গল্প – চা দোকানী
লেখা – শ্রী রাজীব দত্ত
প্রাইভেট সেক্টর দাদা সমস্যাটা ওখানেই। কথাটা শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একটি মেয়েকে। চায়ের দোকানে রুটি বেলতে বেলতে একটি অল্প বয়সী মেয়ে বলল একথা । কান পেতে ভালোভাবে ঘটনাটা শুনলাম । মেয়েটির সাথে তার পূর্ব পরিচিত এক নিত্য বাসযাত্রী কথা চলছে তাদের কথা থেকে বুঝলাম।
এই মহিলা একসময় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতো কিন্তু সে চাকরি আজ আর নেই, আর তার পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক আজ মেয়েটির দোকানে খরিদ্দার। কাজ খুইয়ে কোন উপায় না পেয়ে একটা চায়ের দোকান চালাচ্ছে দুই অবিবাহিত স্বামী-স্ত্রী। একই অফিসে কাজ করতো তারা কিন্তু এই করোনার দাপটে অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। আর অবিবাহিত স্বামী-স্ত্রী মানে, তাদের কর্মসূত্রে দুজনের প্রেম কিন্তু কর্মহীন হয়ে পরেও তারা একসাথে ছোট ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের বড় স্বপ্ন পূরণের স্বপ্ন দেখছে। তাই একসাথে নিরুপায় হয়ে এই চায়ের দোকান। যখন চাকরি ছিল তখন ঠিকানা ছিল নিউটাউনের এক আবাসন, আর বর্তমানে শিয়ালদার কাছে ঝুপড়িতে একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়ি তে দুজনে থাকে। কথাগুলো শুনে মনে হল অট্টালিকা থেকে ফুটপাতে নেমে গেলেও এদের ভালোবাসা, বিশ্বাস, দায়িত্ব আর দায় বদ্ধতা কিন্তু সেই রাজ সিংহাসনে বিরাজ করছে। ওরা একে অপরের পরিপূরক, তাই এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও কেউ কারোর হাত ছেড়ে দেয়নি বরং আরো শক্ত করে ধরে রেখেছে অটুট বিশ্বাসে । দুজনকে দেখলেই বোঝা যায় বেশ রুচিসম্মত ও আভিজাত্য মানসিকতার পরিচয়। একজন খরিদ্দারের অর্ডার নিচ্ছে ডেলিভারি করছে অন্যজন রান্না করছে। এভাবেই দিনগুলো ওদের ভালোই চলছে। তাদের নানান কথাই আমি কান পেতে শুন ছিলাম, যদিও এটা এক প্রকার অসভ্যতা কিন্তু না শুনলেও সত্তিকারের ভালোবাসার গল্প থেকে বঞ্চিত হতাম। অনেক আশা আছে এই ছেলে মেয়ে দুটির ভবিষ্যত নিয়েও তাদের নানা পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাদের কথায়। ওদের ইচ্ছে এই দোকান থেকে একটি বড় রেস্টুরেন্ট এর ব্যবসা করার। নিজেদের সংসার নিজের মতন করে সাজানো। হাত ছাড়া তো দূরের কথা এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নিজেদের ভরসা নিজেরাই যোগায়। মনে হচ্ছিল আমি নিজেই ওদের সাথে কথা বলি কিন্তু সংকোচ বোধের কারণে বলিনি । ওদের কথা শুনতে শুনতে অনেকটা সময় ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা ওরাও লক্ষ্য করছিল। আমার মনে একটা কথা বারবার ফিরে আসছিল কত মানুষ প্রেম করে কিন্তু সময়ের তাগিদে বিচ্ছেদ দেখেছি বহুবার, কিন্তু এদের দেখে মনের সব ধারণাগুলো আজ মিথ্যে প্রমাণিত হলো। যেন গল্প হলেও সত্যি। দুজনেই উচ্চ পরিস্থিতিতে থেকে দুঃসময় সময় নেমে এসেছে, কিন্তু মনের মনিকোঠায় সবই রয়েছে ঠিক আগের মত…।
একথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এই মেয়েটি আমাকে প্রশ্ন করে “দাদা কিছু বলবেন অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছেন “, আমি আমি আবেগের বশে বিনা সংকোচে বলে ফেললাম -” না, মানে আপনাদের কথা শুনছিলাম” যদিও নিজেকে একটু ছোট লাগছিল সেই সময়। মেয়েটি এমন একটি উচ্চমানের ভাষায় আমায় উত্তর দিল। যা আজও আমাকে ভাবিয়ে তোলে। কবি জয় গোস্বামীর সেই লাইনটা …”আমাদের একটাই ছাতা, তাতে দুজনেরই চলে যায়” l