্রশংসাও করছেন তাঁর কাজের।খাতড়া মহকুমা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে বছর কয়েক    আগে   মুকুটমণিপুর মেলা উপলক্ষে জলাধারে যাওয়ার রাস্তা জুড়ে আদিবাসীদের নিজস্ব শৈলীর আলপনা আঁকানো হয়েছিল। সেই কাজের দায়িত্ব পান বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র চন্দনবাবু।প্রায় দু’দশক ধরে খাতড়ায় আঁকার স্কুল চালিয়ে আসছেন জেলার   তরুণ  প্রজন্মের আইকন  চন্দন রায়  । নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলপনা শেষ করতে নিজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে লাগাতার কাজ করেছিলেন । মুখ্যমন্ত্রীর  নজরে পড়ে  তার অসাধারণ শিল্পকর্ম। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। শুধু  ওঠা, ক্রমাগত শীর্ষে ওঠা। কথা  প্রসঙ্গে   তিনি বললেন, ‘‘আমার কাজ যে মুখ্যমন্ত্রীর নজর কেড়েছে, সেটা ভাবতেই ভাল লাগছে। উনি আমাকে কলকাতায় ডেকেছেন। ’’বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘ মুখ্যমন্ত্রীর ভাল লাগাটা আমাদের কাছে বাড়তি পাওনা।’’ তাঁর  অসাধারণ সৃষ্টিকর্ম শুধু  দেশেই নয়, দেশের  বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। জি বাংলার ” দাদা গিরি” অনুষ্ঠানে বাংলার গর্ব  ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলী  তাঁর  শিল্পকলার উচ্চ প্রশংসা করেছেন।   
আরও অনেক চন্দন রায়  সৃষ্টি হোক  বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে।  শিল্পী চন্দন রায়ের সঙ্গে তার  নানান কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা করতে  গিয়ে  একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন, ” দীর্ঘদিনের  ইচ্ছা, একটি  বড় ধরনের শিল্প আকাদেমি গড়া, যেখানে  শুধুমাত্র  নামী প্রশিক্ষিত শিল্পী নয়,  বাংলার  লোকশিল্পীদেরও  উন্নতি হবে। লালমাটির লুপ্তপ্রায়  মাটির মানুষের  শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে  তার  উন্নতি  ঘটানোর  রঙিন  স্বপ্নপূরণের নেশায় মশগুল  বয়সে নবীন ,অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ  চন্দন রায়ের, “

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে