শীত শেষে গরম শুরুর সময় এসি চালু করার আগে আগে টেকনিশিয়ান ডেকে এসে মেরামতের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা ইলোরা চৌধুরী। সেটাই তাদের বড় একটি দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
”টেকনিশিয়ান চালু করেই দেখেন, ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। তিনি সেটা খুলে মেরামতের পর দেখতে পান, যন্ত্রটি জ্যাম হয়ে আছে। তিনি আমাদের জানালেন, এভাবে খানিকক্ষণ চললেই এসিটি বিস্ফোরিত হতে পারতো।” বলছেন মিসেস চৌধুরী।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এয়ার কন্ডিশনার বা এসির ব্যবহার বাড়ছে, তেমনি প্রায়ই এসি বিস্ফোরণের ঘটনার কথাও শোনা যাচ্ছে।
দমকল বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ও গাজীপুর মিলিয়ে ২০১৯ সালেই অন্তত পাঁচটি এসি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। যার মধ্যে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন অন্তত ২২জন।
কেন ঘটছে এসি দুর্ঘটনা?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক অলোক কুমার মজুমদার বলছেন, এসি দুর্ঘটনার পেছনে তিন চারটি কারণ রয়েছে।
”অনেকে রুমের লোড অনুপাতে এসি ব্যবহার করেন না। ফলে এসিটি অনেকক্ষণ ধরে চলতে হয়, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত গরম হয়ে যায়। নিম্নমানের এসি কিনলে সেগুলোর ভেতরে ফ্যান, তারের, বিদ্যুতের ব্যবস্থাগুলো ঠিক থাকে না। ফলে সেখানেও কারিগরি ক্রুটি দেখা যায়, যা অনেক সময় আগুনের সূত্রপাত করতে পারে।”
তিনি বলছেন, ”এসি দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। ফলে কারিগরি ক্রুটির কারণে এসিতে আগুন ধরে যেতে পারে বা এসির গ্যাসে আগুন লেগে সেটি ঘরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
অনেক সময় উইন্ডো এসির সামনে জানালা বা দরজার পর্দা চলে এলে বাতাস চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়। সেটিও এসিকে গরম করে তুলতে পারে বলে তিনি জানান।
নিম্নমানের গ্যাস আর প্রতিযোগিতার বাজার
ঢাকার গুলশানে একটি এসি সরবরাহ এবং সার্ভিসিংয়ের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন দুলাল দাস। তিনি বলছিলেন, ”বর্তমানের এসিগুলোয় যে গ্যাস ব্যবহার করা হয়, সেই গ্যাসে সহজে আগুন ধরে যায়। ফলে কোন কারণে সেটি লিক হয়ে জমে থাকলে, সেখানে বৈদ্যুতিক কারণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হলে বা ম্যাচের কাঠি জ্বালানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে।”
তিনি জানান, দশবছর আগের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে এসির ব্যবহারের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে প্রচণ্ড গরমের কারণে এই বছরে অনেক বেশি এসি বিক্রি হয়েছে।
” প্রতিযোগিতার বাজারের কারণে অনেকে চীন থেকে অত্যন্ত কম মূল্যে কিন্তু নিম্নমানের জিনিস দিয়ে তৈরি এসি এনে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করছে। এমনকি অনেকে এসব এসির গায়ে নামী ব্রান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করছে। এসব এসির গুণগত মান খারাপ হওয়ায় সহজেই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে”।
দুলাল দাস বলছেন, দামী এই যন্ত্রটি কেনার আগে বিশেষ সতর্ক হওয়া উচিত, যাতে নকল কিনে ঠকতে না হয়। এজন্য ব্র্যান্ডগুলোর নিজস্ব শোরুম থেকে কেনাই ভালো বলে তিনি পরামর্শ দেন।
এসি দুর্ঘটনার যেসব সম্ভাব্য কারণ জানা যাচ্ছে:
-অনেক পুরনো বা নিম্নমানের এসির ব্যবহার
-রুমের আকার অনুযায়ী সঠিক ক্ষমতার এসি ব্যবহার না করা
-কম্প্রেসরের ভেতরে ময়লা আটকে জ্যাম তৈরি হওয়া
-এসি থেকে গ্যাস লিক হওয়া এবং সেটি রুমে বা এসির ভেতরে জমে থাকা
-দীর্ঘক্ষণ টানা এসি চালানো, যার ফলে এসির প্রেশার বেড়ে যায় এবং সেটিকে গরম করে তোলে
-এসির ভেতরের বা বাইরের বৈদ্যুতিক তার নড়বড়ে হয়ে থাকা, যা শর্টসার্কিটের তৈরি করতে পারে
-বৈদ্যুতিক হাই ভোল্টেজের কারণে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ওপর চাপ তৈরি হওয়া
-অনেকদিন এসির সার্ভিসিং না করানো
-বজ্রপাত বা বৃষ্টির সময়ে এসি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ ভালো আর্থিং ব্যবস্থা না থাকলে এটিও এসির দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
যেভাবে দুর্ঘটনা এড়ানো যেতে পারে:
বুয়েটের অধ্যাপক অলোক কুমার মজুমদার বলছেন, অন্য যেকোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মতো এসিরও বিশেষ যত্ন নেয়ার দরকার আছে। তাহলে একদিকে যন্ত্রটি যেমন ভালো থাকবে, তেমনি দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
” ”আমাদের দেশে এসির রক্ষণাবেক্ষণে খুব অবহেলা করা হয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই যন্ত্রটি কিন্তু বাসার অন্যসব যন্ত্রের মতো নয়। এটির জন্য রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি। প্রতিমাসে ফিল্টার পরিষ্কার রাখা, বছরে একবার অন্তত পুরো যন্ত্রটির সার্ভিসিং করানো, আউটডোর ইউনিট পরিষ্কার রাখতে হবে।’
এসি সার্ভিসিং এক্সপার্ট দুলাল দাস বলছেন, ”বছরে অন্তত একবার পেশাদার টেকনিশিয়ানের সাহায্যে এসির সার্ভিসিং করানো উচিত। বিশেষ করে শীতের সময় দীর্ঘ কয়েকমাস বন্ধ থাকার পরে গরমের আগে আবার চালু করার আগে অবশ্যই সার্ভিসিং করে নেয়া উচিত।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসি দুর্ঘটনা এড়াতে কয়েকটি বিষয়ের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া উচিত।
-পেশাদারদের মাধ্যমে নিয়মিত সার্ভিসিং করানো
-রুমের আকার অনুযায়ী সঠিক মাত্রার এসি নির্ধারণ
-নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ডের এসি কেনা
-দীর্ঘসময় একটানা এসি না চালিয়ে মাঝে মাঝে বিরতি দেয়া
-বৈদ্যুতিক সংযোগ, সকেট, ফিল্টার নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করা।
-হাই ভোল্টেজ এড়াতে বাড়িতে সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করা।
-বৃষ্টি ও বজ্রপাতের সময় এসির ব্যবহার বন্ধ রাখা। এছাড়া বাড়ির ছাড়ে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে।
এসি এক্সপার্ট দুলাল দাস বলছেন, একনাগাড়ে আট ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা উচিত নয়। এছাড়া আউটডোর মেশিন এমন স্থানে বসাতে হবে, যেন পর্যাপ্ত বাতাস চলাচল করতে পারে। সূত্র: বিবিসি বাংলা