খুলনার খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী গ্রামে গুলিতে ট্রিপল মার্ডারের হোতা তিন ভাই শেখ জাকারিয়া, শেখ জাফরিন হাসান ও শেখ মিল্টনের অপরাধ জগতের নানা অজানা তথ্য প্রকাশ হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে তাদের অবৈধ অস্ত্রের ভাণ্ডার আলোচনায় উঠে এসেছে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত, হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি শেখ জাফরিন হাসানের বেশ কিছু সেলফি-ছবি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

যেসব ছবিতে রাজনীতিক এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাকে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে দেখা গেছে। এর মধ্যে ওসিসহ বর্তমান ও সাবেক তিন ঊর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন।

শেখ জাকারিয়া, শেখ জাফরিন হাসান ও শেখ মিল্টন তিন ভাই। তারা খুলনার খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী গ্রামের বাসিন্দা মৃত হাসান আলী শেখের ছেলে। অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে এগিয়ে। তাদের আনুগত্যের বাইরে গেলেই সাধারণ গ্রামবাসীর ওপর নেমে আসে অত্যাচার। এছাড়া পুলিশি হয়রানি তো আছেই।

স্থানীয়রা বলছেন, খানজাহান আলী থানায় নতুন ওসি যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গেই উল্লিখিত তিন ভাই ফুলের তোড়া নিয়ে তাদের উপহার দিতেন। থানায় পুলিশের কোনো ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা এলেও তারা একইভাবে ফুল দিয়ে বরণ করতেন। আর এ ফুলেল শুভেচ্ছার ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচারসহ নিদেজের কাছে রেখে সাধারণ মানুষের কাছে প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করতেন।

এভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছবিও তারা সংরক্ষণ করতেন অসৎ উদ্দেশ্যে। যদিও ইতোপূর্বে মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির পদ থেকে শেখ জাফরিনকে এবং গুলি চালিয়ে তিন জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যার দায়ে সম্প্রতি তার ভাই শেখ জাকারিয়া হাসানকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ‘অনুষ্ঠানে গেলে স্থানীয় লোকজন ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। ওই সময় কে অপরাধী আর কে ভালো এটা বোঝা মুশকিল। কোনো অপরাধীর সঙ্গে ছবি থাকলেই যে সে ছাড় পেয়ে যাবে তা নয়। অপরাধ করে ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাকে আইনের আওতায় আসতেই হবে। ইতিমধ্যেই জাফরিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ট্রিপল হত্যা মামলায় রোববার (১৯ জুলাই) থেকে আট দিনের পুলিশি রিমান্ডে রয়েছে সে।’

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার খোন্দকার লুৎফুল কবির বলেন, ‘‘সরকারি কর্মকর্তা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণে এসব বিষয়ে শেখানো হয়। সে কার সঙ্গে বসবে, কার সঙ্গে বসবে না, কার সঙ্গে চলবে, কার সঙ্গে চলবে না- এটা তাকেই মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে একজন অপরাধীর সঙ্গে কোনো আইন প্রয়োগকারী সদস্যের সখ্য হলে কমিউনিটিতে ভুল বার্তা যাবে। কোনোভাবেই সেটি কাম্য নয়। সেটি সমাজের জন্য সহায়ক না হয়ে নেতিবাচক উদাহরণ সৃস্টি করে।

“এ ধরনের অপরাধীর সঙ্গে ছবি তোলা অনভিপ্রেত। এতে অনেক সময় ভালো কর্মকর্তারাও বিভ্রান্তিতে পড়েন। যে কেউ ছবি তুলতে চাইলেই ছবি তোলা উচিত না। এ বিষয়ে কেএমপির সকল সদস্য সতর্ক করা হবে।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিতে খুলনা সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি তালুকদার আব্দুল খালেকের সঙ্গে সন্ত্রাসী শেখ জাফরিন হাসানের কোলাকুলিরত ছবি প্রকাশ পেয়েছে।

এছাড়া কেএমপি’র ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা মোল্লা জাহাঙ্গীর, মো. কামরুজ্জামান, খানজাহান আলী থানার বর্তমান বিতর্কিত ওসি এসএম শফিকুল ইসলাম এবং ইতোপূর্বে কেএমপিতে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলামের ছবি দেখা গেছে। এদের মধ‌্যে কামরুল ইসলাম ইতোমধ্যেই অবসর গ্রহণ করেছেন।

খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও কেসিসি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, ‘সন্ত্রাসী জাফরিনকে আমি চিনি না। এ ধরনের কোনো ব্যাড এলিমেন্টকে আমি প্রশ্রয়ও দেন না। সে নিজের দলের হলেও।’

ছবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সামাজিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকি। বহুলোক আমার কাছে আসে। তাদের সবাইকে চেনার কথা না। তবে, সুযোগ সন্ধানীরা ছবি তুলতে পারে। এরা খারাপ উদ্দেশ‌্য নিয়েই ছবি তোলে। তবে তার দায় নিশ্চয়ই আমার নয়।’

গ্রামবাসীর অভিযোগ, জাকারিয়ারা তিন ভাই খানজাহান আলী থানার ওসিকে ব্যবহার করেই তাদের ওপর অত্যাহার-জুলুম চালাতো। বিপক্ষে গেলেই পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে হয়রানি করতো। জাফরিন ও জাকারিয়ার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলাও জিডি রয়েছে। জাফরিন ও জাকারিয়া বাহিনীর ভয়ে অনেকেই এলাকা থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া এর আগেও মশিয়ালী গ্রামের ফকিরপাড়ায় মিটুল নামে এক যুবকের সাথে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাফরিন ও তার ভাই জাকারিয়ার সংর্ঘষ হয়।

তবে, জাকারিয়া শেখের সাথে খানজাহান আলী থানার ওসি শফিকুল ইসলামের সখ্যতা থাকার কারণে বিভিন্ন সময়ে অপরাধ করেও তারা পার পেয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।

পুলিশের সূত্র জানায়, জাফরিন ও জাকারিয়া স্থানীয় ডাক্তার বাড়ির মোমিন ড্রাইভারে ছেলে সাইফুল হত্যা মামলার আসামি। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিরও মামলা রয়েছে। অপর ভাই মিল্টন অস্ত্রসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পরে জামিনে মুক্তি পায়।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খানহাজান আলী থানার ওসি এসএম শফিকুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। অন্য পুলিশ কর্মকর্তারাও ফোন রিসিভ করেননি। কোনো এক রহস‌্যময় কারণে তারা গণমাধ‌্যমকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঊর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করে। এখন যে বা যারাই ছবি তুলেছেন- এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে, আগে থেকে জানা না থাকলে কেউ এসে ছবি তুললে সেটি দোষের কিছু না।’

প্রসঙ্গত, ১৬ জুলাই রাতে খুলনার খানজাহান আলী থানার মশিয়ালী এলাকায় জাকারিয়া বাহিনীর গুলিতে মারা যান আটরা আটরা গিলাতলার মশিয়ালী এলাকার মৃত মো. বারিক শেখের ছেলে মো. নজরুল ইসলাম (৬০) ও একই এলাকার মো. ইউনুচ আলীর ছেলে গোলাম রসুল (৩০)। এ সময়ে গুলিবিদ্ধ হন মো. সাইফুল ইসলাম, আফসার শেখ, শামীম, রবি, খলিলুর রহমান ও মশিয়ার রহমানসহ আরও কয়েকজন। এর মধ্যে আহত সাইফুল ইসলাম ১৭ জুলাই সকালে মারা যান। অপরদিকে, বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর গণপিটুনীতে জাকারিয়া বাহিনীর সদস্য জিহাদ শেখ নিহত হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে