মঙ্গলগ্রহে দুই বছর আগে সর্বশেষ মহাকাশযান অবতরণ করেছিল মানবজাতি। তারপরও থেমে থাকেনি মঙ্গল সম্পর্কে আরও জানার আকাঙ্ক্ষা। মঙ্গলে বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগিতা চলছে প্রথম থেকেই। প্রযুক্তি আর বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে রেষারেষি চলছে অনেক দিন ধরেই। মহাকাশ অভিযানের প্রতিযোগিতা তাতে যেন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এবার বিশ্বের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির অভিযানের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে সৌর জগতের চতুর্থ গ্রহটি।
১৯৬৯ সালে স্নায়ুযুদ্ধের সময় প্রথম চাঁদের বুকে মহাকাশযাত্রী অবতরন করায় যুক্তরাষ্ট্র। যা সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এক নতুন মাত্রার মহাকাশ প্রতিযোগিতা উস্কে দেয়। চীনের বর্তমান পরিকল্পনাও তার ব্যতিক্রম নয়।
ভিনগ্রহে মহাকাশযানের নিরাপদ অবতরণ সব সমই একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং কাজ। এই অব্স্থায় আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আজ বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) চীন তার দক্ষিণনাঞ্চলের হাইনান দ্বীপ থেকে তিয়ানওয়েন-১ নামের মহাকাশযান উৎক্ষেপণ করবে। অবশ্য তারিখটি দেশটির সরকার এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেনি।
তবে চলতি মাসের ৩০ তারিখে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা তাদের প্রিজারভেন্স নামক মঙ্গলযান উৎক্ষেপণের তারিখ জানিয়েছে। দুই দেশের উৎক্ষেপিত মহাকাশযানই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ মঙ্গলে পোঁছাবে, বলে আশা করা হচ্ছে।
নাসার প্রিজারভেন্স মঙ্গলে জীবনের সম্ভাব্যতা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে যে প্রশ্ন আছে-তার উত্তর সন্ধান করবে। যেমন; অতীতে ধূসর লাল গ্রহটিতে জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ ছিল কিনা এবং অতিক্ষুদ্র জীবকণার অস্তিত্ব এখনও আছে কিনা; তা অনুসন্ধান করবে প্রিজারভেন্স। রোভার জাতীয় রোবট যানটি একটি খননযন্ত্র ব্যবহার করে মঙ্গলের মাটি ও পাথরের নমুনা সংগ্রহ করবে। এসব নমুনা পরবর্তীকালের অভিযানে পাঠানো মহাকাশযান বিশ্লেষণের সুযোগ পাবে।
যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, তাহলে প্রিজারভেন্সের মাধ্যমে মঙ্গলের বুকে সপ্তম প্রোব অবতরণের সফলতা অর্জন করবে নাসা। আর একইসঙ্গে আসবে চতুর্থতম রোভার যান অবতরণের সাফল্য। সর্বপ্রথম ২০১২ সালে মঙ্গলের বুকে নেমেছিল নাসার তৈরি রোভার ‘কিউরিওসিটি’। রোভার যানটি এখনও সচল আছে এবং নিয়মিত পৃথিবীতে নাসার বিজ্ঞানীদের কাছে মঙ্গলের তথ্যাবলী পাঠাচ্ছে।
সেই তুলনায় মঙ্গলে চীনের প্রথম প্রোব ও রোভার অভিযান হতে চলেছে তিয়ানওয়েন-১। চীনা ভাষায় তিয়ানওয়েন এর অর্থ হলো, ‘স্বর্গীয় সত্যের সন্ধান’। চীনা প্রোবটি প্রথমে মঙ্গলের কক্ষপথে ঘুরবে। তারপর সেখান থেকে একটি রোভার যান অবতরণ করবে মরিচা রঙের গ্রহে। রোভারটি মঙ্গলের মাটির প্রকৃতি, গ্রহের ভৌগলিক গঠন, আবহাওয়া, বায়ুমণ্ডল এবং পানির উৎস সন্ধান করবে।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে তিয়ানওয়েন-১ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা জানান, মঙ্গলের কক্ষপথে ভ্রমণ সম্পন্ন করার পর, তাদের প্রোবটি গ্রহটির মাটিতে অবতরণ করবে। এরপর প্রোবের ভেতরে থাকা একটি রোভারযানকে অনুসন্ধানের জন্য পাঠানো হবে।
যদিও পরিকল্পনাটি খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কারণ চীনা বিজ্ঞানীরা প্রথম অভিযানেই একসঙ্গে প্রোবের কক্ষপথে ঘূর্ণন এবং সেখান থেকে রোভার অবতরণের পরিকল্পনা করেছেন। যা মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসা করেছে ধাপে ধাপে। মঙ্গলে অবতরণের আগে বেশ কয়েকটি কক্ষপথে ভ্রমণকারী যান পাঠায় নাসা। কারণ, ভিনগ্রহে মহাকাশযানের নিরাপদ অবতরণ সব সমই একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং কাজ।
প্রথম চেষ্টায় দুইটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর পার করা গেলে; তা চীনের জন্য হবে প্রকৌশলবিদ্যার বিশাল এক অর্জন । দেশটির গবেষকরা নেচার জার্নালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে এসব কথা জানান ।
তিয়ানওয়েন প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা তাদের প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কলেবর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মহাকাশ অভিযান সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের মাত্রাও বেড়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নয়; গত রবিবার উৎক্ষেপিত আরব আমিরাতের ‘হোপ প্রোব’টিও আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছাবে। আরব বিশ্বের প্রথম আন্তঃগ্রহ অভিযান হতে চলেছে এটি।”
দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেওয়ার আগে, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের বিজ্ঞানীরা মহাকাশ নিয়ে একযোগে কাজ করার সুযোগ পেতেন। পৃথিবীর কক্ষপথে স্থাপিত আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র নির্মাণেও তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন। সফল অভিযানের প্রেক্ষিতে একে-অন্যের প্রতি শুভাচ্ছে বার্তাও পাঠাতেন তারা। প্রথম দেশ হিসেবে চীন যখন চাঁদের অপরপৃষ্ঠে তাদের মহাকাশযান অবতরণ করে, তখন নাসার বিজ্ঞানীরা তাদের চৈনিক প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
তবে বিজ্ঞানীদের পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ- সাম্প্রতিক মহাকাশ প্রতিযোগিতায় প্রতিফলিত হচ্ছে না। কারণ এখনকার অভিযানগুলোর উদ্দেশ্য ভূ-রাজনীতির বৈরিতা দ্বারা প্রভাবিত।
বিশেষ করে, সফল মহাকাশ অভিযানে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার যে সম্মান মিলবে, তার সম্পর্কে ভালো করেই জানে বেইজিং। আর একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত মহাকাশ শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে পিছিয়ে ফেললে, তাতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তারের নতুন সুযোগ তৈরি হবে চীনা নেতৃত্বের। তিয়ানওয়ে-১ সফল হলে, এরপর মঙ্গলে মনুষ্য অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে দেশটির।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের মহাকাশ বিজ্ঞান উন্নয়নে শত শত কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়েছেন। বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি মহাকাশে নিজেদের সগর্ব উপস্থিতি জানান দিতে সচেষ্ট বেইজিং।
এ কারণে দেশটির ১৩তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মহাকাশ গবেষণার উন্নয়নকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বিশেষ গুরুত্ব পায়, মহাকাশের গভীরে অভিযান এবং ভিনগ্রহের কক্ষপথে পাঠানো সম্ভব এমন মহাকাশযান তৈরির গবেষণা। যার আওতায় ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীর কক্ষপথে সম্পূর্ণ নিজেদের একটি মহাকাশ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে। অন্যদিকে, ২০৩০ সালে চাঁদে চীনা নভোচারীরা অবতরণ করবেন।
ইতোপূর্বে, ২০১৬ সালে চীনের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কর্তৃপক্ষের উপ-প্রধান উ ইয়ানহুয়া জানান, “২০৩০ সাল নাগাদ চীনকে মহাকাশ পরাশক্তিতে রূপান্তরিত করাটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”